২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

চাচার পাতে ডাল দেয়া

-

আঞ্চলিক ভাষার কিছু কিছু কথা সত্যি খুব মজার ও বিনোদনপূর্ণ হয়ে থাকে। একটা ক্লাসে যেমন ভালো, মন্দ, মিডিয়াম, ফাজিল কিংবা গবেট টাইপের ছাত্র থাকে। ঠিকই একইভাবে একটা গ্রাম, একটা সমাজ মানেই কিছু ভিন্ন ভিন্ন রুচির, সৃজনশীল কিছু স্বভাবের মানুষ। এগুলো থাকবেই। আর থাকাই স্বাভাবিক। তেমনই এক দল মানুষ হলো চাচার পাতে ডাল দেয়া স্বভাবের। অন্যের কাঁধে চাপিয়ে নিজের বিভিন্ন প্রয়োজন বা অধিকার লুটে নেয়াই এই স্বভাবের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
আমার এক কাকা অন্যের ক্ষেতখামারে কাম কাজ করে সংসার চালান। অভাব-অনটনের সংসার। বাড়িতে পেট পুরে যে দুই মুঠো খাবেন সেটা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই তো অন্যের ক্ষেতে গেলে একটু পেট পুরে খাওয়ার চেষ্টা চালান। যেমন সবাই এক সাথে খেতে বসলে চাচা আমার বারবার সবাইকে বলতে থাকেন ভাত নাও, তরকারি নাও। আমি উপস্থিত। চাচা এক দিন এমন করছেন। বারবার একে ওকে বলছেন, ভাত তরকারি একবারে নিয়ে ফেলো। কাউকে বলছেন তরকারি ভালো হয়ে এইটুকু নাও। আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। ছয়-সাত জন খাচ্ছে কেউ কোনো কথা বলছে না কিন্তু কাকা এত কথা বলছে কেন? তাও আবার একই কথা বারবার। পরে একটু অপেক্ষা করেই বুঝতে পারলাম। আসলে কাকার এমনটি করার উদ্দেশ্য একটাই যে সবাইকে অনুরোধ করতে করতে যদি কেউ বলে ফেলেন যে তুমি নিয়ে ফেলো সবটুকু তাহলে তো কাকার প্লাস পয়েন্ট। আর কেউ যদি সাড়া না দেন তাহলে কাকা আপনা আপনি বলবেন কেউই যখন নেবে না তখন আমিই নিয়ে খেয়ে ফেলি। না হলে তো নষ্ট হবেনে শুধু শুধু।
ঈদের ছুটিতে বাড়িতে লোকজন সবাই আসে। চাচাতো ভাই বেল্টু। বয়স ৩৭-৩৮ হবে। ব্যাচেলর। শুনি শহরে শুধু এর সাথে ওর সাথে। দাদীর বয়সী মহিলাদের সাথে প্রেম করে বেড়াই। বিয়ে করার জন্য নানাভাবে সংগ্রাম চালাই কিন্তু বাড়ি থেকে কোনো পদক্ষেপই নিতে চাই না। ঈদের ছুটিতে বাড়ি এসে এবার অনেকটা ধানের হাটে ওল নামাবার মতোই ভাই ছোট ছোট স্কুলে পড়া চাচাতো ভাইদের জোরে জোরে বলছিল কী এত বড় হয়েছিল বিয়ে করবি না তোরা। বুড়ো হয়ে গেলে বিয়ে করবা নাকি। জীবন তো একটাই নাকি। সকাল সকাল বিয়ে করে ফেলো সবাই। বিষয়টি প্রথমে না বুঝলেও পরে বুঝতে পারলাম যে আসলে ভাইয়ের এ কথার সারমর্ম কী? ভাই আসলে নিজের বিয়ের কথা সরাসরি বাড়িতে বলতে পারছেন না তাই তো অন্যের কথা বলে চাচার পাতে ডাল দেয়ার মতো নিজের বিয়ের কথাটা বোঝাতে চাচ্ছেন।
এসএসসি পরীক্ষার আগে বেশ কয়েক দিন স্কুলেই এক স্যারের কাছে অংশ প্রাইভেট পড়তাম কয়েকজন। রোজ স্কুল ছুটির পর প্রাইভেট পড়তাম আমরা। স্যার বড্ড লোভী মানুষ ছিলেন। টাকা...টাকা...আর টাকা ছাড়া কিছু চিনতেন না। প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার প্রথম দিনই শপথ পড়িয়ে নিতেন যে মাস পূর্ণ হওয়ার একদিন আগে টাকা পরিশোধ করতে হবে। ফকিরের মতো টাকা চাইতে পারবেন না। স্যার যে শুধু লোভী ছিলেন সেটিই নয়। স্যার বড্ড ফাঁকিবাজও ছিলেন। সেটি অবশ্য তখন বুঝতাম না। অনেক পরে বুঝেছি। স্যার প্রায় প্রতিদিনই পড়াতে গিয়ে একটা দুইটা অঙ্ক করেই বারবার বলেন, আমি বুঝি তোমাদের অনেক কষ্ট হয়ে যায়। সারাদিন ক্লাস করে ছুটির পর আবার প্রাইভেট পড়তে কার ভালো লাগে? সব কিছুরই একটা সীমা থাকে তাই না? দাঁড়াও তোমাদের বেশি কষ্ট দেবো না। কয়েকটা অঙ্ক করেই ছুটি দিয়ে দেবো।
বারবার এমনটি বলার পর যদি আমাদের কেউ একজন বলে ফেলতেন যে স্যার ভালো লাগছে না। স্যার তখন ছুটি দিয়ে দিতেন। আসল বিষয়টি হলো স্যার আমাদের জন্য যে সমবেদনা প্রকাশ করতে সেটা আসলে ছিল একটা অজুহাত। কেননা স্যারের নিজেরই ভালো লাগত না। তাই তো নিজের দোষ ধামাচাপা দিয়ে চাচার পাতে ডাল দেয়ার মতো আমাদের ওপর দোষ চাপিয়ে রোজ ফাঁকিবাজি করতেন।

 


আরো সংবাদ



premium cement