ঋতুচক্রের দেশ বাংলাদেশে আবারো ধীরে ধীরে নেমে আসছে শীতের আগমনী বার্তা। দিনের শেষে ঠাণ্ডা হাওয়া আর সকালের কুয়াশায় গ্রামীণ জনপদে শীতের উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে। এ আবহেই চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার গাছিরা শুরু করেছেন খেজুর গাছ কাটার প্রস্তুতি, যা গ্রাম-বাংলার শীতকালীন ঐতিহ্যের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
দিনপঞ্জিকায় শীত এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে না এলেও প্রকৃতি তার নিজস্ব নিয়মে জানিয়েছে আগমনী সঙ্কেত। উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে
ইতোমধ্যে গাছিরা খেজুর গাছ ছাঁটাই, রস সংগ্রহের পাত্র তৈরি ও ‘চাঁচা’ দেয়ার কাজ শুরু করেছেন।
স্থানীয় গাছিরা জানিয়েছেন, আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যেই পুরোপুরিভাবে রস আহরণ শুরু হবে। শীতের শুরুতে প্রাপ্ত রস থেকেই তৈরি হবে সুস্বাদু খেজুরের গুড় ও পাটালি, যা গ্রামীণ অর্থনীতির জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
এক সময় জীবননগরসহ সারাদেশের গ্রামীণ জনপদে রাস্তার ধারে, ক্ষেতের আইলে ও বাড়ির আঙিনায় সারি সারি খেজুর গাছ দেখা যেত। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে সে দৃশ্য এখন বিরল। ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে নির্বিচারে খেজুর গাছ কাটা, জলবায়ু পরিবর্তন ও গাছিদের পেশা পরিবর্তনের কারণে দ্রুত কমে যাচ্ছে এ মধুবৃক্ষের সংখ্যা। ফলে রস ও গুড় উৎপাদনও উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।
উপজেলার কালা গ্রামের গাছি খাজা আহমেদ ও মিনহাজপুর গ্রামের ইব্রাহিম হোসেন বলেন, ‘প্রতি শীত মৌসুমে আমরা নিজস্ব গাছের পাশাপাশি গ্রামের কৃষকদের গাছ বর্গা নিয়ে রস সংগ্রহ করি। প্রতি গাছের জন্য মালিককে পাঁচ থেকে সাত কেজি গুড় দিতে হয়। কিন্তু গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ায় এখন আর আগের মতো রস পাওয়া যায় না। ভবিষ্যতে হয়তো খেজুর গাছই পাওয়া কঠিন হবে।
উপজেলার ধোপাখালী গ্রামের সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সদস্য দোজা উদ্দিন বলেন, ‘বর্তমানে আখের গুড় ও চিনির তুলনায় খেজুর গুড়ের দাম বেশি। এ বছর উৎপাদন খরচ কিছুটা বেড়েছে। একটি গাছ প্রস্তুত করতে ৬০ থেকে ৮০ টাকা পর্যন্ত লাগে। তবে বর্তমানে খেজুর গুড়ের মান ও বাজারমূল্য ভালো থাকায় এটি এখনো লাভজনক ব্যবসা।’
তিনি আরো বলেন, ‘যদি সরকার বা বেসরকারি উদ্যোগে খেজুর গুড় ও পাটালিকে আধুনিক প্রক্রিয়াজাত করে রফতানি করা যায়, তাহলে গাছি ও কৃষকরা আরো বেশি লাভবান হবেন। অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করবে।’
উপজেলার সচেতন মহল মনে করছেন, খেজুর গাছ শুধু অর্থনৈতিক দিক থেকে নয়, এটি বাংলাদেশের সংস্কৃতি, সাহিত্য ও জীবনধারার অংশ। তাই এ ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে সরকারি ও স্থানীয় পর্যায়ে সচেতনতা, চারা রোপণ কর্মসূচি এবং গাছিদের প্রশিক্ষণ জরুরি।
শীতকাল আসার সাথে সাথে জীবননগরের গাছিদের মধ্যে ব্যস্ততা বাড়ছে খেজুর রস সংগ্রহ ও গুড় তৈরিকে ঘিরে। তবে গাছের সংখ্যা
কম, গাছিদের অভাব ও পরিবেশগত সংকট এ ঐতিহ্যকে হুমকির মুখে ফেলছে। তাই গ্রামীণ ঐতিহ্য ও অর্থনীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে এখনই দরকার সমন্বিত উদ্যোগ ও সচেতনতা।
জীবননগর উপজেলা কৃষি অফিসার আলমগীর হোসেন জানান, দেশজুড়ে খেজুর গাছ ক্রমেই বিলুপ্তির পথে। তবুও জীবননগর অঞ্চলে পতিত জমি, রাস্তার ধারে ও আইলে থাকা গাছ থেকে প্রতি বছর কিছু পরিমাণ রস, গুড় ও পাটালি উৎপাদন হয়। যা স্থানীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপুর্ণ অবদান রাখছে। তবে গাছ সংরক্ষণে কার্যকর উদ্যোগ না নিলে ভবিষ্যতে এ ঐতিহ্য হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।



