নয়নাভিরাম চর নিজাম
- রফিকুল হায়দার ফরহাদ, চর নিজাম থেকে ফিরে
- ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০:৪৫, আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১:২৬

বঙ্গোপসাগরের বুকে চর কুকরি-মুকরি ও ঢাল চরের পর আরো একটি সুন্দর চর রয়েছে। এর নাম চর নিজাম। চর কুকরি মুকরির পর্যটকদের নিয়ে ঘুরতে যাওয়া মাঝিরা এই তথ্য দিয়েছিলেন। তাদের বোটে (বড় ট্রলার) করেই ঘুরতে গেলাম চর নিজামে। খুব কম পর্যটকই যান এই চর নিজামে। জাকির মাঝি জানান, তিনি একটি মাত্র পর্যটক দলকে নিয়ে গিয়েছিলেন চর নিজামে। তখন এই চরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে সেই ভ্রমনপিপাসুরাই মাঝিকে অনুরোধ করেছিলেন অন্য পর্যটকদের এই চরে ঘুরতে নিয়ে যেতে। ভোলা জেলার সাগর পাড়ে যাওয়া পর্যটকদের মূল আকর্ষনই থাকে চর কুকরি-মুকরিকে ঘিরে। এরপর কেউ কেউ ইচ্ছে করলে মেঘনা নদীর মোহনা পাড়ি দিয়ে কুকরি-মুকরির পূর্ব দিকে ঘণ্টা দুয়েক সময় ট্রলারে থেকে পৌঁছে যান ঢাল চর ও তারুয়ার চরে। চর নিজামের প্রতি কারো আগ্রহ তেমন জাগে না।
বহু বছর আগ থেকেই দ্বীপ চর ভ্রমণে আমার আগ্রহ। নতুন চরের সন্ধান পেলে সময় সুযোগ মিললেই ছুটে যাই সেখানে। মানচিত্রে মেঘনা নদীর মোহনায় চর নিজামের অবস্থান দেখে সেখানে যাওয়ার আগ্রহটা অনেক দিনের। শেষ পর্যন্ত গত দুই বছর ধরে চর-দ্বীপ ভ্রমণের সঙ্গী আমার সাড়ে চার বছরের মেয়েকে নিয়ে রওয়ানা হলাম চর নিজামের উদ্দেশ্যে। সাথে দুই আত্মীয়।
সচরাচর চর কুকরি-মুকরিতে আমরা যাই ভোলার চর ফ্যাশনের বেতুয়া ঘাটে। সেখান থেকে মোটর সাইকেল বা অটোতে কচ্চইবার ঘাট দিয়ে খেয়া বা স্পিডবোটে করে। তবে এবার জাকির মাঝির অনুরোধে কচ্চইবার ঘাট এড়িয়ে আট কপাট ঘাট দিয়ে রওয়ানা হলাম চর নিজামের উদ্দেশ্যে। এতে চর কুকরি-মুকরিকে পশ্চিমে ঠেলে ঢাল চরের পাশ দিয়ে আমাদের বোট (ট্রলার) ছুটে চললো চর নিজামের উদ্দেশ্যে। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পর আমরা পৌঁছে গেলাম চর নিজামে। মাঝে অবশ্য ১০ মিনিট যাত্রা বিরতি নিয়েছিলাম ঢাল চরে।
১০ থেকে ১২ কিলোমিটার আয়তনের চর নিজামের অবস্থান চর কুকরি মুকরির পূর্বে এবং ঢাল চরের উত্তর-পূর্ব কোণে। ঢাল চরকে পেছনে ফেলে আমাদের ট্রলার ছুটে চলছিল এই দ্বীপের উদ্দেশ্যে। ঢাল চর থেকে আধা ঘণ্টার একটু বেশি সময় সমুদ্রে কাটিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম চর নিজামে। একটি খাল এ চরকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছে। খালে আমাদের ট্রলার ঢুকতে পারছিল না। তাই মাত্রই সাগরে জাল ফেলা জেলেকে তার ছোট নৌকা নিয়ে আসতে অনুরোধ করলাম। তিনি রাজীও হলেন। আমাদের চরে নিয়ে যাবেন ও ফিরিয়ে নিয়ে আসবেন। অবশ্য সামান্য এ পথ পাড়ি দেয়ার জন্য গুণতে হয়েছে দুই শ’ টাকা।
দূর থেকেই দেখা যাচ্ছিল চর নিজামের সৌন্দর্য্য। চরে পা রাখার আগেই আমরা মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছিলাম চরের সৌন্দর্য্য দেখে। এর দক্ষিণ অংশে সাদা বালির সৈকত। সেখানে ছুটে বেড়ায় শত শত লাল কাঁকড়া। পশ্চিম-উত্তর পাড়ে সাগর লাগোয়া সবুজ ঘাসের গালিচা। এরপরই ঘন বন। চরের একটু পূর্ব দিকে বেশ কিছু টিনের ঘরের সারি। এ ঘরগুলো মাছের আড়ৎ বা গদীঘর হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
উপকূলীয় অন্যান্য চরেও বিস্তীর্ণ সবুজ প্রান্তরের পর বনের দেখা মিলে। তবে পানির এতো কাছে সবুজ ঘাসের মখমল এবং সামান্য পরেই ঘন বনের উপস্থিতি সচরাচর দেখা যায় না। মূলত এটাই চর নিজামের সৌন্দর্য্য। ঘাসের গালিচার উত্তর-পশ্চিমে ফের সাদা বালির সৈকত। অর্থাৎ অল্প দূরত্বে দুটি সাদা বালির সৈকত। মাঝে সবুজের সমারোহ।
আমরা যে খাল দিয়ে গদীঘরের কাছে পৌঁছালাম সেখানে খালটি আবার দুই ভাগে বিভক্ত। খালের এক মাথা চলে গেছে উত্তরে বনের মধ্যে। আরেক অংশ পূর্বে। গদীঘরে অনেকগুলো দোকান থাকলেও এখন এ দোকানগুলো বন্ধ। বর্ষায় মাছ ধরার মৌসুমে সরগরম থাকে এ দোকানগুলো। গদী ঘরের সামনেই মাচার উপর শুকানো হচ্ছিল চিংড়ি মাছের শুটকি। আমরা শুটকি কিনতে চাইলে আমাদের বহনকারী ছোট নৌকার মাঝি একটি বন্ধ ঘর খুলে দিলেন। এরপর সেখান থেকে তিন শ’ টাকা কেজি দরে কিনলাম চিংড়ি, চেউয়া (চিরিং) মাছ ও আরেক জাতের শুটকি।
মাছ ধরা, মাছ ও শুটকি বিক্রি করার মাধ্যমেই চর নিজামবাসী তাদের জীবিকা নির্বাহ করে। মোট ১৫ থেকে ১৬টা পরিবারের বসবাস এ চরে। অস্থায়ী জেলেসহ সব মিলিয়ে চরের জনসংখ্যা দেড় থেকে দুই শ’। মাছ ধরার পাশাপাশি সেখানকার মানুষরা এখন চাষাবাদও করছেন। ধান, আলু, তরমুজ, হলুদ চাষ শুরু করেছেন স্থানীয়রা।
২০ থেকে ২৫ বছর আগে জেগে উঠে চর নিজাম। একে পূর্ব ঢাল চরও বলে অনেকে। আবার চর নাজিম উদ্দিন আলম নামেও পরিচিত। তবে সরকারি কাগজপত্রে এটি চর নিজাম নামেই পরিচিত। জানান স্থানীয় বাসিন্দা খোরশেদ আলম ও স্বপন। গদী ঘরের পেছনেই একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। মসজিদের নাম পূর্ব ঢাল চর ফিসারী ঘাট জামে মসজিদ। মসজিদের ইমাম ভোলার লালমোহনের জহিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমি ২০২০ সালে এখানে এসেছি। এই মসজিদ একই সাথে স্কুলও। আমি ছেলে-মেয়েদের আরবির পাশাপাশি বাংলাও পড়াই।’ জহিরুল ইসলামের ছাত্র সংখ্যা ১৪ থেকে ১৫ জন।
স্থানীয় বাসিন্দা মনির হাওলাদার জানান, মসজিদকে ভালোভাবে পরিচালনার জন্য জেলা প্রশাসকের কাছে আর্থিক অনুদান চাওয়া হয়েছে। অন্যদের সাথে কথা বলার সময় নিজ থেকেই সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্য এগিয়ে আসেন মনির। তিনি বলেন, ‘আমাদের মতো গরীব জেলেদের পক্ষে মসজিদ পরিচালনা করা কঠিন। তাই জেলা প্রশাসকের কাছে সাহায্য চেয়েছি।’
তিনি আরো জানান, সরকারের উদ্যোগে যেন চর নিজামে অন্তত একটি পুকুর খনন করা হয়। স্থানীয় ভাষায় কিল্লা বা পুকুরের মিঠা পানি পান করতে পারবে বনে থাকা হরিণ, গরু ও মহিষ। মনিরের মতে, সরকারি পুকুর না থাকায় বনের এই প্রানীগুলো মিঠা পানি পান করতে পারছে না। ব্যক্তিগত পুকুর বেড়া দিয়ে ঘেরা। ফলে প্রতি বছরই নোনা পানি পান করে অসুস্থ হয়ে গরু, মহিষ ও বনের হরিণ মারা যায়।
তিনি একইসাথে চরে বসবাসকারী অল্প কয়েকটি পরিবারের জন্য একটি সাইক্লোন সেন্টার নির্মাণের কথা বলেন। মনির বলেন, ‘সাইক্লোনের সময় আমরা আগে সংকেত পেলে ট্রলার নিয়ে ঢাল চরের উদ্দেশ্যে চলে যাই। তবে সব সময় যাওয়া যায় না। সাগর উত্তাল হয়ে গেলে তখন আর যেতে পারি না। তখন কেউ ঝড়ে মারা যায়। কেউবা আল্লাহর রহমতে বেঁচে যায়।’
হাসপাতালতো দূরের কথা একটি ওষুধের দোকানও নেই চর নিজামে। ফলে কেউ গুরুতর অসুস্থ হলে তাকে পাঁচ হাজার টাকা ট্রলার ভাড়া করে নিতে হয় ঢাল চরের উদ্দেশ্যে। অনেক সময় এই টাকা যোগাড়ও কঠিন হয়ে যায় তাদের জন্য।
পর্যটকদের কাছে চরের প্রচারণা বাড়লে পর্যটন মৌসুমে আয় রোজগার বাড়বে। এমনটাই আশা করেন চর নিজামের স্থানীয় বাসিন্দারা।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা