চম্পট
- তুফান মাজহার খান
- ১৬ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০
আমার বাসা থেকে ভার্সিটির দূরত্ব প্রায় আঠারো কিলোমিটার। নিয়মিত এই আঠারো কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিতে গিয়ে যে কতরকম অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছে আমাকে তা অন্যের পক্ষে বোঝা কঠিন। সেসব অভিজ্ঞতা থেকে আজ একটি গল্প বলছি।
সে দিন বাসা থেকে বের হয়ে ভার্সিটির উদ্দেশে রওনা হয়েছিলাম। ঘুম থেকে উঠতে দেরি হওয়ায় হাতে সময় ছিল খুব কম। এমনিতে বাসা থেকে ভার্সিটি পর্যন্ত যেতে প্রায় দুই ঘণ্টা লেগে যায়। আজ হাতে সময় ছিল মাত্র দেড় ঘণ্টা। তাই খুব তাড়াহুড়ো করেই রেডি হয়ে ছুট লাগালাম। বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দেখি বাসও নেই। এই সময়টাতে বাস পাওয়া একটু কষ্টকর হলেও লেগুনা মিলে যায় অনায়াসেই। তবে ভাড়া দ্বিগুণ। তাই লেগুনায় নিয়মিত চড়া যায় না। সময় কম থাকলে কিংবা একেবারে বাস না পাওয়া গেলেই লেগুনাতে চড়ি। রীতিমতো আজও উঠে গেলাম লেগুনাতে।
লেগুনায় সিট সংখ্যা বারোটা তবে নয়-দশ জন হলেই লেগুনা ছেড়ে দেবে। কারণ সামনের স্টপেজেও অনেক যাত্রী গাড়ির জন্য অপেক্ষা করে। দশজন হতেই ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দিলো। কিছু সামনে যেতেই আরো দু’জন লোক উঠল। একটু পরই ড্রাইভার গাড়ি স্লো করে, বাইরে মাথা বের করে বলল, একজন ভাড়াগুলো উঠিয়ে ফেলেন, হেলপার নাই। লেগুনাতে প্রায়ই এমন হয়। হেলপার থাকে না। বাধ্য হয়ে প্রায়ই লেগুনার যাত্রীদেরই ভাড়া ওঠাতে হয়। সেদিনও এর ব্যতিক্রম ঘটল না। একজন স্বেচ্ছায়ই অতি আগ্রহ নিয়ে ভাড়া তুলতে শুরু করল। যদিও তার আচরণে মনে হচ্ছে না হিসাব-নিকাশ ঠিকমতো করতে পারে। আঙুলে গুনে গুনে হিসাব করে করে ভাড়া উঠিয়ে নিজের কাছেই রাখল। যাত্রাবাড়ী মোড় পর্যন্ত যাবে এই লেগুনা। কিন্তু তার আগেই প্রায় অনেক যাত্রী নেমে গেছে। কাজলা আসা পর্যন্ত ভাড়া উঠানো লোকসহ আমরা ছিলাম চারজন। কাজলা আসতেই লোকটা গাড়িতে হাত দিয়ে ঠাস ঠাস আওয়াজ করল যাতে লেগুনাটি থামে। লেগুনা থামার পর লোকটা নেমে সামনের দিকেই গেল। আমরা কেউ কিছুই মনে করলাম না। যেহেতু লোকটা সামনে গেছে সেহেতু টাকা দিয়েই যাবে। লেগুনাও প্রায় বিশ সেকেন্ডের মতো দাঁড়াল। সাধারণত লেগুনার ভেতরে ড্রাইভার এবং যাত্রীদের মাঝখানে একটা জানালার মতো থাকে। যেটা দিয়ে ড্রাইভারও পেছনের যাত্রীদের দেখতে ও কথা বলতে পারে। আবার যাত্রীরাও পারে। তবে এ লেগুনায় জানালা না থাকার কারণে সামনে দেখতে চেয়েও কিছু দেখতে পারলাম না।
আমরা যাত্রাবাড়ী স্ট্যান্ডে নামতেই ড্রাইভার নেমে এসে হাত পাতল। বুঝলাম, ঘটনা ঘটে গেছে। তার পরও আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী ভাড়া পাওনি? ড্রাইভার বলল, না মামা। ভাড়া কে উঠাইছে? একজন বলল, কেন কাজলাতে যে লোকটা নেমেছে সেই তো উঠাল। সে তো টাকা নিয়ে লেগুনার সামনেও গেল। আমরা তো ভাবলাম টাকা দিয়েই গেছে। ড্রাইভার বলল, আপনারা বলবেন না যে, টাকা তার কাছে, টাকাটা নেন। একজন বলল, ধুর মিয়া, লোক তো সামনেই গেল টাকা হাতে নিয়ে। চিল্লায়ে বলার কী আছে? আরেকজন বলল, ঠিকই আছে, হেলপার রাখতে পার না? অহন বুঝ মজা। পাখি চম্পট দিছে। ড্রাইভার বলল, মামা হেলপার তো আছে। আইজ কেন জানি আইল না।
আমি কিন্তু কড়া কথা বললাম না। কেননা, ব্যাপার যাই ঘটুক ড্রাইভারের তো লস হয়েছে। অন্তত এক-দেড়শ’ টাকার তেল তো খরচ হয়েছে। বেচারা তো ধনী না। একটা ট্রিপ তার জন্য অনেক কিছু। বাকি দু’জন যাত্রী ড্রাইভারকে আরো উল্টো দুটো কথা শুনিয়ে চলে গেল। আমি ড্রাইভারকে বললাম, মামা কী করবে এখন? সে বলে, কী করুম কন? আমরা ড্রাইভার বলে মাইনসে আমাদের মানুষ মনে করে না। আইচ্ছা কন, পুরাডা কি আমার দোষ? হেলপার আসে নাই অহন কি আমার গাড়ি লইয়া বইসা থাকলে চলব? আমার সপ্তাহে দুইডা কিস্তি। মাইয়া একটা পড়ালেহা করে। সংসারের খরচ আছে না? টাকাও লস হইল আমার। কতগুলা কথাও শুনিয়ে গেল দুই জনে।
আমি বললাম, থাক বাদ দাও। এখন কী আর করবা। এই নাও একশ’ টাকা রাখ। আমিও ছাত্র মানুষ। আমার কাছেও বেশি টাকা নাই। আর পঞ্চাশ টাকার মতো আছে। যাওয়ার সময় লাগবে। ড্রাইভার বলল, না মামা, আপনি দেবেন ক্যা? চাকরিজীবী তো দু’জন ছিল তারা তো আরো উল্টা আমারেই বইকা গেল। থাক মামা লাগব না।
অনেকটা জোর করেই তাকে টাকাটা দিলাম। সে টাকাটা হারিয়ে যে পরিমাণ মন খারাপ না করেছিল তার চেয়ে বেশি এই একশ’ টাকা পেয়ে সে খুশি হয়েছিল। আর এটাই আমার কাছে ভালো লাগে। মানুষের মুখের হাসি আমার কাছে টাকার চেয়ে অধিক মূল্যবান মনে হয়। হ