যত যানজট তত ঘুম!
- মোহাম্মদ অংকন
- ০৮ নভেম্বর ২০১৮, ০০:০০
ইউনুস সাহেব একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এক যুগ ধরে চাকরি করেন। প্রতিষ্ঠানটি মিরপুরে অবস্থিত হলেও তিনি বউ-বাচ্চা নিয়ে উত্তরায় শ্বশুরের বাসায় থাকেন। তিনি প্রতিদিন সকাল ৮টায় অফিসের দিকে রওনা করে ১০টা বা তারও কিছু সময় পর পৌঁছেন এবং বিকেল ৫টায় অফিস শেষে বাসার দিকে রওনা করে ৮টায় বা তারও কিছু সময় পর পৌঁছেন। এ দুই সময়ে তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষে পরিণত হয়ে যান। যখন বাসা থেকে অফিসে যান তখন জীবনের কোনো প্যারা তাকে আক্রমণ করতে পারে না। গিন্নির প্যানপ্যানানি, বাচ্চা-কাচ্চাদের ঘ্যানঘ্যানানি থেকে মুক্ত হতে পেরে তিনি যেন অঢেল সুখ বোধ করেন। কিন্তু এত সুখ কি শুধু বউ-বাচ্চা থেকে রেহাই পেয়ে উপভোগ করেন? না। রোজ ৮টায় বাসা থেকে বের হয়ে পাবলিক বাসে ওঠা মানেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকা পড়ে যাওয়া। আটকা পড়া মানেই ইউনুস সাহেবের দু’দণ্ড বেশি ঘুমানোর সুযোগ তৈরি হওয়া। অফিস টাইম পার হলেই অফিস থেকে কল আসে।
‘ইউনুস সাহেব, আপনি কোথায় এখন?’
‘আমি রাস্তায়! আজো যানজটে আটকা পড়েছি!’
এ কথাটি প্রতিদিনই বলেন এবং তা বলে ইউনুস সাহেব যেমন দায়মুক্ত হন, তেমনি সুখ উপভোগের সুযোগ খোঁজেন। প্রশ্ন হতে পারে না, ইউনুস সাহেব কি বাসায় ঘুমান না?
হুম! ঘুমাতে চাইলেও পারেন না। বউয়ের জ্বালায় কোনো দিনও ৬টার পর ঘুম থেকে উঠতে পারেন না। স্বামীকে যেন টেনে তোলে বাচ্চা-কাচ্চাদের সাথে। তাই তার চোখে ঘুম টলমল করে। যখনই যানজট বেঁধে যায়, তখনই খুশিতে তিনি প্রার্থনা শুরু করে দেন।
‘যানজট তুমি মহান!
তোমার কারণে আমি প্রতিদিন বাসে চলতে চলতে
শান্তি করে দু’দণ্ড চোখ বন্ধ করতে পারি!
যানজট তুমি মহান!’
এভাবে প্রার্থনা শেষ হতেই তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। নাক থেকে তীব্র আওয়াজ আসতে থাকে। মস্তবড় পেট জামার বোতাম ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়ে। মাথাটা পাশে বসা যাত্রীর গায়ে গড়িয়ে পড়ে। তাতে তার কোনো হুঁশ নেই। মিরপুর আসতে আসতে এক থেকে দেড় ঘণ্টা ঘুমানো হয়ে যায় তার। কন্ডাক্টর যখন হাঁক ছাড়েনÑ ‘এই মিরপুর, মিরপুর’ তখন ইউনুস সাহেব থতমত করে ভাড়া দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে অফিসের দিকে দৌড় মারেন। এমন আরাম-আয়েশময় যানজট পেয়ে পৃথিবীতে বোধ হয় এ মানুষটিই খুশি হন, তা তার প্রতিদিনের আচার-আচরণে উপলব্ধি করা যায়।
ঘড়ির কাঁটা যখন ৫টার ঘণ্টায়, তখন ইউনুস সাহেব অফিস শেষ করে বাসার দিকে রওনা করেন। এ সময় প্রত্যেকেই বাসায় ফেরেন বলে যানজট থাকা স্বাভাবিক। প্রতিদিন এ রাস্তায় গাড়ি দু-চার মিনিট চলতে না চলতেই যানজটের খপ্পরে পড়ে যায়। ইউনুস সাহেবের মুখে তখন হাসির রেশ দেখা যায়। একটা খুশির হাসি। সারা দিনের কান্তিময় লোকটার চোখে যেন ঘুম এসে ঘণ্টা বাজিয়ে যায়। রাতের ঘুম সন্ধ্যায় পুষিয়ে নেন। কেননা, সকালে যেমন স্ত্রীর জ্বালায় ৬টার আগেই উঠতে হয়, তেমনি রাতে স্ত্রীর সিরিয়াল দেখার শব্দে, বাচ্চা-কাচ্চাদের মোবাইলে গেম খেলার শব্দে রাত ২টার আগে কোনো দিন ঘুমাতে পারেন না তিনি। তাই পরিবহনে ঘুমানোর সুযোগ পেয়ে হাতছাড়া করা বড়ই বোকামি, তা ইউনুস সাহেব ভালো করেই জানেন এবং এ অভিজ্ঞতা বিয়ের পরপরই অর্জন করেছেন।
কয়েক মিনিট অতিক্রম হতেই তার স্ত্রীর ফোন আসে।
‘হ্যাঁ গো শুনছো, গাড়ি থেকে নেমে বাজার-সদাইগুলো করে এনো। ঘরে কিচ্ছু নেই। রান্নাবান্না করতে হবে রাতের আগেই। আজ বেশ কয়েকটা জমজমাট সিরিয়াল দেখতে হবে। তুমি তো আর এসব বুঝবে না কখনো!’
এমন সময় স্ত্রীর সাথে উচ্চগলায় কথা বলা ঠিক হবে না যেনে ইউনুস সাহেব উত্তর করেনÑ ‘দেখো গিন্নি, আমি তো যানজটে পড়েছি। আসতে দেরি হবে। ওদের ঘরে রেখে তুমিই একটু বাজারগুলো নিয়ে আসো। আমার দেরি হওয়া মানে তোমার সিরিয়াল দেখা মিস হওয়া!’
প্রতি উত্তরে স্ত্রী কী বলেন তা আর না-ই বা জানা হলো। তবে ইউনুস সাহেব প্রার্থনা শুরু করে দেন।
‘যানজট তুমি মহান!
তোমার কারণে আমি প্রতিদিন বাসে চলতে চলতে
শান্তি করে দু’দণ্ড চোখ বন্ধ করতে পারি!
যানজট তুমি মহান!’
অতঃপর ইউনুস সাহেব ঘুমিয়ে পড়েন। হাত-পা সিটের ওপর ছড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়েন যেন মৃত ব্যক্তি। তার পাশে কেউ বসে না। তার আয়েশের পরিমাণ ঢের বেড়ে যায়। গাড়ি চলছে কি চলছে না, কোথায় এলাম না এলাম, তার কোনো খোঁজ নেই। যখন কানে আসে ‘এই উত্তরা! উত্তরা!’, তখন তিনি জেগে উঠে গাড়ি থেকে নেমে বাসার দিকে রওনা করেন। ততণে রাত ৮টা বেজে যায়।
বাসায় পৌঁছে স্ত্রীর মুখ থেকে শুনতে হয় নানা অকথা-কুকথা। ইউনুস সাহেব সব কিছু পানি দিয়ে গিলতে থাকেন আর ভাবতে থাকেনÑ ‘এ কারণে যানজটের মুহূর্তগুলো আমার সবচেয়ে প্রিয়। সবচেয়ে সুখের। সবচেয়ে শান্তিময়। যানজট, কেন তুমি দীর্ঘায়িত হও না অফিস কিংবা বাসার সময়ের মতো। তবুও যানজট তুমি মহান! তোমার কারণে বাসে শুধু দু’দণ্ড ঘুমাতেই পারি।’