২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

শরবত কাহিনী

-

কলিংবেলের শব্দ শুনে দরজা খোলার পর বয়স ভারী লোকটাকে দেখে চিনতে না পেরে আগ্রহী গলায় প্রশ্ন করি, ‘আপনার পরিচয়?’
ম্লান হেসে তিনি বললেন, ‘আমি জামান সাহেব। তুমি রঞ্জু না?’
চট করে বললাম, ‘ওহ আঙ্কেল, আসুন আসুন। বাবার কাছে আপনার কত গল্প যে শুনি।’
ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসির আভা ছড়িয়ে দিয়ে জামান সাহেব ঘরে ঢুকে সোফায় গা এলিয়ে দিলেন। বললেন, ‘বাসায় কেউ নেই মনে হচ্ছে।’
আমি হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে বললাম, ‘ঠিক ধরেছেন। বাবা সবাইকে নিয়ে কালিকাপুর গেছেন। ফুফুর বাড়ি।’
সোফার বালিশ কোলে নিতে নিতে জামান সাহেব বললেন, ‘তাহলে চলে যাই?’
বললাম, ‘থাকুন না, আমার সাথে গল্প করুন। বাবা তো সব সময় আপনার গল্প শোনান আমাদের। আপনার নাকি কঠিন আকারের ডায়াবেটিস?’
নেতিয়ে পড়া গলায় জামান সাহেব বললেন, ‘হ্যাঁ রঞ্জু। ডায়াবেটিস আমার জীবনের সব কেড়ে নিয়েছে। বেশ কন্ট্রোলে চলতে চলতে এখন বিরক্ত হই।’
এই হলেন জামান সাহেব। আমার বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। দীর্ঘ দিন শহুরে জীবনের ইস্তফা দিয়ে গ্রামে এসে যখন নিঃসঙ্গতায় ভুগছেন। তারপর থেকে আমার নীতিবান বাবার সাথেই গড়েছেন বন্ধুত্ব। জামান সাহেব তার ৬০ বছর বয়সের বিভিন্ন গল্প বাবার কাছে তুলে ধরেন। সে গল্প কেমন, বাবা আমাকে আর মাকে ব্যাখ্যা করেন। গল্পে গল্পে জানলাম তার ভয়াবহ ডায়াবেটিস। একদা মিষ্টিজাতীয় খাবারকে গুরুত্ব দিতেন। বেশ কয়েক বছর ধরে ডায়াবেটিসের কারণে এসব খাবার থেকে বিরত আছেন।
২.
সোফায় বসে থাকা জামান সাহেবের সাথে আমার বিভিন্ন মুখরোচক গল্প যখন তুঙ্গে, তখন মনে হলো জামান সাহেবকে কিছু খেতে দেয়া দরকার। অন্তত ভদ্রতার খাতিরে।
আমি তার জন্য আপ্যায়নের প্রস্তুতি নিচ্ছি জেনে তিনি অনুনয় সুরে বললেন, ‘না না রঞ্জু, কিছু লাগবে না। তুমি তো তোমার বাবার মতো বেশ আন্তরিক। কিছু এনো না বাবা। আমি ডায়াবেটিসের রোগী। খানাপিনায় খুব সতর্ক।’
জামান সাহেবের কথাকে সেভাবে গুরুত্ব না দিয়ে কিচেনে গেলাম নাশতাপানির ব্যবস্থায়। ভদ্রলোক আজ প্রথম এখানে এসেছেন, খালি মুখে ফিরে যাওয়া শোভনীয় নয়।
কিন্তু কিচেনে এসে নাশতাজাতীয় কোনো খাবারের সন্ধান পাচ্ছি না। হায়, আজ ঘরে কিছুই নেই। এখন জামান সাহেবকে কী খেতে দেয়া যায়! ফ্রিজ খুলেও বিফলে গেলাম। কোনো ফলফলাদি নেই। আহারে, কী খেতে দেবো জামান সাহেবকে!
ফিরে এলাম কিচেনে। হলুদের গুঁড়োর বয়াম আর গুঁড়ো মরিচের বয়াম চোখে পড়ল। আচ্ছা হলুদের গুঁড়োকে গ্লাসের পানিতে গুলিয়ে ট্যাংক শরবত সাজিয়ে আর মরিচের গুঁড়োকে একই নিয়মে গ্লাসের পানিতে গুলিয়ে রুহ আফজা শরবত সাজিয়ে জামান সাহেবের সামনে নিলে কেমন হয়! জানি তিনি ডায়াবেটিসের কারণে মিষ্টি এসব শরবত খাবেন না। তবুও এ কাজটি করলে তিনি অন্তত বলতে পারবেন আমি তাকে সমাদর করেছি। হ্যাঁ, এটাই করতে হবে।
৩.
আলাদা আলাদা গ্লাসে হলুদের গুঁড়োকে ট্যাং শরবত সাজিয়ে আর মরিচের গুঁড়োকে রুহ আফজা সাজিয়ে জামান সাহেবের সামনে টি-টেবিলে রেখে বললাম, ‘নিন আঙ্কেল। ট্যাংক শরবত আর রুহ আফজা শরবত এনেছি। কোনটা খাবেন খান।’
মুচকি হেসে তিনি বললেন, ‘বাবা, এত কষ্ট করতে গেলে কেন। আমি তো এসব খেতে পারব না। ডায়াবেটিস।’
আমি বললাম, ‘আরে নিন আঙ্কেল, কিচ্ছু হবে না।’
আমি ধরেই নিয়েছি জামান সাহেব ডায়াবেটিসের কারণে এসব খাবেন না। কিন্তু আমাকে অবাক করিয়ে দিয়ে তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে, যখন কষ্ট করে শরবত বানিয়ে এনেছ আঙ্কেলের জন্য, একটু খাই তবে।’
ওমা, বলে কী! জামান সাহেব সত্যি সত্যিই খাবেন। কিন্তু এটা তো অর্জিনাল শরবত নয়। জামান সাহেব হলুদের গুঁড়োর শরবতের গ্লাস হাতে নিয়ে বললেন, ‘আমার বড় ছেলে আমেরিকা থেকে ট্যাং শরবত পাঠাত। রোগের কারণে অনেক দিন খাওয়া হয় না।’ বলেই তিনি এক চুমুক মুখে দিয়ে চেঁচিয়ে বললেন, ‘ওয়াক থু! এটা কী শরবত রঞ্জু। মেয়াদোত্তীর্ণ নাকি?’
আমি কাঁচুমাচু করে বললাম, ‘ইয়ে মানে...।’
জামান সাহেব হলুদের গুঁড়োর শরবতের গ্লাস রেখে দিয়ে বললেন, ‘এটার সম্ভবত মেয়াদ শেষ। দাও, রুহ আফজা খাই।’
সর্বনাশ! কী হবে এখন? জামান সাহেব যে ঝালে মরে যাবেন। এমনিতে আমি মরিচের গুঁড়োর পরিমাণ বেশি দিয়েছি, যাতে শরবতের রঙ গাঢ় হয়।
জামান সাহেব রুহ আফজার শরবত ভেবে মরিচের শরবতের গ্লাস মুখে এক চুমুক দিতেই বিকট গলায় বললেন, ‘আল্লাহ গো এটা কী, এত ঝাল! রুহ আফজা ঝাল হয় আগে তো জানতাম না। আহ উহ। আমার জিহ্বা পুড়ে শেষ।’
জামান সাহেব অস্বস্তিতে ভুগছেন আর আমার নার্ভাসনেস ক্রমেই বাড়ছে।


আরো সংবাদ



premium cement