প্রেম ও দ্রোহের কবি আল মাহমুদ

বাংলা সাহিত্যের দীর্ঘ ইতিহাসে যারা পথপ্রদর্শক হয়ে আছেন, আল মাহমুদ তাদেরই একজন। তিনি শুধু একজন কবি নন, তিনি ছিলেন এক প্রবল সাহিত্যস্রষ্টা, যিনি কাব্য, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, আত্মজীবনী, একই সাথে ভ্রমণ সাহিত্যেও বিচরণ করেছেন সমানতালে।

মিজান ফারাবী
কবি আল মাহমুদ
কবি আল মাহমুদ |ইন্টারনেট

আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম কণ্ঠস্বর, প্রেম ও দ্রোহের কবি আল মাহমুদ। প্রকৃতি ও প্রার্থনার কবির আজ শুক্রবার (১১ জুলাই) ৯০তম জন্মদিন। ১৯৩৬ সালের এই দিনে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার মোড়াইল গ্রামে এক ব্যবসায়ী পরিবারে দুনিয়ার আলো দেখেন তিনি।

কবির শৈশব কেটেছে নদীমাতৃক ভাটি বাংলার প্রকৃতির কোলে। এই ভূ-প্রকৃতি, এই পরিবেশ পরবর্তীতে তার সাহিত্যে প্রভাব ফেলেছে গভীরভাবে। গ্রামবাংলার চিত্র, নদী, চর, কৃষকজীবন, প্রেম, ধর্মীয় চেতনা এসবকিছু তার কবিতা ও গদ্যের উপজীব্য, বাঁক বদলের মতো বারবার ফিরে এসেছে তার লেখায়, কবিতায়।

বাংলা সাহিত্যের দীর্ঘ ইতিহাসে যারা পথপ্রদর্শক হয়ে আছেন, আল মাহমুদ তাদেরই একজন। তিনি শুধু একজন কবি নন, তিনি ছিলেন এক প্রবল সাহিত্যস্রষ্টা, যিনি কাব্য, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, আত্মজীবনী, একই সাথে ভ্রমণ সাহিত্যেও বিচরণ করেছেন সমানতালে।

আল মাহমুদ

কবিতায় ‘সোনালী কাবিন’ ও তার কাব্যভাষা

আল মাহমুদকে বাংলা সাহিত্যের পাঠক সর্বাধিক মনে রাখে তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘সোনালী কাবিন’ এর জন্য। ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত এই গ্রন্থে তিনি আধুনিক কাব্যভাষায় গ্রামীণ জীবন, প্রেম, সমাজবাস্তবতা, ইসলামী ভাবধারা এবং লোকজ উপাদান নিয়ে এক অপূর্ব কাব্যিক চিত্র এঁকেছেন। এটি বাংলা কবিতায় এক যুগান্তকারী সৃষ্টি বলে বিবেচিত হয়। আজও পাঠকরা বুঁদ হয়ে থাকে সসোনালী কাবিনের পাতায়।

তার কবিতায় আধুনিকতা এসেছে নিজস্বতায়। তিনি সাহসের সাথে আঞ্চলিক শব্দ, লোকজ উপমা ও বিশ্বাস ব্যবহার করেছেন। এতে তার কবিতা হয়ে উঠেছে জনমানুষের ভাষ্য। অভিন্ন দৃষ্টিতে জীবনকে দেখেছেন কবিতার ভেতর। আর কবিতাকে করে তুলেছেন জীবনের ভাষ্য। কবিতার পাশাপাশি গল্পকে সঙ্গী করে হেঁটেছেন দীর্ঘপথ। এর পরেই শুরু হয়েছে উপন্যাসের প্রবাহ। উপন্যাসেও ছিল গ্রামীণ জীবন আর বৈচিত্রের সম্ভার।

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এই কবি গ্রামীণ পথে হেঁটেছেন ভাটি বাংলার জনজীবন আর তিতাসের আবহ নিয়ে চরাঞ্চলের জনপদ, নর ও নারীর প্রেম-বিরহকে করেছেন তার কবিতা, গল্প-উপন্যাসের একমাত্র উপজীব্য। আধুনিক বাংলা ভাষার প্রচলিত রীতির বাহিরে এসে স্বাচ্ছন্দ্যে করে গেছেন আঞ্চলিক শব্দের প্রয়োগ।

সোনালী কাবিন কাব্যগ্রন্থ

কবির কালজয়ী সৃষ্টি সম্ভার

কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনি, আত্মজীবনীসহ পদচারণায় মুখোরিত করেছেন আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এই অঙ্গনকে। কবির উল্লেখযোগ্য সাহিত্য সম্ভারে রয়েছে-

সোনালী কাবিন, লোক লোকান্তর, কালের কলস, মায়াবী পর্দা দুলে উঠো, বখতিয়ারের ঘোড়া, একচক্ষু হরিণ, উড়ালকাব্য। কাবিলের বোন, উপমহাদেশ, ডাহুকি, আগুনের মেয়ে, পানকৌড়ির রক্ত, ত্রিশিরা ও দিনযাপন ইত্যাদি তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। এছাড়াও জীবনের গল্প বলতে লিখেছেন, কবির মুখ ও ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’ নামে আত্মজীবনী মূলকগ্রন্থ।

আল মাহমুদের গল্প ও উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তার লেখায় উঠে এসেছে চরাঞ্চলের মানুষ, প্রেম-সংসার, গ্রামীণ কুসংস্কার ও ধর্মীয় মূল্যবোধ। তার গদ্যভাষাও ছিল কাব্যিক, সাবলীল।

আল মাহমুদ সাহিত্যজীবনের শেষদিকে আত্মজীবনীমূলক রচনা ও প্রবন্ধ লেখার দিকে মনোযোগ দেন। তার আত্মজীবনীতে ধরা পড়ে এক সাহিত্যমনস্ক, সংগ্রামী ও তীব্র আত্মসচেতন মানুষের মুখচ্ছবি। যা পাঠকের চিন্তায় নতুন মাত্রা যোগ করে।

আল মাহমুদ ছিলেন বাংলা সাহিত্যের এক নিজস্ব জগৎ। তিনি গ্রামবাংলাকে তুলে এনেছেন কবিতার পাতায়, যেমনটি জীবনানন্দ তুলে এনেছিলেন নিসর্গ। কবিতায় ছিল প্রেম, মাটি ও সংগ্রামী জীবনের ছাপ। কলমে উচ্চারিত হয়েছে এক জাতির স্বর, তুলে এনেছেন প্রান্তিক মানুষের হৃদয়ের ভাষা।

আল মাহমুদ

লোকলোকান্তরে কবি আল মাহমুদ

লোকলোকান্তরের এই কবি সাহিত্যের ষোলকলা পূর্ণ করে ২০১৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি লোকান্তরের পথে হারিয়ে যান। মৃত্যুকালে কবির বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। আর ১৭ বছর বাঁচলে হয়তো শতবর্ষের, মহাকালের সাক্ষী হতেন তিনি। কিন্তু আলোর প্রদীপ নিভে থেমে গেল কবিতার পথচলা।

তার রচনাসমগ্র, কলমের সুর আজও বাংলা সাহিত্যে দ্যুতিময় হয়ে আছে। সাহিত্যপ্রেমীরা কবিতার পঙক্তিতে, পরতে পরতে খুঁজে পান হৃদয়ের কথা, গ্রাম বাংলার কথা।

কবি আল মাহমুদ তরুণ বয়সেই কলম হাতে তুলে নেন। প্রথম দিকে স্থানীয় পত্র-পত্রিকায় লেখালেখির যাত্রা শুরু করলেও পরবর্তীতে তার কবিতা জায়গা করে নেয় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে। ঢাকায় চলে আসার পর তার সাহিত্যজগৎ মোড় নেয় নতুন দিগন্তে। বর্ণাঢ্য জীবনে সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত হয়ে দৈনিক গণকণ্ঠের সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন কবি আল মাহমুদ।

তিনি চলে গেলেও রেখে গেছেন এক অনন্য সাহিত্যভান্ডার, যা বাংলা ভাষাকে করেছে আরো ঋদ্ধ, আরো সমৃদ্ধ। তার কবিতা অমর সৃষ্টি এখনো প্রাসঙ্গিক, এখনো জেগে আছে পাঠকদের মনে। আজ দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে বাংলা সাহিত্যের এই কালজয়ী কবির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। সোনালী কাবিনের এই স্রষ্টা লোকলোকান্তরে পাড়ি জমালেও তার কবিতা এখনো বাজে পাঠকের অন্তরে।

আল মাহমুদ

পুরস্কার ও সম্মাননা

আল মাহমুদের সাহিত্যকর্ম স্বীকৃতি পেয়েছে বহু পুরস্কারে। কলম ও কালির সখ্যতায় কবিতার পঙতিমিলা বা উপন্যাসের বিষয় বৈচিত্র্য ছুঁয়ে গেছে পাঠকের হৃদয়। সাহিত্যকর্মে স্বীকৃতি মিলেছে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার, শিশু একাডেমি (অগ্রণী ব্যাংক) পুরস্কার, নাছির উদ্দিন স্বর্ণ পদক, কলকাতার ভানু সিংহ পদকসহ নানান সম্মাননা।