রিয়েল এস্টেট টাইকুন থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট : যে পথ পাড়ি দেন ট্রাম্প

মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদের জন্য প্রার্থী হিসেবে দৌড়ে শামিল হওয়ার আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ বিলিয়নিয়ার। নিউইয়র্কের এই রিয়েল এস্টেট টাইকুনের বর্ণাঢ্য জীবন কয়েক দশক ধরেই বিভিন্ন ট্যাবলয়েডের পাতায় এবং টেলিভিশনের পর্দায় ফুটে উঠেছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরিচিতি এবং ‘অপরিশোধিত’ নির্বাচনী প্রচারশৈলী তাকে অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদদের ভোটে হারিয়ে দিতে সাহায্য করেছিল। তবে প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার কার্যকালে বিতর্কও কম হয়নি। মাত্র একদফাই ক্ষমতায় ছিলেন তিনি।

৭৮ বছরের এই রিপাবলিকান আবারো সকল ‘প্রতিকূলতা’ উপেক্ষা করে ‘অত্যাশ্চর্য’ রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তন ঘটাতে চাইছেন যা তাকে ওভাল অফিসের প্রেসিডেন্টের ডেস্কে ফিরিয়েও নিয়ে যেতে পারে।

উত্তরাধিকার
ডোনাল্ড ট্রাম্প নিউইয়র্কের রিয়েল এস্টেট টাইকুন ফ্রেড ট্রাম্পের চতুর্থ সন্তান।

ট্রাম্প পরিবারের কাছে বিপুল পরিমাণে সম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও তিনি তার বাবারই মালিকানাধীন সংস্থায় কোনো একটা ছোটখাটো কাজ করবেন বলে একসময় অনুমান করা হয়েছিল।

স্কুলে খারাপ আচরণ শুরু করায় ১৩ বছর বয়সে তাকে ‘নিউইয়র্ক মিলিটারি অ্যাকাডেমি’তে পাঠানো হয়েছিল। পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়ার্টন স্কুল থেকে ডিগ্রি অর্জন করেন ট্রাম্প।

একসময় ভাগ্য সহায় হয় ডোনাল্ড ট্রাম্পের। তার বড় ভাই ফ্রেড ট্রাম্প জুনিয়র পাইলট হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে বাবার অনুগ্রহে পারিবারিক ব্যবসায় যোগ দেয়ার সুযোগ পান তিনি (ডোনাল্ড ট্রাম্প)।

ডিগ্রি অর্জনের পরই রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় মনোনিবেশ করেন তিনি। ট্রাম্প অবশ্য দাবি করেছেন, রিয়েল এস্টেট ব্যবসা দাঁড় করানোর জন্য বাবার কাছ থেকে ‘সামান্য’ পরিমাণে ঋণ নিতে হয়েছিল তাকে। এই ঋণের পরিমাণ ছিল ১০ লাখ ডলার।

বাবার মালিকানাধীন বিস্তৃত ব্যবসাগুলোর মধ্যে নিউইয়র্ক সিটি বোরো এলাকায় আবাসিক প্রকল্পে সাহায্য করতেন ট্রাম্প। ১৯৭১ সালে এই সংস্থার প্রেসিডেন্ট বানানো হয় তাকে। কোম্পানির পরিবর্তন করে রাখেন ‘ট্রাম্প অর্গানাইজেশন’।

বাবা ফ্রেড ট্রাম্পকে নিজের ‘অনুপ্রেরণা’ বলে বর্ণনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট। ১৯৯৯ সালে তাকে হারান ডোনাল্ড ট্রাম্প।

মাদকাসক্তির কারণে ফ্রেড ট্রাম্পের মৃত্যু হয় ৪৩ বছর বয়সে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরিবারের সদস্যরা জানায়, এই কারণেই সারাজীবন মদ এবং সিগারেট এড়িয়ে চলেছেন তিনি (ডোনাল্ড ট্রাম্প)।

ব্র্যান্ড
ডোনাল্ড ট্রাম্পের অধীনে তাদের পারিবারিক ব্যবসার ফোকাস ব্রুকলিন ও কুইন্সের আবাসিক প্রকল্পের বদলে চলে যায় চাকচিক্যময় ‘ম্যানহাটন প্রকল্প’ বাস্তবায়নের দিকে।

বিখ্যাত ফিফথ অ্যাভিনিউতেই অবস্থিত ট্রাম্প টাওয়ার, যা ডোনাল্ড ট্রাম্পের সবচেয়ে সুপরিচিত সম্পত্তির মধ্যে একটি। বহু বছর ধরেই এটাই ট্রাম্পের বাসস্থল। তার নেতৃত্বে ‘কমোডোর হোটেল’কে পুনর্নির্মাণ করে ‘গ্র্যান্ড হায়াত’-এ রূপান্তরিত করা হয়। এই প্রকল্প তাকে পরিচিতি এনে দেয়।

ট্রাম্পের ব্র্যান্ডের অন্তর্ভুক্ত ক্যাসিনো, কনডমিনিয়াম বা কন্ডো (আবাসিক প্রকল্প যেখানে পৃথক মালিকানাধীন আবাসিক ইউনিট রয়েছে) গলফ কোর্স ও হোটেল রয়েছে আটলান্টিক সিটি, শিকাগো ও লাস ভেগাস থেকে শুরু করে ভারত, তুরস্ক ও ফিলিপাইনে।

বিনোদন জগতেও তিনি একজন বহুল পরিচিত ব্যক্তিত্ব। বিনোদন জগতে তার খ্যাতি তৈরি হয় প্রথমে মিস ইউনিভার্স, মিস ইউএসএ এবং মিস টিন ইউএসএ সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার আয়োজক সংস্থার মালিক হিসেবে এবং তারপর এনবিসি রিয়েলিটি শো ‘দ্য অ্যাপ্রেন্টিস’-এর স্রষ্টা হিসেবে।

‘দ্য অ্যাপ্রেন্টিস’-এর ১৪টি সিজনে প্রতিযোগীরা তার বিশাল ব্যবসায় একটা চুক্তি পাওয়ার জন্য লড়াই করতেন। এই অনুষ্ঠানের হাত ধরে তিনি টেলিভিশন পর্দার একজন পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন। তার মুখে ‘ইউ আর ফায়ারড’ সংলাপ খুবই জনপ্রিয় হয়ে যায়।

ট্রাম্প বেশ কয়েকটা বই লিখেছেন। বিভিন্ন চলচ্চিত্র এবং প্রো-রেসলিং অনুষ্ঠানে পানীয় থেকে নেকটাইসহ অনেক কিছুই ‘বিক্রি’ করেছেন। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তার মোট সম্পদের পরিমাণ কমে গেছে। ফোর্বসের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে তার সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৪০০ কোটি ডলার।

ট্রাম্প ছয়বার ব্যবসায় দেউলিয়া হয়েছেন বলে দাবি করেছেন। ট্রাম্প স্টিকস এবং ট্রাম্প বিশ্ববিদ্যালয়সহ তার বেশ কয়েকটা উদ্যোগ বন্ধ হয়ে গেছে।

তিনি তার আয়কর-সংক্রান্ত তথ্য পরীক্ষা হওয়ার হাত থেকে থেকে আড়াল করেছেন। ২০২০ সালে ‘দ্য নিউইয়র্ক টাইমস’-এর প্রতিবেদনে তার বিরুদ্ধে বছরের পর বছর আয়কর এড়ানোর অভিযোগ এবং দীর্ঘস্থায়ী আর্থিক ক্ষতির বিষয়ে তথ্য প্রকাশিত হয়েছিল।

পারিবারিক জীবন
ট্রাম্পের ব্যক্তিগত জীবন বরাবরই ব্যাপকভাবে প্রচারের আলোয় থেকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুও হয়ে উঠেছে।

তার প্রথম স্ত্রী ছিলেন ইভানা জেলনিকোভা। তিনি একজন চেক ক্রীড়াবিদ এবং মডেল ছিলেন। তাদের তিন সন্তান ডোনাল্ড জুনিয়র, ইভাঙ্কা এবং এরিক।

১৯৯০ সালে এই দম্পতির বিবাহবিচ্ছেদ হয়। বিচ্ছেদের সময় আদালতে তাদের আইনি লড়াই নিয়মিত ‘গসিপ কলামে’ স্থান পেয়েছে।

তার পরলোকগত স্ত্রী ইভানা জেলনিকোভা ট্রাম্পের বিরুদ্ধে গার্হস্থ্য হিংসার অভিযোগ এনেছিলেন। ওই অভিযোগ অবশ্য তিনি পরে তুলে নেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে তৈরি একটা চলচ্চিত্রে এই বিষয়ে দেখানো হয়েছে।

তার দ্বিতীয় স্ত্রী অভিনেত্রী মার্লা ম্যাপলস। এই দম্পতির একমাত্র সন্তান টিফানির জন্মের দু’মাস পর ১৯৯৩ সালে মার্লা ম্যাপলস এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হন। ১৯৯৯ সালে তাদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়।

ট্রাম্পের বর্তমান স্ত্রী হলেন সাবেক স্লোভেনিয়ান মডেল মেলানিয়া ট্রাম্প। তারা ২০০৫ সালে বিয়ে করেছিলেন। তাদের ব্যারন উইলিয়াম ট্রাম্প নামে এক ছেলেও আছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের ব্যক্তিগত জীবনে একাধিক বিতর্কিত অধ্যায় রয়েছে। একাধিকবার যৌন নির্যাতন ও বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। চলতি বছরের শুরুর দিকে দুই পৃথক জুরি রায় দেয় যে লেখিকা ই জিন ক্যারলের তার বিরুদ্ধে তোলা যৌন নিপীড়নের অভিযোগ অস্বীকার করে ডোনাল্ড ট্রাম্প ওই লেখিকার মানহানি করেছেন।

ওই মামলায় তাকে মোট আট কোটি ৮০ লাখ ডলার দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যদিও এই রায়ের বিরুদ্ধে ট্রাম্প আপিল করেছেন। ২০০৬ সালে পর্ন তারকা স্টর্মি ড্যানিয়েলসের সাথে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের অভিযোগ ধামাচাপা দিতে ব্যবসায়িক নথিতে জালিয়াতির অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। সেই মামলায় ৩৪টা গুরুতর অপরাধে ট্রাম্পকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।

প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প
১৯৮০ সালে এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প রাজনীতিকে ‘মিন লাইফ’ (খুবই সঙ্কীর্ণস্তরের জীবন) হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। একইসাথে যোগ করেছিলেন, এর পরিবর্তে ‘সবচেয়ে সক্ষম ব্যক্তিরা’ ব্যবসার জগৎকে বেছে নেন।

তার দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসে ৮০-এর দশকের শেষের দিকে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য সংশ্লিষ্ট দলের মনোনয়ন জেতার দৌড়ের বিষয়ে তিনি মনোনিবেশ করেন ২০০০ সালে প্রথমে রিফর্ম পার্টির হয়ে এবং ২০১২ সালে রিপাবলিকান হিসেবে।

সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রতত্ত্ব ‘বার্থরিজম’-এর সবচেয়ে সোচ্চার প্রবক্তাদের মধ্যে একজন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ‘বার্থরিজম’ তত্ত্ব খাড়া করে প্রশ্ন তুলেছিলেন বারাক ওবামা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করেছিলেন কিনা। তবে ২০১৬ সাল পর্যন্ত তিনি স্বীকার করেননি যে এই তত্ত্ব ‘অসত্য’ ছিল এবং তার জন্য কখনো ক্ষমা চাননি।

২০১৫ সালের জুনের আগ পর্যন্ত ডোনাল্ড ট্রাম্প আনুষ্ঠানিকভাবে হোয়াইট হাউসের লড়াইয়ে শামিল হওয়ার ঘোষণা করেননি। ওই সময় ‘আমেরিকান ড্রিম’কে মৃত বলে ঘোষণা করেছিলেন বটে, কিন্তু প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আমেরিকান ড্রিমকে আরো বৃহত্তর এবং ভালোভাবে ফিরিয়ে আনার।

নির্বাচনী প্রচারে তার সম্পদ এবং ব্যবসায়িক সাফল্যকে জাহির করতে দেখা গিয়েছিল এই রিয়েল এস্টেট টাইকুনকে। তিনি মেক্সিকোর বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে ‘মাদক, অপরাধ ও ধর্ষকদের পাঠানোর’ অভিযোগ আনেন এবং দাবি করেন, সীমান্তে প্রাচীর নির্মাণের খরচ ওই দেশকেই দিতে হবে।

বিতর্ক অনুষ্ঠানের মঞ্চে এ ধরনের বিতর্কিত মন্তব্য এবং মঞ্চে আধিপত্য বিস্তারকারী ব্যক্তিত্ব তার সমর্থক এবং তীব্র সমালোচকদের সমান পরিমাণে আকর্ষণ করেছিল। গণমাধ্যমেও বারবার শিরোনামে উঠে এসেছে তার বিভিন্ন মন্তব্য।

‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেন’-কে তার প্রচারাভিযানের স্লোগান বানিয়ে সহজেই রিপাবলিকান পার্টির অন্য সদস্যদের (যারা প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হতে ওই দলের মনোনয়ন চেয়েছিলেন), পেছনে ফেলে দিয়ে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের মুখোমুখি হন।

তার এই প্রচারাভিযান অবশ্য বিতর্কে ঘেরা ছিল। তার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ প্রকাশ্যে আসতে থাকে।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ওঠা একাধিক অভিযোগের তালিকায় রয়েছে একটা ফাঁস হওয়া অডিও রেকর্ড। যেখানে তিনি যৌন নির্যাতন নিয়ে তার বড়াই করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। একইসাথে ওই সময় তিনি জনমত জরিপে পিছিয়ে পড়েছিলেন।

তবে প্রবীণ রাজনীতিবিদদের ও জরিপকারীদের স্তব্ধ করে দিয়ে জয়ের শেষ হাসি হেসেছিলেন তিনি। ২০১৭ সালের ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন ট্রাম্প।

প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন
প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণের প্রথম ঘণ্টা থেকেই তার কার্যকালে বারবার নাটকীয়তা দেখা গেছে। প্রায়ই ট্রাম্পকে এক্সে (সাবেক টুইটার) আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করতে দেখা যেত। ভিন্ন দেশের নেতৃত্বের সাথেও প্রকাশ্যে তাকে বচসা করতে দেখা গেছে।

তিনি প্রধান জলবায়ু ও বাণিজ্য চুক্তি থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন, সাতটা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ থেকে ভ্রমণ নিষিদ্ধ করে দেন, অভিবাসন-সংক্রান্ত কঠোর বিধিনিষেধ জারি করেন।

তার কার্যকালে চীনের সাথে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্প প্রশাসনকে দেখা যায় রেকর্ড কর আদায়ের নীতি বাস্তবায়ন এবং মধ্য প্রাচ্যের সাথে সম্পর্ক পুনর্গঠন করতে।

প্রায় দু’বছর ধরে একজন বিশেষ কৌঁসুলি ২০১৬ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রচার শিবির ও রাশিয়ার মধ্যে আঁতাতের অভিযোগের তদন্ত করেছেন। ৩৪ জনের বিরুদ্ধে কম্পিউটার হ্যাকিং ও আর্থিক অপরাধের মতো মামলায় ফৌজদারি অভিযোগ আনা হলেও অভিযুক্তদের তালিকায় ট্রাম্প ছিলেন না। তবে তদন্তে অপরাধমূলক যোগসাজশের প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে তিনিই তৃতীয় প্রেসিডেন্ট যাকে অভিশংসিত হতে হয়েছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে যে তিনি ডেমোক্র্যাট প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেনের বিরুদ্ধে ‘নেতিবাচক কোনো বিষয়’ খুঁজে বের করার জন্য বিদেশী সরকারকে চাপ দিয়েছিলেন। ডেমোক্র্যাট নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধি পরিষদে তাকে অভিশংসিত করা হলেও রিপাবলিকান নেতৃত্বাধীন সেনেটে তিনি খালাস পান।

২০২০ সালেও তিনি প্রেসিডেন্ট পদের জন্য রিপাবলিকান প্রার্থী হিসেবে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন। ওই বছর করোনাভাইরাস মহামারির আধিক্য দেখা যায়। করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় তার ভূমিকা নিয়ে কড়া সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল ট্রাম্পকে।

যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যু ও সংক্রমণের হার এবং ‘শরীরে জীবাণুনাশক ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে এই ভাইরাসের চিকিৎসা করা যায় কিনা’ তা নিয়ে গবেষণার পরামর্শ দেয়ার মতো ট্রাম্পের বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য তার তীব্র সমালোচনা হয়।

গত অক্টোবর মাসে কোভিড-১৯ ধরা পড়ায় নির্বাচনী প্রচার থেকে বিরতি নিতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত সাত কোটি ৪০ লাখ ভোট পেয়েও জো বাইডেনের কাছে ৭০ লাখেরও বেশি ভোটের ব্যবধানে হেরে যান তিনি।

যদিও তার প্রতিদ্বন্দ্বীর এই জয় তিনি মেনে নিতে পারেননি। ২০২০ সালের নভেম্বর থেকে ২০২১ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি ক্রমাগত ভোট চুরি এবং ব্যাপক নির্বাচনী জালিয়াতির অভিযোগ তুলে এসেছেন। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে দায়ের করা ৬০টারও বেশি মামলা আদালত খারিজ করে দেয়।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিতে অস্বীকার করেন ট্রাম্প। ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ওয়াশিংটনে তার সমর্থকদের নিয়ে সমাবেশ করেন এবং তাদের ইউনাইটেড স্টেটস ক্যাপিটলে জড়ো হওয়ার আহ্বান জানান কারণ কংগ্রেসের তরফে বাইডেনকে আনুষ্ঠানিকভাবে জয়ী ঘোষণা করার কথা ছিল।

ট্রাম্পের সমর্থকদের সেই সমাবেশ দাঙ্গার রূপ নেয়। ওই ঘটনা তার আইনপ্রণেতা এবং ভাইস প্রেসিডেন্টকে বিপদে ফেলে দেয়। এই ঘটনার ফলে দ্বিতীয়বার অভিশংসিত হতে হয় ট্রাম্পকে। যদিও এইবারও তাকে বেকসুর খালাস করে সেনেট।

তবে ওই ঘটনার দিনে তার কর্মকাণ্ড এখনো দু’টি ফৌজদারি মামলার বিবেচনাধীন।

রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন
ক্যাপিটল ভবনে হামলার পর ট্রাম্পের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেছে বলেই ধারণা করা হয়েছিল। দাতা এবং সমর্থকরা আর কখনো তাকে সমর্থন করবেন না বলে শপথ করেছিলেন। এমনকি তার নিকটতম মিত্ররাও প্রকাশ্যে ট্রাম্পকে অস্বীকার করেন।

প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান এড়িয়ে যান তিনি। নিজের পরিবারকে ফ্লোরিডায় স্থানান্তরিত করে দেন। তবে তার অনুগত ভক্তদের একটা অংশ এখনো ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে। একইসাথে রিপাবলিকান পার্টিতেও তার ব্যাপক প্রভাব বজায় রয়েছে।

প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার কার্যকাল শেষ হয়ে যাওয়ার পরই একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে যা যুক্তরাষ্ট্রে তোলপাড় শুরু করে। ক্ষমতায় থাকাকালীন সুপ্রিমকোর্টে তার মনোনীত যে তিনজন ডানপন্থী বিচারপতিকে মনোনীত করেছিলেন ট্রাম্প তারা রক্ষণশীল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত করে প্রায় ৫০ বছর ধরে চলে আসা গর্ভপাতের অধিকারের অবসান ঘটান।

এরপর ২০২২ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে রিপাবলিকানদের দুর্বল প্রত্যাবর্তনে তাকে দায়ী করা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হিসেবে নিজের দলের মনোনয়ন চেয়ে লড়াইয়ের ময়দানে নামেন। ক্রমে অন্যান্য রিপাবলিকান সদস্যদের মনোনয়নের দৌড়ে পেছনে ফেলে দেন।

তার সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্টসহ ১২ জনেরও বেশি বিরোধীরা তাকে চ্যালেঞ্জ জানালেও বিতর্কের মঞ্চ এড়িয়ে যান ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর পরিবর্তে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে নিশানা করে ক্রমাগত সমালোচনা করতে থাকেন।

চারটি ফৌজদারি মামলায় ৯১টা গুরুতর অভিযোগের মুখোমুখি হয়ে নির্বাচনী দৌড় শুরু করেন তিনি। তবে আইনি মামলা বিলম্বিত করাতে তার কৌশল অনেকাংশেই সফল হয়েছে। নির্বাচনের আগে তিনটে মামলার অগ্রগতি হবে না।

অন্যদিকে নিউইয়র্কে তার সাজা (যুক্তিযুক্তভাবে সবচেয়ে দুর্বল অভিযোগের ভিত্তিতে) নভেম্বর মাসের শেষ পর্যন্ত বিলম্বিত হয়েছে।

ট্রাম্পের ওপর হামলা
গত ১৩ জুলাই পেনসিলভানিয়ায় এক নির্বাচনী সমাবেশে ২০ বছর বয়সী এক বন্দুকধারী ট্রাম্পকে হত্যার চেষ্টা করেন বলে অভিযোগ উঠেছে। টমাস ম্যাথিউ ক্রুকস নামে ওই অভিযুক্ত কাছের একটা ভবনের ছাদ থেকে ট্রাম্পকে লক্ষ্য করে গুলি চালান। পরে স্নাইপারের গুলিতে ওই হামলাকারীর মৃত্যু হয়, তবে তার আগে টমাস ম্যাথিউ ক্রুকসের ছোড়া একটা গুলিতে ট্রাম্পের ডান কানে আঘাত লাগে।

এর কয়েক দিন পর ‘রিপাবলিকান ন্যাশনাল কনভেনশনে’ তার পার্টি ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে টানা তৃতীয়বারের মতো রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে ঘোষণাও করা হয়।

পেনসিলভানিয়ার নির্বাচনী প্রচারাভিযানে হামলায় প্রাণে বেঁচে যাওয়ার পর সেপ্টেম্বর মাসে তাকে আবারো হত্যার চেষ্টা করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের ওয়েস্ট পাম বিচ এলাকায় অবস্থিত তার মালিকানাধীন একটা ক্লাবে গলফ খেলছিলেন ট্রাম্প। ওই সময় তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয় বলে অভিযোগ। তবে এই ঘটনায় তার কোনো ক্ষতি হয়নি বলে জানা গেছে।

আসন্ন নির্বাচন
ডেমোক্র্যাট দলের আমলে যুক্তরাষ্ট্রে মহামারী-পরবর্তী অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত লাভ দেখা গেলেও উচ্চ মূল্যস্ফীতি, অবৈধ অভিবাসন ও পররাষ্ট্রনীতির বিশৃঙ্খলাসহ একাধিক অভিযোগ উঠেছে বাইডেন প্রশাসনের বিরুদ্ধে।

এদিকে জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দৌড় থেকে সরে দাঁড়ানোর পর তার ভাইস প্রেসিডেন্ট কমালা হ্যারিসকে ওই পদের জন্য মনোনীত করেন। ওই সময় থেকেই ট্রাম্প কমলাকে প্রশাসনের ব্যর্থতার জন্য দায়ী করার চেষ্টা করে এসেছেন। তার এই প্রয়াস ‘মাঝারি সাফল্য’ পেয়েছে।

প্রসঙ্গত, যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় জরিপগুলো ইঙ্গিত দিচ্ছে যে কমলা উদারপন্থী ভোটারদের উদ্দীপ্ত এবং মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করতে সক্ষম হলেও নির্বাচনী দৌড়ে কিন্তু এখনো স্থিতিবস্থায় রয়েছেন।

তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প তার সমর্থকদের বলেছেন, ‘২০২৪ সালের ৫ নভেম্বর আমাদের দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন হবে।’
সূত্র : বিবিসি