তুরস্ক নির্বাচন : এরদোগানের পক্ষে-বিপক্ষে যা জানা গেল
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ১৩ মে ২০২৩, ১০:৪৪
‘রজব তাইয়েব এরদোগান যদি আবার জয়লাভ করেন, আমাদের সবার জীবন দুঃস্বপ্নের মতো হয়ে উঠবো,’ বলেন ইস্তাম্বুলের এক শিক্ষার্থী, ২৩ বছর বয়সী পেরিত।
তুরস্কের একটি স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বোয়াজিচি ইউনিভার্সিটিতে একজন সরকারপন্থী ডিন নিয়োগের প্রতিবাদে বিক্ষোভে অংশ নেয়ার কারণে তাকে প্রায় দু’মাস জেলে থাকতে হয়েছিল।
পেরিত এবং তার বন্ধু সুদ ও এমরু দেশটির ৫০ লাখ ফার্স্ট-টাইম ভোটারের অন্যতম যারা রজব তাইয়েব এরদোগানকে ছাড়া আর কোনো তুরস্কের নেতৃত্বকে তাদের দেশ চালাতে দেখেনি। এবারই তারা প্রথমবারের মতো ভোট দিচ্ছে।
এমরুর অভিযোগ লাগামহীন মূল্যস্ফীতির কারণে তুরস্কে তাদের মতো তরুণদের জীবন ক্রমশই কঠিন হয়ে পড়ছে। সরকারি হিসেবে বর্তমানে মূল্যস্ফীতির এই হার দাঁড়িয়েছে ৪৪ ভাগ।
দেশটির নাজুক এই অর্থনৈতিক পরিস্থিতির জন্য ব্যাপকভাবে দায়ী করা হয় প্রেসিডেন্টের এরদোগানের গৃহীত নীতিমালাকে।
‘আপনার পক্ষে শুধু পড়ালেখা করে জীবন চালানো সম্ভব নয়, বেঁচে থাকতে হলে আপনাকে একটি পূর্ণকালীন চাকরিও জোগাড় করতে হবে,’ বলেন তিনি।
তার বান্ধবী সুদও জানিয়েছেন যে রোববারের পার্লামেন্ট ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি বিরোধী প্রার্থীকে ভোট দেয়ার পরিকল্পনা করছেন।
তিনি আরো বলেন, ‘আমি আমার আবেগ ও মতামত প্রকাশে নিরাপদ বোধ করছি না। কারণ যখনই এটা করি তখনই আমি আক্রমণের শিকার হই।’
বোয়াজিচি ইউনিভার্সিটিতে প্রতিবাদ বিক্ষোভে যোগ দেয়ার জন্য চলতি বছরের শুরুর দিকে তাকেও ১২ মাসের স্থগিত কারাদণ্ড হয়েছে।
পেরিত বিশ্বাস করেন প্রেসিডেন্ট এরদোগান ও তার দল একে পার্টির ২০ বছর ক্ষমতায় থাকার পর, এখন দেশটিতে পরিবর্তনের সময় এসেছে।
পেরিত আরো বলেন, ‘লোকজনের মনোভাব পরিবর্তনের জন্য ২০ বছর অনেক লম্বা সময়। এই সময়ে তারা গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সম্পর্কে একটা ধারণা অর্জন পেরেছে। এরদোগান যদি আবার জয়লাভ করেন তাহলে এটাই হয়তো আমাদের শেষ নির্বাচন হতে পারে।’
প্রেসিডেন্ট এরদোগানের দুই দশকের শাসনামলে তুরস্ক ক্রমেই একটি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সেই অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে সংসদীয় পদ্ধতিতে ফিরে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
ধারণা করা হচ্ছে এবারের নির্বাচনে প্রধান দুই প্রার্থীর মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। বলা হচ্ছে প্রেসিডেন্ট এরদোগান তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে এই প্রথম সবচেয়ে কঠিন এক নির্বাচনী পরীক্ষার মুখে পড়তে যাচ্ছেন।
তুরস্ক প্রেসিডেন্টের সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন বিরোধী জোটের প্রার্থী কামাল কুলুচদারুলু। ছয়টি বিরোধী দল নিয়ে গঠিত জোট ‘টেবিল এবং সিক্সের’ প্রতিনিধিত্ব করছেন তিনি।
আরো কিছু সরকারবিরোধী গ্রুপও কুলুচদারুলুর প্রতি সমর্থনের কথা ঘোষণা করেছে।
এ কারণেই ৭৪ বছর বয়সী সাবেক এই সরকারি কর্মকর্তা এরদোগানের জন্য বড় ধরনের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছেন।
এবারের নির্বাচনে যারা ভোট দিচ্ছেন তাদের আট শতাংশ ‘ফার্স্ট-টাইম ভোটার’ যারা প্রথমবারের মতো ভোট দিচ্ছেন।
অনেকে মনে করেন তুরস্কে যেসব গ্রুপ এখনো মনস্থির করেন নি যে তারা কাকে ভোট দেবেন, তাদের মধ্যে এই গ্রুপটি সবচেয়ে বড়।
তবে ২০ বছর বয়সী সালিহ কাকে ভোট দেবেন সেটা তার কাছে পরিষ্কার।
তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি রজব তাইয়েব এরদোগান একজন ক্যারিশম্যাটিক নেতা। তুরস্কের রাজনীতিতে এ ধরনের ক্যারিশমা থাকা গুরুত্বপূর্ণ ‘
তিনি বিশ্বাস করেন এরদোগান তার শাসনামলের বিভিন্ন অর্জনের ওপর ভিত্তি করে তুরস্কের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে পারবেন।
তিনি আরো বলেন, ‘এর আগে তুরস্কে জ্বালানির বিষয়ে অনেক সমস্যা ছিল এবং সামরিক কারণে দেশটিকে অন্য দেশের ওপর নির্ভর করতে হতো। কিন্তু এখন আমরা নিজেরাই নিজেদের গাড়ি উৎপাদন করছি, ড্রোন ও বিমান তৈরি করছি। এরদোগান আমাদের সব সমস্যা সমাধান করে দিয়েছেন।’
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণায় সব প্রার্থী এবার তরুণ ভোটারদের মন জয় করার চেষ্টা করেছেন।
এরদোগান জোর দিয়েছেন প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তি খাতের অগ্রগতির ওপর, কিন্তু বিরোধী প্রার্থী কুলুচদারুলু আরো বেশি স্বাধীনতা ও উন্নত কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
কিন্তু ২০ বছর বয়সী গিজেম মনে করেন প্রেসিডেন্ট এরদোগানই তুরস্কে সবার স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, ‘আজকের তুরস্কে যে যা করতে পছন্দ করে সেটাই সে করতে পারে। কয়েক দশক আগে তার বিরোধীরাই লোকজনের স্বাধীনতা খর্ব করেছে। আমার মতো যেসব নারী হিজাব পরতো তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ ছিল না।’
প্রেসিডেন্ট এরদোগান তার শাসনামলে বড় ধরনের যেসব সংস্কার ঘটিয়েছেন তার একটি হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি চাকরিতে নারীর হিজাব পরার ওপর দীর্ঘদিনের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া।
তিনি আরো বলেন, ‘আজকের দিনে এই দেশে যদি হিজাব পরিহিত কোনো ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিম্বা শিক্ষক থাকেন, তাহলে সেটা সম্ভব হয়েছে এরদোগানের জন্য। তিনিই এই স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছেন। তিনি যদি এটা না করতেন তাহলে আজকেও ধর্মনিরপেক্ষতার নামে আমাদের এই স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত থাকতে হতো।’
যেসব নারী সরকারি চাকরি করেন তাদের হিজাব পরার অধিকারের দাবিতে বিরোধী প্রার্থী কুলুচদারুলু গত বছর পার্লামেন্টে একটি বিল উত্থাপন করেছিলেন। তখন এরদোগান এই প্রস্তাবের ওপর গণভোট আয়োজনের প্রস্তাব দেন। এই বিষয়টির এখনো কোনো সমাধান হয়নি।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আরো দু’জন প্রার্থী লড়ছেন, মধ্য-বামপন্থী ও জাতীয়তাবাদী মুহাররাম ইঞ্জে ও ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী সিনান ওয়ান।
সাম্প্রতিক জনমত জরিপে দেখা গেছে তরুণ ভোটারদের কাছে এই দু’জন প্রার্থীর আবেদন রয়েছে।
এ কারণে প্রধান বিরোধী জোটের সমর্থকরা আশঙ্কা করছেন কুলুচদারুলুর ভোট ভাগ হয়ে গেলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন দ্বিতীয় দফার ভোটাভুটিতে গড়াতে পারে।
কোনো প্রার্থী ভোটারদের ৫০ ভাগের বেশি ভোট না পেলে দু’সপ্তাহ পর দ্বিতীয় রাউন্ডের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
আর রোববারের নির্বাচনে কেউ যদি অর্ধেকের বেশি ভোট পান তাহলে তিনিই সরাসরি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন।
এবারের নির্বাচনে নারী ভোটাররা কাকে ভোট দেবেন সেটাও জয় পরাজয় নির্ধারণে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তুরস্কে মোট ভোটারের ৫০.৬% নারী।
ধারণা করা হয় যে দেশটির রক্ষণশীল নারীরা দুই দশক আগে এরদোগানকে ভোট দিয়েছিলেন, যে কারণে তিনি ক্ষমতায় আসতে পেরেছিলেন। কিন্তু সেই সমর্থন এখন দুর্বল হয়ে পড়েছে।
পারিবারিক নির্যাতনের হাত থেকে নারীকে রক্ষা করার জন্যে যে আন্তর্জাতিক চুক্তি হয়েছিল সেই ইস্তাম্বুল সনদে তুরস্ক সই করেনি। এ কারণে তিনি বহু নারীর সমর্থন হারিয়েছেন।
প্রেসিডেন্ট এরদোগানের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে নারীরা বিক্ষোভেও অংশ নিয়েছিল।
অতীতে এরদোগান যেসব নারী এখনো মা হননি তাদেরকে তিনি ‘অর্ধেক নারী’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। তিনি একজন নারীকে অন্তত তিনটি সন্তান নেয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান আরো বলেছিলেন যে নারী ও পুরুষকে সমান চোখে দেখা সম্ভব নয়।
এরদোগান পিপলস এলায়েন্স নামের যে জোট থেকে প্রার্থী হয়েছেন সেই জোটে রয়েছে চরম ইসলামপন্থী দল- হুদা পার। এ কারণে তার নিজের দল ‘একে‘ পার্টির অনেক নারী এমপির মধ্যেও উদ্বেগ রয়েছে।
নারীবাদী আন্দোলনের সাথে যুক্ত গুলসুম কাভ বলছেন বর্তমান সরকার নারী পুরুষের মধ্যে সাম্য প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাস করে না।
তিনি বলেন, এরদোগানের শাসনামলে নারী স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে।
‘শর্টস পরার কারণে নারীদের ওপর আক্রমণ করা হচ্ছে, নারী সঙ্গীত শিল্পীরা যে ধরনের পোশাক পরেন তার জন্য তাদেরকে জেলে পাঠানোর হুমকি দেয়া হচ্ছে, এবং যৌন হয়রানির সমালোচনায় করায় শিল্পীদের সাজা দেয়া হচ্ছে।’
‘তারা চায় নারীরা ঘরে বসে থাকবে, কিছুই করবে না। কিন্তু নারীরা তো বদলে গেছে। তারা তুরস্ককেও বদলে দেবে, বলেন তিনি।
সূত্র : বিবিসি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা