মতলব
- রুহুল আমিন রাকিব
- ১৪ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০
সে অনেক বছর আগের কথা। আমি তখন সবে মাত্র ক্লাস থ্রিতে পড়ি। আমাদের পাড়ায় কোন স্কুলে ছিল না তখন। পাড়ার সব ছেলেমেয়ে মিলে রোজ পাশের গ্রামের স্কুলে দল বেঁধে হেঁটে যেতাম।
সে যাই হোক, স্কুল লাইফের একটা ঘটনা আজো আমার ভীষণ মনে পড়ে। আমাদের পাড়ার স্কুল দলের ছেলেদের মাঝে দলনেতা ছিল। আমাদের সবার থেকে সিনিয়র আর অলস মফিজ ভাই। এই মফিজ ভাই যদিও আমাদের ক্লাসমেট। তবে বয়সে আমাদের থেকেও তিন-চার বছরের বড়। প্রতি ক্লাসে দু-দুবার করে কাটানোর কারণে মফিজ ভাই আজ অবধি প্রাইমারি লাইফের ইতি টানতে পারেনি।
তবে এই নিয়ে মফিজ ভাইয়ের কোনো মাথাব্যথা আছে বলেও আমাদের মনে হতো না। কারণ মফিজ ভাই আমাদের বলে, রোজ এক প্যাকেট করে বিস্কুট ফ্রি পাওয়া যায় স্কুল থেকে। প্রাইমারি লাইফ শেষ হলে তো এই সুযোগ আর পাবো না।
মাঝে মধ্যে আমাদের গর্ব করে বলত, এই স্কুলের সব স্যার এবং শিক্ষার্থী মফিজ ভাইকে সব সময় সম্মান দিয়ে কথা বলে। অবশ্য মফিজ ভাইয়ের এই কথার পেছনে একটা যুক্তিও আছে এখন আসছি সেই বিষয়ে। একদিন সকালবেলা স্কুল আসার পথে একজন দাদুকে দেখে, মফিজ ভাই আমাকে বলল।
এই ছোকরা, শোন, ওই যে গরুর দড়ি হাতে নিয়ে যে দাদু দাঁড়িয়ে আছে, ওনার কাছে গিয়ে বলবি, দাদু রাস্তার মাঝে গরু নিয়ে এমন করে দাঁড়িয়ে থাকলে আমাদের মতো ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েরা স্কুল যাওয়া-আসা করতে ভয় পাবে।
মফিজ ভাইয়ের কথা না শুনলেও বিপদ! কারণ ওনার কথা না শুনলে বাবা মায়ের কাছে এসে উল্টাপাল্টা কিছু মিথ্যা কথা বানিয়ে বলে সবার নামে। আমি আগে পিছে না ভেবে মফিজ ভাইয়ের শেখান বুলি দাদুর কাছে বললাম। আমার কথা শুনে দাদু রেগে আগুন!
আমাকে বলল বদমাশ, বেয়াদব! দাঁড়াও আজকে তোরে দেখাচ্ছি মজা! আমার কাছে এসে বলস মতলব কী? এত বড় সাহস! ছোট্ট মুখে বড় মানুষের নাম নিয়ে ট্রল করো।
এ কথা বলে ওই দাদু গরুর দড়ি হাত থেকে ছেড়ে দিয়ে আমার পিছু দৌড় দিলো। আমিও জীবন বাঁচাতে কাঁধের ব্যাগ ছুড়ে ফেলে, দিলাম এক ভোঁ দৌড়! এক সময় উপায় না দেখে মাঠের বুকে লাফিয়ে পড়ে দৌড়াতে লাগলাম।
আমার পিছু পিছু দাদুও ছুটছে। আর আমাকে বলতাছে, দৌড়াস কেন? দাঁড়া। আজ তোরে মজা দেখাব। কত বড় সাহস তোর! তুই আমাকে বলস মতলব কী।
সেদিন আর আমার স্কুল যাওয়া হয়নি।
দৌড়ে বাড়িতে এসেই উঠোনে মা বলে চিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছি। অনেক সময় পরে আমার জ্ঞান ফিরছে। ওই দাদুর গরুও নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।
এ দিকে আমার অসুস্থতার খবর শুনে, মফিজ ভাইও যেন ভয়ে কোথায় চলে গেছে! সেদিনের পরে অনেক জায়গায় খোঁজ করার পরেও মফিজ ভাইয়ের খোঁজ পাওয়া যায়নি।
অনেক দিন পরে, মফিজ ভাই বাড়িতে ফোন করে বলে কোনো এক হোটেলে ওয়েটারের চাকরি করে নাকি বেশ ভালো আছে। আমাকেও একটা ধন্যবাদ দিয়ে মফিজ ভাই বলল, রাকিবরে, আজ তোর কারণে আমি বাপের হোটেল ছেড়ে দিয়ে, অন্যর হোটেলের ওয়েটার।
সে দিনের সেই ফেলে আসা অতীতের কথা ভাবতে গেলে আজো আমি একা একা হাসি! খুব মিস করি এই লাইফে এসে মফিজ ভাইকে।