চৌগাছায় ওষুধ ও জনবল সংকটে স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলো, সেবা বঞ্চিত জনসাধারণ

উপজেলার সব ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রগুলোতে জনবল ও ওষুধ সংকট রয়েছে। তাই জনবল ও ওষুধ সংকটে সেবা কিছুটা ব্যাহত হলেও অচিরেই তা কেটে যাবে।

এম এ রহিম, চৌগাছা (যশোর)

Location :

Jashore
চৌগাছা ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র।
চৌগাছা ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র। |নয়া দিগন্ত

চৌগাছায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতে প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র (এফডব্লিউসি) রয়েছে। এ সেবামূলক সরকারি প্রতিষ্ঠান ওষুধ ও জনবল সংকটে ধুঁকছে, সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন জনসাধারণ। কিছু ওষুধ আসলেও সেটা রোগীদের হাতে পৌঁছায় না। দিনের পর দিন বন্ধ থাকায় সেবা নিতে আসা অনেক রোগী হতাশ হয়ে ফিরে যান।

শনিবার (২২ নভেম্বর) উপজেলার পতিবিলা ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র ঘুরে দেখা যায়, কেন্দ্রটিতে সেবা নিতে আসা রোগীরা ওষুধ না পেয়ে খালি হাতে বাড়ি ফিরছেন। এ সময় কথা হয় ইউনিয়নের নিয়ামতপুর গ্রামের নিমাই চন্দ্র পালের (৭৬) সাথে। তিনি বলেন, ‘এখানে কোনো দিন ওষুধ পাওয়া যায় না। আমি যতদিন এসেছি খালি হাতে ফিরে যেতে হয়েছে।’ সরকারি এ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে সঠিক সেবা না পাওয়ায় ভোগান্তিতে পড়েছেন এলাকাবাসী। উপজেলার অন্য ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রেগুলোতেও একই চিত্র।

স্থানীয়রা জানান, প্রান্তিক মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে সরকারিভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয় ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র। বিশেষ করে গর্ভবতী নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে এখানে জ্বর, সর্দি, কাশি, চর্মরোগসহ মা ও শিশুস্বাস্থ্য সেবার ৩০ তেকে ৩২ ধরনের ওষুধ দেয়ার কথা। কিন্তু এসব কেন্দ্রে ওষুধ সরবরাহ অপ্রতুল হওয়ায় সেবা নিতে আসা রোগীদের যেতে হচ্ছে শহরের বিভিন্ন প্রাইভেট ক্লিনিক ও হাসপাতালে। এতে ভোগান্তির পাশাপাশি বাড়ছে ব্যয়।

একটি সূত্রে প্রকাশ ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে দীর্ঘ ১৪ মাস এসব এফডবিলউসিতে ওষুধ সরবরাহ বন্ধই ছিল।

পাতিবিলা ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে সেবা নিতে আসা মুক্তদাহ গ্রামের সোনিয়া খাতুন বলেন, ‘আমার দেড় বছরের শিশু আবু হানিফকে নিয়ে এখানে এসেছি। ছেলেটির কয়েকদিন ধরে জ্বর-সর্দি-কাঁশিতে ভুগছে। এখানকার ডাক্তার ঔষধ লিখে দিয়েছেন, তবে কোনো ওষধ দেননি। বলেছেন এখানে কোনো ওষধ নেই। মাস দুয়েক আগেও একবার আসছিলাম। তখনও ওষধ পাইনি।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। টাকা-পয়সা খরচ ছাড়া ডাক্তার দেখানোসহ বিনামূল্যে ওষুধ পাওয়া যায় বলেই এখানে আসি। এখন এখানে ওষধ না পাওয়ায় বাইরে থেকে কিনতে হয়।’

একই গ্রামের গৃহবধূ মৌসুমি আক্তার (৩২) ঠাণ্ডা-জ্বরে আক্রান্ত তার দু’বছরের মেয়ে সুমাইয়া আক্তারকে নিয়ে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘তিনমাস আগেও এবকার এসেছিলাম আমার জ্বর নিয়ে তখনও ওষুধ পাইনি। এবার আমার মেয়ে অসুস্থ শুধুমাত্র ওষধ লিখে দিয়েছে। কোনো ওষুধ দেয়নি। বলছেন, কোনো ওষুধ সরবরাহ নেই। শহরে গিয়ে ক্লিনিক বা হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়া খুবই ভোগান্তির এবং ব্যয়বহুল। আমার স্বামী একজন দিনমজুর। তাই টাকার অভাবে এখন আমরা চিকিৎসাসেবা ঠিকভাবে পাচ্ছি না।’

এ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে রয়েছে জনবল সংকটও। এখানে ফার্মাসিস্ট নেই। পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা (এফডব্লিউভি) ও একজন এমএলএসএস। উপ-সহকারি কমিউনিটি মেডিক্যাল অফিসার বা স্যাকমো পদে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে একজনের পদ থাকলেও নেই। এ কেন্দ্রটিতে বিদ্যমান পদগুলোতে কেউ আসেননি। এখন পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা সামীমা ইয়াচমিন একাই সামলান চিকিৎসা সেবা। তিনিই অফিসসহ অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন সুখপুকুরিয়া স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে এবং জগদিশপুর স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে। এ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে ১২টি পদের মধ্যে খাতা কলমে কর্মরত পাঁচজন। তাও তারা ঠিকমত অফিস করেন না।

তিনি বলেন, ‘আমাকেই সব সামলাতে হয়। ওষুধ সরবরাহ গত ১৪ মাস ধরে বন্ধ ছিল। তাই এখন রোগীদের চাপ কম। তবে গত একমাসে স্বাভাবিক কিছু চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।’

এ ছাড়াও উপজেলার হাকিমপুর, ফুলসারা, পাশাপোল, ধুলিয়ানী, জগদিশপুর, নারায়নপুর, স্বরুপদাহ ও সুখপুকুরিয়া ইউনিয়নসহ সবক’টি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রেও ওষুধ সংকটের পাশাপাশি রয়েছে জনবল সংকট। সবখানে উপ-সহকারি মেডিক্যাল অফিসারের পদটি দীর্ঘদিন খালি।

হাকিমপুর স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসা নিতে আসা শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘কয়েকদনি ধরে জ্বর আর চুলকানি। ডাক্তার দেখাতে আসছি। কিন্তু এখানে আজ স্বাস্থ্য কেন্দ্রেটি তালা বদ্ধ রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানলাম তিনি আজ অন্য স্বাস্থ্য কেন্দ্রে গেছেন। আজ আর আসবেন না। এখন শহরের অন্য কোনো হাসপাতালে যেতে হবে।’

স্বরুপদাহ পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা নাসিমা বেগম বলেন, ‘আমরা আগে প্রায় ২৪ থেকে ২৫ রকমের ওষুধ পেতাম। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ওষধের সাপ্লাই না থাকায় এখন আর রোগীদের দিতে পারছি না। তাই রোগী তেমন একটা আসে না। আগে প্রতিদিন প্রায় অর্ধশত রোগী এলেও বর্তমানে আসে আট থেকে ১০ জন রোগী। চাহিদামত ওষুধ না থাকায় রোগীদের শুধু পরামর্শ দিয়ে বিদায় করতে হচ্ছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘জনবল চরম সংকট থাকায় আমাকে স্বরুপদাহসহ ধুলিয়ানী ও হাকিমপুর স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রেও দায়িত্ব পালন করতে হয়।’

পরিবার পরিকল্পনা দফতর সূত্রে জানা যায়, শুধু ওষুধ সংকট নয়, জনবল সংকটেও ভুগছে স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলো। উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে স্যাকমো পদে এক জনও নেই। ফার্মাসিস্ট পদে ১১টি পদ খালি। পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকার ১২ পদের মধ্যে সাতটি পদ খালি, পরিবার কল্যাণ সহকারির ৪৩ পদে ১২টি পদ র্দীঘদিন খালি।

এ ব্যাপারে উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মিথুনুর রহমান বলেন, ‘উপজেলার সব ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রগুলোতে জনবল ও ওষুধ সংকট রয়েছে। তাই জনবল ও ওষুধ সংকটে সেবা কিছুটা ব্যাহত হলেও অচিরেই তা কেটে যাবে।’