২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতা এই মুসলিম নারী

ফাতিমা আল-ফিহরি ‘উম্মুল বানিন’ নামে পরিচিত ছিলেন। - ছবি : সংগৃহীত

ফাতিমা আল-ফিহরি বিশ্বনন্দিত একজন মুসলিম নারী। যিনি বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। আজ থেকে প্রায় সাড়ে এগারো শ’ বছর আগে ৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে মরক্কোর ফেজ শহরের কারাউইন ইউনিভার্সিটিটি তার হাতেই গড়ে ওঠে। ইউনেস্কো এবং গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ডের রেকর্ড অনুযায়ী এটিই হচ্ছে বিশ্বের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় এবং ডিগ্রী প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান, যা এখন পর্যন্ত একটানা চালু আছে।

মহীয়সী এই মুসলিম নারী আনুমানিক ৮০০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে বর্তমানকালের তিউনিসিয়ার কাইরাওয়ান শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মোহাম্মদ আল-ফিহরি আল-কুরাইশি। তাদের পারিবারিক নামের কুরাইশি অংশ থেকে ধারণা করা হয়, তারা ছিলেন কুরাইশ বংশের উত্তরাধিকারী।

ফাতিমা আল-ফিহরির আরেকটি বোন ছিল, তার নাম মারইয়াম আল-ফিহরি; শৈশব থেকে তারা দুজনেই পড়াশোনার প্রতি বেশ আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু আর্থিক অনটনের কারণে তাদের নিয়ে জন্মভূমিতে স্থায়ী হতে পারেন নি তাদের বাবা মোহাম্মদ আল-ফিহরি। ভাগ্যের অন্বেষণে কাইরাওয়ানের আরো বেশ কয়েকটি পরিবারের সাথে তিনিও সপরিবারে পাড়ি জমান ইসলামিক মাগরিব তথা মরক্কোর প্রসিদ্ধ শহর ফেজের উদ্দেশে। ফেজ ছিল তখন ক্রমবর্ধমান কসমোপলিটন বা বহু মতাদর্শের মানুষের শহর। নানা দেশ থেকে নানা ধর্ম, বর্ণ ও পেশার মানুষ সেখানে এসে বসতি স্থাপন করছিল। কাইরাওয়ান থেকে সমাগত অভিবাসীরা ফেজে এসে নতুন পরিচয় পায় কারাউইন বা কাইরাওয়ানের অধিবাসী নামে।

ফেজে এসে মোহাম্মদ আল-ফিহরির ভাগ্য খুলে যায়। প্রচণ্ড পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি নিজেকে একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। তার সন্তানদের জন্য সুশিক্ষার ব্যবস্থা করেন। ফাতিমা আল-ফিহরি এবং তার বোন মারইয়াম আল-ফিহরি আরবি ভাষা, ইসলামিক ফিকহ (আইন শাস্ত্র) এবং হাদিস শাস্ত্রের ওপর পড়াশোনা করেন। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর এই ফেজেই এক যুবকের সাথে ফাতিমার বিয়ে হয়। কিন্তু বিয়ের কয়েক বছরের মাথায়ই ফাতিমাদের পরিবারে ‘মহাদুর্যোগ’ নেমে আসে। অল্প সময়ের মধ্যেই তার বাবা, ভাই এবং স্বামী মৃত্যুবরণ করেন। রয়ে যান কেবল এতিম দুই বোন ফাতিমা এবং মারইয়াম। বাবার রেখে যাওয়া বিপুল পরিমাণ সম্পত্তির উত্তরাধিকার হন তারা।

দুই বোন বিলাসিতার পেছনে সম্পদ নষ্ট না করে তা ধর্ম ও মানবতার কল্যাণে ব্যয় করার সিদ্ধান্ত নেন। প্রথমে তারা ফেজে পৃথক দু’টি মসজিদ নির্মাণ করেন। মারইয়াম নির্মাণ করেন আন্দালুস মসজিদ, আর ফাতিমা নির্মাণ করেন কারাউইন মসজিদ।

এ সম্পর্কে ঐতিহাসিক ইবনে আবি জারার বিবরণ থেকে জানা যায়, ফাতিমা ৮৫৯ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরের ৩ তারিখে মসজিদ নির্মাণের কাজ শুরু করেন। সেটা ছিল পবিত্র রমজান মাস। তিনি শুধু মসজিদ নির্মাণের জন্য অর্থ দান করেই নিজের দায়িত্ব শেষ করেননি, নিজে সার্বক্ষণিকভাবে উপস্থিত থেকে এর নির্মাণকাজ তদারকি করেছেন। এবং প্রথম দিন থেকে শুরু করে নির্মাণ শেষ হওয়া পর্যন্ত প্রতিটি দিন তিনি রোজা রেখেছেন। নির্মাণকাজ শেষ হলে মসজিদের ভেতরে প্রবেশ করে নামাজ আদায় করেন ফাতিমা এবং আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। জন্মভূমি কাইরাওয়ানের নামানুসারে তিনি মসজিদটির নাম রাখেন কারাউইন মসজিদ।

মসজিদ নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পর ফাতিমা মসজিদের বর্ধিতাংশে একটি মাদরাসা নির্মাণ করেন। অল্পদিনের মধ্যেই সেখানে ইসলামী শিক্ষার পাশাপাশি ব্যাকরণ, গণিত, চিকিৎসাশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা, ইতিহাস, রসায়ন, ভূগোলসহ বিভিন্ন বিষয়ে পাঠদান শুরু হয়। বৈচিত্র্যময় বিষয়ের ওপর আনুষ্ঠানিক শিক্ষার জন্য ডিগ্রী প্রদানের প্রচলনও চালু হয়। এভাবেই মসজিদ থেকে বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের গোড়াপত্তনের ইতিহাস রচিত হয়। ফাতিমা আল-ফিহরি ইন্তেকাল করেন ৮৮০ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু তার প্রতিষ্ঠিত কারাউইন মসজিদ, ইউনিভার্সিটি এবং লাইব্রেরি আজও দাঁড়িয়ে আছে সগৌরবে এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী এগুলো মানব সম্প্রদায়কে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করে চলছে অবিরাম।

সূত্র: আল জাজিরা ডকুমেন্টারি


আরো সংবাদ



premium cement