শ্রমিকদের আন্দোলনে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ জায়ান্ট টেক্সটাইলস

কারখানার ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ এবং শ্রমিকদের পাল্টাপাল্টি অভিযোগে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলে কর্তৃপক্ষ অনির্দিষ্টকালের জন্য কারখানায় বন্ধের নোটিশ জারি করে।

মোহাম্মদ আলী ঝিলন, গাজীপুর

Location :

Gazipur
শ্রমিকরা কারখানার সামেনে অবস্থান নেয়
শ্রমিকরা কারখানার সামেনে অবস্থান নেয় |নয়া দিগন্ত

গাজীপুরে বিনা কারণে শ্রমিকদের চাকুরিচ্যুতি এবং নারী শ্রমিকদের প্রতি কর্মকর্তাদের অশালীন আচরণের প্রতিবাদে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে শ্রমিকরা। অন্যকে অন্দোলনরত শ্রমিকদের হাতে লাঞ্ছিত হওয়ার অভিযোগ করেছেন কারখানার কর্মকর্তারা। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কারখানা কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ শ্রম আইনে কারখানার সকল কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধের নোটিশ জারি করেন।

রোববার (২৮ সেপ্টেম্বর) থেকে এ নোটিশ কার্যকর হয়। এর আগে শনিবার (২৭ সেপ্টেম্বর) গাজীপুর সদর উপজেলার বানিয়ারচালা (মেম্বার বাড়ি) এলাকায় অবস্থিত জায়ান্ট গ্রুপের জায়ান্ট টেক্সটাইলস লিমিটেড কারখানায় এসব ঘটনা ঘটে।

এদিকে বিনা কারণে শ্রমিকদের চাকুরিচ্যুতি, নারী শ্রমিকদের প্রতি কর্মকর্তাদের অশালীন আচরণ করার পিসি কমিটির তিন নারী সদস্যকে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ ও মারধরের অভিযোগ উঠেছে কারখানার ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) সোহেল রানা ও রক্ষণাবেক্ষণ শাখার (মইনটেন্যান্স) সহকারী মহা-ব্যবস্থাপক (এজিএম) কাউছারের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় নির্যাতিত নারী শ্রমিক ও পিসি কমিটির সদস্য জুঁই আক্তার অভিযোগ করেন।

সোমবার (২৯ সেপ্টেম্বর) দুপুরে তিনি এসব অভিযোগ করেন।

পরে শ্রমিকদের প্রতি এ সকল আচরণের প্রতিবাদে সোমবার (২৯ সেপ্টেম্বর) সকাল ৮টার দিকে শ্রমিকরা কারখানার সামেনে অবস্থান নেয়। বেলা ১১টার দিকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের মেম্বারবাড়ি এলাকায় মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে।

বিক্ষোভে তারা চরিত্রহীন কর্মকর্তাদের অপসারণসহ তাদের নির্যাতনের বিচার দাবি করেন। এ সময় সড়কের উভয় পাশে দীর্ঘ যানজট লেগে যায়। খবর পেয়ে জয়দেবপুর থানা পুলিশ ও শিল্প পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে শ্রমিকদের তাদের দাবি নিয়ে কারখানা কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলার আশ্বাস দিলে আধা ঘণ্টা পর তারা সড়ক ছেড়ে দেয়। পরে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।

এদিকে শ্রমিকদের এসব অভিযোগ কারখানা কর্তৃপক্ষ অস্বীকার করে উল্টো শ্রমিকদের বিরুদ্ধে তাদের মারধরের অভিযোগ করেন। কারখানার ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ এবং শ্রমিকদের পাল্টাপাল্টি অভিযোগে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলে কর্তৃপক্ষ অনির্দিষ্টকালের জন্য কারখানায় বন্ধের নোটিশ জারি করে।

পিসি (শ্রমিক অংশগ্রহণকারী) কমিটির সদস্য ও নির্যাতিত নারী শ্রমিক জুঁই আক্তার বলেন, ‘২০২৪ সালে জায়ান্ট টেক্সটাইলস লিমিটেড কারখানায় সুইং সেকশনে জেএসএম অপারেটর হিসেবে যোগদান করি। বিগত ছয় মাস ধরে কারখানার ভেতরে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের কয়েকজন সদস্য বিভিন্ন সময় নারী কর্মীদের সাথে অশালীন আচরণ করে আসছে। দীর্ঘদিন ধরে শ্রমিকদের একাংশ কর্মকর্তাদের ওইসব আচরণের ন্যায়সঙ্গত প্রতিবাদ করে আসছে।’

তিনি বলেন, ‘ঘটনার দিন শনিবার সকাল ৮টার দিকে আমি কাজ করার জন্য কারখানায় প্রবেশ করি। এ সময় নারী কর্মীদের সাথে কর্মকর্তাদের অশালীন আচরণের প্রতিবাদে শ্রমিকরা একত্রিত হয়ে বিষয়টি সুষ্ঠু সমাধানের দাবি তুলে। আমিসহ আমার সহকর্মী পিসি (শ্রমিক অংশগ্রহণকারী) কমিটির সদস্য প্রমা, কুসুম রানী তাদের দাবির সাথে একমত হয়ে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলার চেষ্টা করি। কারখানার ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) সোহেল রানা অজ্ঞাত ৩০-৪০ জন লোক নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়ে বিচার চাওয়া শ্রমিকদের উদ্দেশ করে বলেন, তোমরা কি চাকরি করবা না? তোমরা কি তাদের মতো (জুঁই, প্রমা ও কুসুম রানী নাম উল্লেখ করে) দেহ বিক্রি করে করে খাবে? একপর্যায়ে শ্রমিকরা বিক্ষোভ শুরু করলে কারখানা অভ্যন্তরে কর্মকর্তা ও শ্রমিকদের সাথে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। পরে সোহেল রানা ও এজিএম কাউছারসহ অজ্ঞাত ৩০-৪০ জন লোক পূর্ব পরিকল্পিতভাবে লাঠিসোঁটা নিয়ে আমাকেসহ আমার সাথে থাকা কর্মীদের এলোপাতাড়ি পিটিয়ে আহত করেন।’

তিনি আরো বলেন, ‘পরে ব্যবস্থাপক সোহেল রানা ও সহকারী মহা-ব্যবস্থাপক কাউছার নারী শ্রমিকের (জুঁই) পরনের বস্ত্র টেনে হিঁচড়ে ছিঁড়ে ফেলেন এবং তার শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে স্পর্শ করার চেষ্টা করে শ্লীলতাহানি করেন। পরে সোহেল রানা নারী শ্রমিককে ঘাড় ধরে টেনে কারখানার বাইরে বের করে দিয়ে বলেন, এ নারী শ্রমিক আবার কারখানায় প্রবেশ করলে তাকে উলঙ্গ করে কারখানার ভেতরে ঝুলিয়ে রাখবো। পরে সহকর্মীদের সহযোগিতায় আহত শ্রমিকরা গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দিন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা নেয়।’

কারখানার শ্রমিক আল হাদী জানান, ‘কার্ড পাঞ্চ করাকে ইস্যু করে আমাকে কারখানা থেকে বের করে দেয়। এ ঘটনায় অন্য শ্রমিকরা কারখানা কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চাইলে কারখানার কর্মকর্তাসহ বহিরাগত লোকজন শ্রমিকের উপর হামলা করে। এ ঘটনার প্রতিবাদে শনিবার বিক্ষোভ মিছিল করে প্রতিবাদ জানায় শ্রমিকরা।’

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ও সোয়েটার শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের গাজীপুর জেলার সাধারণ সম্পাদক জালাল হাওলাদার ও অর্থবিষয়ক সম্পাদক মাফুজুল ইসলাম বলেন, ‘মালিকপক্ষের লোকজন শ্রমিকদের মারধর করার পাশাপাশি নারী শ্রমিকদের লাঞ্ছিত করেছে। রোববার সকালে শ্রমিকরা কারখানার সামনে গিয়ে দেখে কারখানা বন্ধ। পরে শ্রমিকরা কারখানা চালু করার দাবি এবং শ্রমিকদের মারধর ও নারী শ্রমিকদের লাঞ্ছিত করার বিচারের দাবি করেন।’

তবে জায়ান্ট টেক্সটাইলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) সোহেল রানা এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘শ্রমিকরা অযৌক্তিক দাবি তুলে, অতিরিক্ত ওভারটাইম নেয় ও কার্ড পান্স করে চলে যায়। কোনো শ্রমিককে বরখাস্ত করলে তাদের পুনরায় কাজে যোগদানের জন্য চাপ সৃষ্টি করে।’

জায়ান্ট টেক্সটাইলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) আনেয়ারুল হক রিপন বলেন, ‘আমাদের কারখানা শতভাগ কমপ্লায়েন্স নিয়মে পরিচালিত হয়। কোনো শ্রমিককে কখনো গালিও দেয়া হয় না। এক শ্রমিককে পুনরায় নিয়োগ করার দাবিতে তার পক্ষের কিছু শ্রমিক আমাদের বাধ্য করতে ব্যর্থ হয়। পরে তারা অযৌক্তিক ক্লেইম দিয়ে একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। পরে শ্রমিকরা আমাদের বিভিন্ন সেকশনের কর্মকর্তাদের মারধর করে। পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে কর্তৃপক্ষ কারখানার সকল কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পরবর্তী সময়ে নোটিশ দিয়ে কারখানা খোলার তারিখ জানিয়ে দেয়া হবে।’

গাজীপুর শিল্প পুলিশের পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) আব্দুল লতিফ বলেন, ‘কারখানায় শ্রমিক বিক্ষোভের চলাকালীন সময় শনিবার আমি ঘটনাস্থলে ছিলাম। সম্পত্তি ও জানমাল রক্ষার স্বার্থে কারখানার কর্তৃপক্ষ রোববার থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারখানা বন্ধ ঘোষণা করে।’