গাজায় হামলার প্রতিবাদে সমাবর্তন বর্জন ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ১২ মে ২০২৪, ১১:৫৪
যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া কমনওয়েলথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী তাদের সমাবর্তন অনুষ্ঠান বর্জন করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে গাজায় ইসরাইলি হামলার প্রতিবাদে চলমান বিক্ষোভের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া ব্যক্তিকে সমাবর্তনে বক্তা করায় শিক্ষার্থীরা ওই অনুষ্ঠান বর্জন করে।
ওই বক্তা এর আগে শিক্ষার্থীদের চলমান বিক্ষোভ নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করেছিলেন।
শনিবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন পোস্টে দেখা গেছে, ভার্জিনিয়া কমনওয়েলথ বিশ্বববিদ্যালয়ের (ভিসিইউ) শিক্ষার্থীরা গাউন ও টুপি পরা অবস্থায় সমাবর্তন অনুষ্ঠানের কক্ষ থেকে বের হয়ে যাচ্ছে।
রিপাবলিকান গভর্নর গ্লেন ইয়ংকিন তখন সমাবর্তন অনুষ্ঠানের স্বাগত বক্তব্য দিচ্ছিলেন।
মূলত ইয়ংকিনকে সমাবর্তনের বক্তা করার বিষয়টি শিক্ষার্থীদের অনেকেই মেনে নিতে পারেনি। কারণ তিনি গাজায় ইসরাইলি হামলার প্রতিবাদে শিক্ষার্থীদের ডাকা প্রতিবাদ কর্মসূচির অনুমতি দেয়া উচিৎ নয় বলে মন্তব্য করেছিলেন।
এছাড়া ভার্জিনিয়া কমনওয়েলথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যখন বর্ণবাদবিষয়ক একটি পাঠ্যক্রম চালু করার কথা ভাবছিল, তখন সেটির বিরোধিতা করার কারণেওইয়ংকিন সমালোচিত হয়েছিলেন।
অনলাইনে পোস্ট করা ভিডিওতে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদেরকে স্লোগান দিতে দেখা গেছে, যেখানে তারা বলছে যে ‘প্রকাশ কর, সরে যাও। আমরা থামব না, আমরা বিশ্রাম নেব না।’
ভার্জিনিয়া কমনওয়েলথ বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব শিক্ষার্থীরা সমাবর্তন বর্জন করেছেন, তাদের একজন হচ্ছেন শিরিন হাদাদ।
শনিবার তিনি বলেন, সমাবর্তনের স্বাগত বক্তব্য শুরু করার পর বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা এত জোরে তালি বাজাতে শুরু করে যে অন্যরা ইয়ংকিনের কোনো কথাই শুনতে পাচ্ছিলেন না।
এরপর অন্তত ১৫০ জন শিক্ষার্থী এক সাথে সমাবর্তন কক্ষ থেকে বের হয়ে যায় বলেও জানান হাদাদ।
তাতে অবশ্য ইয়ংকিন তার স্বাগত বক্তব্য থামাননি। অনুষ্ঠান শেষে তিনি সমাবর্তনে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীদের অভিনন্দন জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্টও দিয়েছেন।
তবে শিক্ষার্থীরা যেভাবে সমাবর্তন অনুষ্ঠান বর্জন করেছেন, সে বিষয়ে তাকে কোনো প্রতিক্রিয়া জানাতে দেখা যায়নি।
গাজায় ইসরাইলি হামলার প্রতিবাদে গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে বিক্ষোভ ও সমাবেশ করে আসছে শিক্ষার্থীরা।
ইসরাইলের সাথে থাকা আর্থিক সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবিও জানিয়েছে তারা।
গত এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে শুরু হওয়া এই বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী গ্রেফতার হয়েছে।
এর মধ্যে গত ২৯ এপ্রিল ভার্জিনিয়া কমনওয়েলথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে ১৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়, যাদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়েরই অন্তত ছয় শিক্ষার্থী রয়েছে।
হিমশিম খাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো
গাজা যুদ্ধের প্রতিবাদে শুরু হওয়া শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া ও ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছে।
ক্রমবর্ধমান এই বিক্ষোভ সামাল দিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্মকর্তারা রীতিমত হিমশিম খাচ্ছেন।
গত শুক্রবার ভোরে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি) কর্তৃপক্ষ ক্যাম্পাসে পুলিশ ডেকে বিক্ষোভকারীদের তাঁবু তুলে দিয়েছে বলে বার্তাসংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে।
তখন বেশ কিছু শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে।
বিক্ষোভকারীদের তাঁবু তুলে দেয়ার আগে চলতি সপ্তাহের শুরু থেকে বিক্ষোভকারী বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করে এমআইটি কর্তৃপক্ষ।
তারা শিক্ষা কার্যক্রম ও স্নাতক সমাপনী অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারবে না বলে জানানো হয়েছে।
তবে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা বলছে, ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর সাথে এমআইটির সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবিতে তারা অনড়।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের আরেক নামী প্রতিষ্ঠান হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে যে, বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা হিসেবে তারা সাময়িক বহিষ্কার শুরু করেছে।
বিক্ষোভ থামাতে কয়েকদিন আগে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
মার্কিন বার্তাসংস্থা এপির হিসাবে, বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ৫৭টি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ থেকে প্রায় দুই হাজার ৯০০ শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়েছে।
অন্যদিকে ইহুদিবিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ার ভয়ে ক্যাম্পাসে সশরীরে ক্লাস নেয়া বন্ধ রাখার মতো সিদ্ধান্তও নিতে দেখা যাচ্ছে।
ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলেসহ অন্যান্য কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও বিক্ষোভ-প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়েছে।
এদিকে বিক্ষোভ বন্ধ করে ক্যাম্পাসকে শান্ত রাখার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তাদের ওপর দিন দিন চাপ বাড়ছে বলে জানা গেছে।
গত বছরের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর ইসরাইল-গাজা যুদ্ধ শুরু হয়। এরপর থেকেই যুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষে বিক্ষোভ এবং তর্ক-বিতর্কের চর্চা বাড়তে থাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে।
উভয়পক্ষের শিক্ষার্থীরাই দাবি করেছে, সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ইহুদি-বিদ্বেষ এবং ইসলামভীতি দু’টিই বেড়েছে।
বিক্ষোভ সামাল দিতে সম্প্রতি নিউইয়র্ক সিটি পুলিশকে ক্যাম্পাসে ঢোকার অনুমতি দেয় কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
সেখানে গিয়ে বিক্ষোভকারী বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে পুলিশ গ্রেফতার করে, যা সারাবিশ্বেই বেশ আলোচিত হয়।
অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের গ্রেফতারের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরো কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে।
পরিস্থিতি সামাল দিতে এপ্রিলের শেষের দিকে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভকারী প্রায় ৫০ জন শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বিশ্ববিদ্যালয়টির কয়েক শ’ শিক্ষার্থী গত কয়েক দিন ধরেই ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ চালিয়ে আসছে।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ক্যাম্পাসকে শান্ত রাখার জন্য বিক্ষোভকারীদের ‘একাধিকবার অনুরোধ’ জানালেও তারা সেটি উপেক্ষা করে। সে কারণে অনেকটা বাধ্য হয়েই তারা পুলিশে খবর দিয়েছে।
অন্যদিকে বিক্ষোভকারীদের অনেকেই সামরিক অস্ত্র তৈরি খাতে বিনিয়োগ কমানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
বিক্ষোভ দমনে অনেক ক্যাম্পাসে পুলিশের অবস্থানও চোখে পড়ছে
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরো যেসব বিশ্ববিদ্যোলয়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে: ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, ইউনিভার্সিটি অব মিশিগান, ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি এবং এমারসন কলেজ।
কলম্বিয়ার প্রায় ১২ কিলোমিটার দক্ষিণে নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছে।
অন্যান্য কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরাও ইসরাইলি অস্ত্র সরবরাহকারী কোম্পানিগুলো থেকে বিনিয়োগ সরিয়ে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
অবশ্য এসব বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে ইহুদি-বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগও রয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত একটি ভিডিও পোস্টে বেশ কয়েকজন বিক্ষোভকারীকে ইসরাইলে হামাসের আক্রমণের প্রতি সমর্থন জানাতেও দেখা গেছে।
যদিও ইহুদি-বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগ অস্বীকার করেছে বিক্ষোভকারীরা। তারা বলছে, তাদের প্রতিবাদ ও সমালোচনা কেবল ইসরাইল রাষ্ট্রের কার্যক্রমের বিরুদ্ধে।
এদিকে এপ্রিলে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আপাতত তাদের সব ক্লাস অনলাইনে চলবে।
’ভীতিকর ও হয়রানিমূলক আচরণ’ এড়ানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে এক বিবৃতিতে জানান কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট মিনোচে শফিক।
যেসব শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় থাকে না, তাদেরকে ক্যাম্পাসের বাইরে থাকার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়টির সাথে সম্পৃক্ত একজন ইহুদি ধর্মযাজকও কলম্বিয়ার তিন শ’ ইহুদি শিক্ষার্থীর কাছে একটি বার্তা পাঠিয়েছেন, যাতে পরিস্থিতির ‘উন্নতি’ না হওয়া পর্যন্ত ক্যাম্পাস না আসার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে।
এছাড়া প্রকাশিত বিবৃতিতে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট ড. শফিক বলেন, ‘ক্যাম্পাসকে অশান্ত করার জন্যই কলাম্বিয়ার সাথে সম্পৃক্ত নয় এমন একদল ব্যক্তি বিক্ষোভ ছড়িয়ে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করতে ক্যাম্পাসে অবস্থান নিয়েছেন। এই সঙ্কট সমাধানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন একটি কমিটি গঠন করেছে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য কর্মকর্তাদের সাথে নিয়ে ড. শফিক গত সপ্তাহে ক্যাপিটল হিলে গিয়েছিলেন। সেখানে মার্কিন সরকারের একটি কমিটির সামনে তারা সাক্ষ্য দিয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইহুদি-বিদ্বেষ মোকাবেলার পাশাপাশি উদ্ভূত সমস্যার সমাধানের জন্য তাদের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে।
নিউইয়র্কের রিপাবলিকান প্রতিনিধি এলিস স্টেফানিকের নেতৃত্বে ফেডারেল আইনপ্রণেতাদের একটি দল সোমবার একটি চিঠিতে স্বাক্ষর করেছে, যেখানে ড. শফিককে পদত্যাগ করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
ওই চিঠিতে স্টেফানিক বলেন, ‘ইহুদি-বিদ্বেষ ছড়ানোর বিক্ষোভ আন্দোলন থামাতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ব্যর্থ হয়েছে।’
অন্যদিকে, বিক্ষোভ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার পেছনে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষেরও দায় রয়েছে বলে মনে করছেন বেশ কয়েকজন শিক্ষক।
তারা মনে করেন, শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিক্ষোভ না থামিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পুলিশ ডাকা ঠিক হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভের পাশাপাশি গাজা যুদ্ধ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অনেক জায়গাতেই ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে।
ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভকারীরা সম্প্রতি শিকাগোতে বিক্ষোভ করেছেন।
এছাড়া সান ফ্রান্সিসকোর গোল্ডেন গেট ব্রিজ এবং নিউইয়র্কের ব্রুকলিন ব্রিজসহ আরো অনেক স্থানে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে দেখা গেছে।
সূত্র : বিবিসি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা