চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানীয়দের সাথে সংঘর্ষে মাথায় গুরুতর আঘাত পাওয়া দু’শিক্ষার্থী মামুন মিয়া ও ইমতিয়াজ আহমেদের শারীরিক অবস্থায় নাটকীয় উন্নতি ঘটেছে। আশঙ্কাজনক অবস্থা থেকে বেঁচে ফিরে তাদের দু’জনেরই জ্ঞানের মাত্রা এখন সম্পূর্ণ স্বাভাবিক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক।
গত ৩১ আগস্ট চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেট এলাকায় শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় এই দু’শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হয়েছিলেন। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাদের নগরের পার্কভিউ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
সোমবার (৮ সেপ্টেম্বর) তাদের চিকিৎসার দায়িত্বে থাকা চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা: মুইসমাঈল হোসেন দু’শিক্ষার্থীর সর্বশেষ অবস্থা তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, ‘স্বাভাবিক সুস্থ মানুষের জ্ঞানের মাত্রা হলো ১৫ এবং সর্বনিম্ন মাত্রা ৩, যা মৃত্যুর নির্দেশক। অপারেশনের আগের সময়ে ইমতিয়াজের জ্ঞানের মাত্রা ছিল ৪ এবং মামুনের ছিল ৫, অর্থাৎ তারা মৃত্যুর খুব কাছাকাছি ছিল। আল্লাহর রহমতে, চিকিৎসার পর এখন দু’জনেরই জ্ঞানের মাত্রা ১৫, যা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক।’
মামুন : জটিল অস্ত্রোপচার ও ‘হাঁটানোর’ পেছনের কথা
সমাজতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী মামুন মিয়ার অবস্থা ভর্তির সময় অত্যন্ত গুরুতর ছিল। ডা: ইসমাঈল জানান, ‘মামুন যখন এখানে আসে, তার মস্তিষ্কে প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ হচ্ছিল, ব্রেইন প্রায় ড্যামেজড ছিল এবং মাথার খুলি অনেকগুলো ছোট ছোট টুকরোতে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। আমরা সেই টুকরোগুলো বের করে ফেলি এবং জমাট বাঁধা রক্ত বের করে দিই।’
তিনি আরো জানান, মামুনের মস্তিষ্কের ওপর চাপ কমাতে একটি জটিল কিন্তু নিউরোসার্জারিতে প্রচলিত অস্ত্রোপচার করা হয়। মাথার খুলির একটি বড় অংশ খুলে আমরা ফ্রিজে সংরক্ষণ করেছি। এটি চিকিৎসারই একটি অংশ, যাতে ব্রেইনের ওপর চাপ না বাড়ে। এটি নিউরোসার্জারীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন। দু’থেকে তিন মাস পর সব ঠিক থাকলে ওই অংশটি আবার প্রতিস্থাপন করা হবে।’
অস্ত্রোপচারের পর মামুনের দ্রুততম সময়ে উন্নতি ঘটছে। পরের দিনই তার লাইফ সাপোর্ট খুলে দেয়া হয় এবং নবম দিনে সে মুখে ভাত খেতে পারছে ও কুশল বিনিময় করছে।
সম্প্রতি মামুনকে হাঁটাচলার একটি ছবি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে আলোচনা তৈরি হয়েছিল, সেটিকে চিকিৎসার ‘স্বাভাবিক অংশ’ বলে উল্লেখ করেন চিকিৎসক ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
ডা: ইসমাঈল বলেন, ‘পোস্ট অপারেটিভ রিহ্যাবিলিটেশন এর অংশ হিসেবেই ওকে আমরা হাঁটিয়েছি। কে বা কারা ছবি তুলে সেটা ফেসবুকে দিয়েছেন তা আমি জানি না। রোগীকে দ্রুততম সময়ে হাঁটাচলা করানোকে আমরা উৎসাহিত করি। হাঁটতে পারাটা সুস্থ হয়ে ওঠার একটা গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ। এতে শরীরে রক্ত সঞ্চালন বাড়ে এবং দীর্ঘক্ষণ শুয়ে থাকার কারণে বেডসোর বা ফুসফুসের সমস্যার মতো জটিলতা এড়ানো যায়।’
একই সুরে পার্কভিউ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ টি এম রেজাউল করিম বলেন, ‘এটি একটি রুটিন ওয়ার্ক। রোগীর আত্মবিশ্বাস বাড়াতে হাঁটাচলা করানো হয়। সেদিন চিকিৎসক সেটিই করছিলেন এবং ভিসি মহোদয় ছবিটি তুলেছিলেন।’
এই চিকিৎসাসেবায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করে মামুনের বড় ভাই মো: মাসুদ রানা বলেন, ‘গতকাল সোমবার দুপুরে মেডিকেল বোর্ড বসেছিল। মামুনের অবস্থা এখন অনেক ভালোর দিকে। পার্কভিউ হাসপাতালের চিকিৎসা নিয়ে আমরা সন্তুষ্ট। এখানকার ডাক্তারবিশেষ করে নিউরোসার্জন ডা: ইসমাঈল অত্যন্ত আন্তরিক, উনারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। তাকে অন্য কোনো হাসপাতালে স্থানান্তরের প্রয়োজন মনে করছি না, কারণ এখানে সে সর্বোচ্চ সেবা পাচ্ছে।’
ইমতিয়াজ: মৃত্যুর মুখ থেকে ফেরা
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ আহমেদের অবস্থা ছিল আরো বেশি আশঙ্কাজনক। ডা: ইসমাঈল বলেন, ‘ইমতিয়াজকে যখন হাসপাতালে আনা হয়, তখন তার জ্ঞানের মাত্রা ছিল মাত্র ৪ এবং সে পরিপূর্ণ শকে ছিল। আমরা প্রথমে তিন ব্যাগ রক্ত দিয়ে তাকে স্থিতিশীল করি, এরপর অপারেশনে নিয়ে যাই।’
অস্ত্রোপচারে দেখা যায়, ধারালো অস্ত্রের আঘাতে তার মাথার খুলি দু’ভাগ হয়ে মস্তিষ্কের পর্দা ও একাধিক রক্তনালী ছিঁড়ে গিয়েছিল। দীর্ঘ সময় ধরে সেই রক্তনালীগুলো মেরামত করা হয়।
টানা সাত দিন আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে থাকার পর তাকে লাইফ সাপোর্ট থেকে বের করা হয়েছে। ডা: ইসমাঈল জানান, ‘এখন সে পরিপূর্ণভাবে তার বাবা-মা এবং অন্যদের চিনতে পারছে। আমরা আশা করছি, দু’এক দিনের মধ্যেই তাকে কেবিনে স্থানান্তর করতে পারব।’
ছেলের চিকিৎসায় আস্থা রেখে ইমতিয়াজের বাবা মো: আমির হোসেন বলেন, ‘আল্লাহর পর ডাক্তারদের ওপরই আমাদের ভরসা। ডা: ইসমাঈল অত্যন্ত দক্ষতার সাথেই আমার ছেলের অপারেশন করেছেন। পার্কভিউ হাসপাতালে খুব ভালো চিকিৎসা হচ্ছে, এখানকার সেবায় আমরা সন্তুষ্ট। ইমতিয়াজের অবস্থা ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে। আমরা তার জন্য সবার কাছে দোয়া চাই।’