তোমার গল্পের বই
- জোবায়ের রাজু
- ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০
রোদেলা আমার ওপর রেগে আছে। ভয়াবহ কিসিমের রাগ। সম্পর্কের এই তিন বছরে রোদেলাকে এর আগে এভাবে আর রাগতে দেখিনি। রাগের কারণ একটাইÑআমি বইমেলায় গিয়ে ওর গল্পের বইটি এখনো কিনিনি।
সত্যি কথা বলতে বইয়ের প্রতি আমার কোনো আকর্ষণ নেই। গল্প কবিতা আমাকে টানে না। অথচ রোদেলা তার বিপরীত। লেখালেখিতে ওর নেশা আকাশের মতো বিশাল। প্রতি বছর বইমেলাতে ওর গল্পের বই আসে। পাঠকও আগ্রহ নিয়ে কেনে। রাইটার হিসেবে পাঠকমহলে ওর জনপ্রিয়তাও দেখার মতো। বইমেলায় ওর বই বিক্রি হয়। পাঠক ভক্তদেরকে সে অটোগ্রাফ দেয়। সেগুলোর ছবি তোলে ফেসবুকে ছাড়ে। ভালোই লাইকÑকমেন্ট আসে।
কল দিলাম রোদেলাকে। না, মহারানী রিসিভ করেননি। করবেনও না। আসলে সব রাইটার চায় তার সাধনার লেখা প্রিয়জনরা পড়–ক। সে আশায় হয়তো রোদেলাও চায় আমি ওর বইটি কিনে আগ্রহ নিয়ে পড়ি। কিন্তু আমার মধ্যে যে সাহিত্যপ্রীতির চরম অভাব, সে কথা রোদেলাকে বোঝাই কী করে! তবুও সিদ্ধান্ত নিয়েছি একদিন বইমেলায় গিয়ে ওকে চমকে দিয়ে বলব, ‘আপনার বই কিনতে এসেছি মহারানী। অটোগ্রাফ হবে?’ রোদেলা খুশি হয়ে চোখের কোণে আনন্দ অশ্রু এনে আমাকে ওর বইতে অটোগ্রাফ দেবে আর সব অভিমান ভুলে গিয়ে বলবে, ‘আমি সত্যি খুশি।’
২.
আজ ছুটির দিন। আজ বিকেলে বইমেলায় যাব। আমার আগমনে রোদেলা চমকে যাবে। আরও চমকে যাবে যখন জানবে আমি ওর গল্পের বই ‘দুয়ারে দাঁড়িয়ে’ কিনতে এসেছি।
বইমেলায় এলাম। আজ বেশ জমজমাট বইমেলা। আরিয়ান প্রকাশনীর ৪২০ নাম্বার স্টলে পাওয়া যাচ্ছে রোদেলার নবম গল্পগ্রন্থÑদুয়ারে দাঁড়িয়ে।
আরিয়ান প্রকাশনীতে এসে স্টলকর্মী রিয়াদের কাছে জানলাম রোদেলা আজ বইমেলায় আসেনি। ভাগ্যটাই খারাপ আমার। চমক দেখাতে এসে বিফলে গেলাম।
না না, বিফল নয়। এক কাজ করা যায়। স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে রোদেলার বই হাতে ধরে ছবি তোলে ওর ইনবক্সে পাঠালে সে আনন্দে আত্মহারা হবে। হ্যাঁ এটাই ভালো হবে।
কাকে দিয়ে ছবি তোলা যায়! একটা ইয়ং ছেলেকে দেখা যাচ্ছে। কেন যেন মনে হল এই ছেলে ভালো ছবি তুলতে পারবে।
Ñএই যে ভাইয়া, শুনুন।
Ñবলুন।
Ñকী নাম আপনার?
Ñবাপ্পি।
Ñফাইন নাম। আচ্ছা আমি এই বইটি হাতে ধরে দাঁড়াব, আপনি আমার মোবাইল দিয়ে কয়েকটি ছবি তুলে দেবেন।
Ñওকে। নো প্রবলেম।
বাপ্পি নামের ছেলেটার হাতে মোবাইল দিলাম। রোদেলার বই হাতে ধরে দাঁড়িয়ে থাকা আমার বেশ কয়েকটা ছবি তুলল সে। তার পর বলল, ‘ভাইয়া, আপনি বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকুন, আমি ছবি তুলি।’ আমি তাই করলাম। রোদেলার বইয়ের দিকে তাকিয়ে আছি আর কানে আসছে আমার মোবাইলের কিক কিক শব্দ। বাপ্পি এবার বলল, ‘ভাইয়া, এবার আপনি বইয়ের দিকে তাকিয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টান, আমি ভিডিও করি।’
বাহ, ছেলেটা দারুণ সব আইডিয়া জানে। ইয়ং জেনারেশন বলে কথা! রোদেলার বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছি আমি, এমন ভিডিও দেখে সে খুশিতে লাফাবে।
আমি রোদেলার বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছি তীè চোখে। বাপ্পি ছেলেটি ভিডিও করছে। এক মিনিট...দুই মিনিট...তিন মিনিট..., পাঁচ মিনিট পরও সে আমাকে বলছে না ভিডিও শেষ হয়েছে। এতক্ষণ কেউ ভিডিও করে! ক্যামেরার দিকেও তাকাতে পারছি না ভিডিও পোজ নষ্ট হবে বলে!
আট মিনিট অলরেডি শেষ। তবুও ভিডিও থামছে না। কোনো টুঁ শব্দও করছে না ক্যামেরাম্যান বাপ্পি ছেলেটি। মানে কী! আমার বিরক্ত লাগছে। তবুও ভিডিও পোজ নষ্ট হবে বলে এক দৃষ্টিতে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছি। বিরক্তির মাত্রা চরমে।
ধুর! লাগবে না ভিডিও। বই বন্ধ করে ক্যামেরার দিকে তাকালাম। একি! বাপ্পি ছেলেটি কই! সামনে নেই কেন! বড় বড় চোখে এদিক-সেদিক তাকাচ্ছি। না, কোথাও নেই। বুকটা ধক করে উঠল। সে আমার আশি হাজার টাকা দামের মোবাইল নিয়ে ভেগেছে। কী হবে এখন! আমার নতুন মোবাইল। বইমেলায় এসব চোর বাটপারও আসে!
৩.
মোবাইল হারিয়ে মন খারাপ করে বাসায় এলাম। রোদেলাকে এই দুঃসংবাদ জানানো দরকার। কিন্তু মোবাইল তো ওই হারামজাদা নিয়ে গিয়ে গঙ্গা পার হইছে। রোদেলার নাম্বার পাবো কোথায়! ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে! আমার ডায়েরিতে রোদেলার নাম্বার লেখা আছে। আমাদের গেটের দারোয়ান সেলিম, যার সাথে আমার খুব অন্তরঙ্গ সম্পর্ক, তার মোবাইল থেকে রোদেলাকে কল দিলাম।
আমি জানি আমার নাম্বার থেকে এক শ’ বার কল দিলেও অভিমানি রোদেলা রিসিভ করবে না। দারোয়ান সেলিমের নাম্বার যেহেতু ওর আননোন, তাই প্রথম রিং হতেই রিসিভ করল।
পুুরো ঘটনা খুলে বললাম রোদেলাকে। ভেবেছি মোবাইল হারানো মনভাঙা এই আমাকে সান্ত্বনা দেবে সে, অথচ তা না করে রাগী গলায় বলল, ‘থাক মিস্টার রঞ্জু, মিথ্যে বলে আমাকে খুশি করানো লাগবে না। আমার বই না কিনলে না কিনবেন, তাই বলে একটা সাজানো নাটক শুনিয়ে আমার খুশি করার কোনোই দরকার নেই।’
রোদেলা লাইন কেটে দিলো। এই ঘটনা সে বিশ্বাসই করছে না। এক দিকে দামি মোবাইল হারিয়ে আমি মর্মাহত, অন্য দিকে রোদেলার কাছে আমি মিথ্যুক হয়ে গেছি। কী করব এখন!