ফেসবুকে আফসু ভাই!
- ওহাব ওহী
- ২৯ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০
সম্প্রতি আমাদের পাড়াতো আফসু ভাই চমৎকার একটি স্মার্টফোন কিনেছেন। সেই সাথে হালের ক্রেইজ ফেসবুকেও যুক্ত হয়েছেন। একদিন বেশ সকাল সকাল একটি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পেলাম। প্রোফাইল পিকচারের ছবিটিও বেশ অদ্ভুত। ফটোফ্রেমের কল্যাণে তার চেহারায় আলাদা সানগ্লাস আর স্টাইলিশ পরচুলা বসানো হয়েছে। পুরোপুরি নিশ্চিত হতে তাই মুঠিবদ্ধ দু’হাতে চোখদুটো বারবার কচলাই। হ্যাঁ, এ তো আমাদের আফসু ভাইই; যে কি না আমার বহু রম্যগল্পের নায়ক। পরে আরো বিশেষ কিছু চিন্তা মাথায় যুক্ত হলো। আফসু ভাই তো সবে প্রাইমারি পাস। আইডিটি খুলে দিলো কে? রানা নয়তো!
রানা হলো আফসু ভাইদের বাড়িসংলগ্ন পাড়ার একমাত্র ছোট ভাই। একজন আইটি বিশেষজ্ঞ (বিশেষভাবে অজ্ঞ) হিসেবে এলাকায় রানার বিশেষ খ্যাতি রয়েছে। অন্য দিকে মেয়েপাগল আফসু ভাইয়ের সাথে রানার সম্পর্ক অত্যন্ত মধুর। আমি প্রায় সময়ই যখন আফসু ভাইদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়া হানিফ চত্বরে যাই তখন লক্ষ করি, বাঁশঝাড়-সংলগ্ন গাবগাছের মাচায় বসে তারা বিশেষ কোনো আলাপচারিতায় মগ্ন আছেন। কখনো কখনো দেখি মোবাইল নিয়ে তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা কী যেন বোঝার চেষ্টা করছেন।
পরিশেষে আমি তার মহামূল্যবান ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টটি গ্রহণ করলাম। পরের দিনই দেখি তিনি ফেসবুকের বিশেষ কিছু গ্রুপ থেকে আজব সব কথাবার্তায় প্রেমের ক্যাপশনে সাজানো আর অখ্যাত-কুখ্যাত বিভিন্ন মেয়ের ছবি সংবলিত পোস্টগুলো একটির পর একটি শেয়ার করে যাচ্ছেন। এই যেমন ধরুন, সবুজ ঘাসের বিছানায় বেশ সুন্দরী একটি মেয়ে বসে আছে। ছবির ক্যাপশনে লেখাÑ ‘যত সুন্দর করে লেখা যায় ভালোবাসার কথা, ততটা সুন্দর করে হয় না ভালোবাসা। ভালোবাসার কথা প্রকাশ করা সহজ, কিন্তু প্রমাণ করা খুবই কঠিন!’
পরের দিন আবার দেখি ধু-ধু বালুচরে আঁচল বিছিয়ে বসে আছে একটি গ্রাম্য মেয়ে। ক্যাপশনে লেখাÑ ‘এই পৃথিবী মরুভূমি কেহ কারো নয়। ভালোবাসার মাঝেই হবে তোমার আমার আসল পরিচয়।’
সর্বশেষ শেয়ার করা পোস্টটি যেমন ছিল তা হলোÑ বেশ পুরাতন টিনের বেড়াবেষ্টিত একটি ঘর। সেই ঘরের খাটটি চতুর্দিকে আর্টিফিশিয়াল কাগজের ফুল দিয়ে সাজানো। খাটের ঠিক মাঝখানে হলুদ শাড়ি পরা একটি মেয়ে দুঃখ দুঃখ ভাব নিয়ে পা গুটিয়ে বিরহচিত্তে বসে আছে। সেটির ক্যাপশনে লেখাÑ ‘বাসর ঘরে একা একা। আর লাগে না ভালো, একা একা বিছানাতে আঁধার লাগে ভালো। হায়রে স্বামী বিদেশ!’
একদিন রানার সাথে কথোপকথনে জানতে পারি, আফসু ভাই আবার প্রেমে পড়েছেন। কন্যার নিবাস আমাদের পাশের গ্রামেই। নাম কইতরি। কইতরি রানার নানা বাড়ির দিকের আত্মীয়। আসল কথা হলো, এই রানাই ফুসলিয়ে-ফাসলিয়ে ফেসবুকে কইতরির নানারকম ফটো দেখিয়ে আর বিভিন্ন মিথ্যে প্রচারণা চালিয়ে আফসু ভাইকে প্রেমদিওয়ানা করেছে। একদিন আমার সামনেই আফসু ভাইকে বানিয়ে বানিয়ে বলতে শুনিÑ ওহে আফসু ভাই, কইতরি যে তোমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে গো! সে যে তোমার জন্য এক্কেবারে দিল দিওয়ানা,উন্মাদ! ফেসবুকে তোমার ছবি দেখার পর থেকে সে শুধু তোমার কথাই বলছে। আজো নানীবাড়ি গিয়েছিলাম। এই দেখো, তোমাকে সে ‘আই লাভ ইউ’ লিখে একটি চিঠিও দিয়েছে।
এ কথা বলার পর মুহূর্তেই সেটি রানার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়। আদর করে সে সেটি বাংলা সিনেমার নায়কদের মতো বুকে জড়িয়ে ধরে উত্তরে বলতে থাকে, আই লাভ ইউ অলসো কইতরি!
এ দিকে দিন যায়, মাস যায়। আফসু ভাইয়ের ভালোবাসাও গাঢ় থেকে আরো গাঢ়তর হতে থাকে। নাওয়া-খাওয়ায় ভুলে সারা দিন সে কইতরির কথা ভাবে আর ফেসবুকে ঢুঁ মারে। আর পাগলের মতো রানাকে খুঁজে ফেরে। বলে, রানা, ভাই আমার। একটা ব্যবস্থা করো। আমি ওরে বিয়া করুম। এই জীবনে ওরে না পাইলে আমি কিন্তু শেষ। মাচার পাশে ওই গাবগাছে ফাঁস লমুÑ এ আমি বলে দিলাম।
আমরা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। হায় হায়, এ বলে কী! আফসু ভাইকে তো বাঁচাতে হবে। তবে শেষ পর্যন্ত চিন্তাভাবনা করে রানা আর আমার যৌথ সমন্বয়ে দুই সদস্যবিশিষ্ট একটি সিদ্ধান্ত কমিটি গঠন করি। সিদ্ধান্তে এই বলে উপনীত হই যে, অচিরেই কইতরির ফটো দিয়ে এটি ফেইক আইডি খোলা হবে এবং তা নিয়ন্ত্রণ করব আমি। সুতরাং কথা যেই কাজও সেই। চমৎকার একটি ফটো দিয়ে কইতরির আইডি খোলা হলো। এ দিকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাতেই আফসু ভাই ওপাশ থেকে বিপরীত মেরু চুম্বকের মতো চট করে একসেপ্ট করে ফেললেন। তারপরের সেই প্রেম কাহিনী বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার ইতিহাসের চেয়েও আরো বিশাল, আরো ব্যাপক। তত দিনে আমাদের প্রেমের জলও গড়িয়েছে বহুদূর। আফসু ভাইও দ্রুত বাংলা টাইপ শিখে গেছেন। পটু হয়ে উঠেছেন ইন্টারনেট দুনিয়ার সব কিছুতে। দিনের পর দিন তিনি হাই-হ্যালো থেকে শুরু করে মেসেঞ্জার-ইমোতে ছবিসহ নানান কিছু লিখে পাঠান আমাকে। কল করলেও চলতে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমার সুমিষ্ট মেয়েলি কণ্ঠে বানানো লাইলী-মজনুর প্রেমালাপ। তবে হ্যাঁ, এতসব কথা হয় কিন্তু অবশ্যই রাতে এবং তা গ্রামের নির্জন কোনো ক্ষেতের আইলে বসে। তবে একমাত্র শর্ত প্রযোজ্য হলোÑ কখনো ভিডিও কল দেয়া যাবে না।
সেই থেকে আফসু ভাই হয়ে আছেন আমার আদরের প্রেমিক আর আমি তাকে লণ্ডভণ্ড করতে এক ভণ্ড প্রেমিকা।