বন্ধুরে
- জোবায়ের রাজু
- ০১ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০
ইসলামগঞ্জ বাজারে এসে আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম। মরা একটি গাঁও-গেরামের ভেতরে এত বড় একটি অভিজাত বাজার থাকতে পারে, ধারণাই করতে পারিনি। এই পড়ন্ত দুপুরে আজ আমি এসেছি ইসলামগঞ্জে। এখানে মিঠুদের বাড়ি। ওর নিমন্ত্রণেই আজ এখানে এসেছি।
মিঠু আমার ফেসবুকের বন্ধু। ছেলে হিসেবে অমায়িক। দারুণ গান করে। নিজে গান গেয়ে সেটা ভিডিও করে ফেসবুকে ছাড়ে। আমি এই অখ্যাত শিল্পী মিঠুর গানের একনিষ্ঠ ভক্ত। ফেসবুকে ওর গানের ভিডিওগুলো ফলো করি আর গানের প্রশংসা করে রসালো সব কমেন্ট লিখি। আমার কমেন্টে মিঠু বেশ অনুপ্রাণিত হয়। এভাবেই ফেসবুকে ওর সাথে আমার মধুর সম্পর্ক। মিঠুর বাড়ি ইসলামগঞ্জে। ইসলামগঞ্জ আমার বাড়ি থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে। মিঠু প্রায়ই ইনভাইট করে, ‘ভাইয়া, একদিন আমার বাসায় আসো।’ যাবো যাবো করেও মিঠুর বাড়িতে যাওয়া হয় না। আজ এসেছি মিঠুর নিমন্ত্রণে ওদের ইসলামগঞ্জে। আজ কী একটা পারিবারিক আয়োজন চলছে মিঠুদের। মিঠুর আবদার ফেলতে পারিনি। ইসলামগঞ্জ বাজার থেকে মিঠুদের বাড়ি হেঁটে গেলে পাঁচ মিনিট লাগে। মিঠু ফেসবুকে আমায় সেই তথ্যই জানিয়েছে। খালি হাতে তো আর ওদের বাড়ি যাওয়া যায় না। তাই ভাবছি, বাজার থেকে কিছু কিনে নিয়ে যাবো।
এসে দাঁড়ালাম বিশাল এক ফল দোকানের সামনে। মানিব্যাগ খুলে দেখি টাকার সংখ্যা একেবারে ন্যূনতম। বেশ ক’দিন ধরে আর্থিক সঙ্কটে ভুগছি। মানিব্যাগে যে টাকা আছে, এ টাকায় ফল কেনা যাবে যদিও, কিন্তু সেটা যথেষ্ট নয়। নাম কুড়াতে গিয়ে অযথা বদনামের ভাগীদার হতে হবে। এসব ভাবতে ভাবতে দেখি, মাঝবয়সের এক ভদ্রলোক ফল দোকানে এলেন ফল কিনতে। দেখে মনে হচ্ছে, আমার মতো কারো বাড়ির আমন্ত্রিত অতিথি। দাওয়াত খেতে যাবেন বলে ফল দোকানে এসেছেন ফল কিনতে। ভদ্রলোকের বেশভূষায় বোঝা যায় তিনি প্রভাবশালী।
অনেক ফল কিনলেন ভদ্রলোক। আম, কমলা, আপেল, আঙুরসহ আরো কী কী! বিক্রেতা ভদ্রলোকের কেনা ফলগুলো ব্যাগে ভরে সাজিয়ে রেখেছেন। আচ্ছা, এখান থেকে একটি ব্যাগ নিয়ে ভোঁ-দৌড় দিলে কেমন হয়! হ্যাঁ, এটাই করতে হবে। একদা চুরিতে আমার বেশ দাপট ছিল। অন্যের মালামাল থাবা মেরে দৌড়ে ভেগে যাওয়াতে আমার জুড়ি ছিল না। অনেক দিন আগে এই অপকর্ম থেকে সরে এসেছি। আজ আবার একটি অপকর্ম করতে হবে।
ভদ্রলোক পকেট থেকে মানিব্যাগ খুলে টাকা বের করায় মনোযোগী হলেন। এদিক-সেদিক তাকিয়ে সুযোগ বুঝে সামনে রাখা ফলের ব্যাগগুলো থেকে বড় সাইজের যে ব্যাগটি, সেটি নিয়ে দিলাম দৌড়। পেছন থেকে ভদ্রলোক চেঁচাচ্ছেন, ‘এই আমার ফল...।’
ফল বিক্রেতাও চেঁচাচ্ছেন, ‘ওই শালা, দিনদুপুরে এইসব কী!’
কে শোনে কার কথা! ফলের ব্যাগ নিয়ে আমার দৌড়ের গতি বাড়তে থাকে। কে পায় আর আমায়!
২.
মিঠুদের বাড়ি এসে দেখি সে এক এলাহি কাণ্ড। জানাই ছিল না ওরা এত ধনী। ধনী মিঠুদের আজ প্রোগ্রাম মূলত ওর বোন মিতার এনগেজমেন্ট। দলে দলে আমন্ত্রিত অতিথিরা আসছে। মিঠুর সাথে কুশল বিনিময়ের পর আমার হাতে বিশাল ফলের ব্যাগ দেখে সে বলল, ‘আহা কী দরকার ছিল এসব আনার।’
প্রায় ৩০ মিনিট পর এক ভদ্রলোকের সাথে মিঠু আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, ‘ইনি আমার মামা।’
মিঠুর মামার দিকে তাকিয়ে আমি ভূত দেখার মতো চমকে উঠি। এ কাকে দেখছি! ইসলামগঞ্জ বাজারে এই ভদ্রলোকের ফলের ব্যাগ থাবা মেরে আমি পালিয়ে এসেছি। তিনি আমার দিকে হাঁ করে অপলক তাকিয়ে আছেন। ভয়ে আমার সারা শরীর কাঁপছে। মনে হচ্ছে এখনই মাথা ঘুরে পড়ে যাবো। মিঠু তার মামাকে বলল, ‘মামা, এভাবে কী দেখছেন ভাইয়াকে! চেনা চেনা লাগছে?’
ভদ্রলোক আমাকে বললেন, ‘আচ্ছা তুমি কি ইসলামগঞ্জ বাজারে ফল দোকান থেকে আমার ফলের ব্যাগ থাবা মেরে দৌড়ে পালিয়েছিলে?’
ভদ্রলোকের কথা শুনে মুহূর্তেই আমি ঘামতে শুরু করি। জীবনে এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি মনে হয় আজই প্রথম পড়েছি। কী হবে এখন! মিঠুর সামনে এই লজ্জা কোথায় রাখব! মিঠু বলল, ‘এসব কী বলছেন মামা! ভাইয়া নয়, অন্য কেউ হবে। আপনার বয়স হয়েছে। তাই ভুল করছেন।’
মিঠুর কথায় আমি একটু সাহস পেলাম। তবু কাঁপা গলায় বললাম, ‘জি আংকেল, মিঠু ঠিক বলেছে। আমার মতো দেখতে অন্য কেউ হবে। আপনার বয়স হয়েছে তো, এসব বয়সের সমস্যা।’
ভদ্রলোক কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললেন, ‘হবে হয়তো। তুমি কিছু মনে করো না বাবা।’
স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম আমি। বড় বাঁচা বাঁচলাম।