৩০ জানুয়ারি ২০২৫, ১৬ মাঘ ১৪৩১, ২৯ রজব ১৪৪৬
`

পাকিস্তানি টিভি সিরিজ যে কারণে বাংলাদেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে

বাংলাদেশে যেভাবে ‘জনপ্রিয়’ হয়ে উঠেছে পাকিস্তানি টিভি সিরিজ - ছবি : সংগৃহীত

ভারতের হিন্দি বা বাংলা, তুর্কি, কোরিয়ান সিরিজের পাশাপাশি বাংলাদেশের টেলিভিশন দর্শকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে পাকিস্তানি টিভি সিরিজ।

সামাজিক মাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুকে বেশ কিছু বড় গ্রুপ তৈরি হয়েছে উর্দু ভাষার পাকিস্তানি সিরিজের বাংলাদেশী দর্শকদের নিয়ে। যাদের অধিকাংশই নারী এবং বয়সে তরুণ।

তবে বাংলাদেশে পাকিস্তানের টিভি চ্যানেল দেখা যায় খুব কম। মূলত ভিডিও শেয়ারিং প্লাটফর্ম ইউটিউব আর দু’একটা আন্তর্জাতিক ওটিটির মাধ্যমেই দর্শক তৈরি হয়েছে পাকিস্তানি টিভি সিরিজের।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৪ বছর ধরে পাকিস্তানের সাথে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান খুব একটা হয়নি। ভাষাগত সমস্যাও একটা কারণ।

তবে এখন টিভি সিরিজ উপভোগের ক্ষেত্রে সেই ভাষাগত সমস্যা খুব একটা বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। নিয়মিত দর্শকদের দাবি, ভারতের হিন্দী ভাষার সাথে উর্দু কিছু শব্দগত পার্থক্য রয়েছে। তাই যারা নিয়মিত হিন্দী ভাষায় নানাধরনের কনটেন্ট দেখে অভ্যস্ত, তাদের কাছে উর্দু ভাষা বুঝতে বেগ পেতে হয় না।

এছাড়া সবগুলো সিরিজেই থাকে ইংরেজি সাব-টাইটেল। এ কারণে উর্দু বা হিন্দি না বুঝলেও চলে।

বাংলাদেশে ৯০ -এর দশক থেকে হিন্দি সিরিয়ালের জনপ্রিয়তা দেখা যায়, এরপর তুর্কি এবং কোরীয় সিরিজের জনপ্রিয়তা তৈরি হয়। তবে উর্দু নাটকের জনপ্রিয়তা খুবই সাম্প্রতিক। দর্শকদের বাইরে এটি নিয়ে তেমন আলোচনাও দেখা যায় না।

কিন্তু ভারতীয়, তুরস্ক বা কোরীয় নাটকের পাশাপাশি পাকিস্তানি নাটক কিভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠল?

কবে থেকে জনপ্রিয়?
ধারণা করা হয়, ২০১৫ সাল বা তারও আগে থেকে এ দেশের মানুষ পাকিস্তানি টিভি সিরিজ দেখা শুরু করেন।

পাকিস্তানি সিরিজ নিয়ে বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচালিত একটি গ্রুপের এডমিন মোসাম্মাৎ আলবিয়া জানান, আগে অল্প কিছু দর্শক দেখলেও এখন বাংলাদেশের অনেক দর্শক পাকিস্তানি সিরিজ উপভোগ করেন। তবে এটার সঠিক কোনো সংখ্যা জানা যায়নি।

ফেসবুকে প্রায় সোয়া দুই লাখ সদস্যের ‘পাকিস্তানি ড্রামা পোস্টিং বিডি’ গ্রুপের এই এডমিন মনে করেন, করোনার সময় মানুষ যখন ঘরে বসে ছিল, তখন থেকেই পাকিস্তানি ড্রামার দিকে ঝুঁকেছে। ওই সময়ই তারা প্রতিষ্ঠা করেন গ্রুপটি।

‘পাকিস্তানি টিভি সিরিজ নিয়ে অনেক আলোচনায় নিশ্চিত হয়েছি ওই সময় মানুষ দেখা শুরু করে। তখন পুরোনো অনেক সিরিজই নতুন করে আলোচনায় আসে এবং গ্রুপে লেখালেখি হয়।’ বলেন আলবিয়া।

তিনি মূলত দুটি ফেসবুক গ্রুপ চালান। একটি প্রাইভেট আরেকটি পাবলিক। এরমধ্যে পাবলিক এছাড়া পাকিস্তানি সিরিজ নিয়ে কমপক্ষে হাফ ডজনের বেশি গ্রুপ সচল আছে বলে জানান আলবিয়া। সবগুলো গ্রুপেই নতুন সিরিজ, নতুন পর্ব ও তারকাদের নিয়ে নিয়মিত আলোচনা হয়।

ফেসবুকে এ ধরনের বেশ কিছু গ্রুপের সদস্য সংখ্যা লক্ষাধিক।

যারা এসব গ্রুপে সিরিজ নিয়ে আলোচনা করেন তারাই মূলত দর্শক। তাদের কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, দুই দেশের ধর্ম এক হওয়ার কারণে অনেকেই এসব সিরিজ দেখতে বেশ আগ্রহ দেখান।

এটা ছাড়াও বেশ কিছু কারণ রয়েছে দর্শক তৈরি হওয়ার। যারা দেখেন এমন কয়েকজন জানিয়েছেন ধর্মীয় অনুভূতি ও গল্প বলার ধরনই মূলত আগ্রহ তৈরির পেছনে ভূমিকা রেখেছে।

কী থাকে গল্পে? কেন দেখেন দর্শক?
পাকিস্তানি টিভি সিরিজে মূলত গল্প প্রেম, বিচ্ছেদ আর পারিবারিক নানা টানাপোড়েন নিয়ে নির্মাণ করা হয়। তুমুল জনপ্রিয় সিরিজ ‘হামসাফার’ তার বড় উদাহরণ।

২০১১ সালে মুক্তি পায় ‘হামসাফার’। গল্পে দেখা যায়, পারিবারিক কারণে বাধ্য হয়ে বিয়ে করতে হয় আজহার ও খাইরাদকে। এমন গল্পে অভিনয় করেছেন ফাওয়াদ খান ও মাহিরা খান।

পাকিস্তানি সমাজের শ্রেণি বৈষম্য এবং নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়গুলো চমৎকারভাবে তুলে ধরা হয়েছে ‘জিন্দাগি গুলজার হ্যায়’ সিরিজে।

এছাড়া ‘মেরে পাস তুম হো’। মিষ্টি প্রেমের গল্প নিয়ে কমেডি ঘরানার সিরিজ ‘সুনো চান্দা’, ‘ভেরি ফিল্মি’, ‘বারজাখ’, ‘কাভি ম্যায় কাভি তুম', 'পারিজাদ' নামের সিরিজগুলো এদেশে জনপ্রিয়।

তবে এইসব টিভি সিরিজ বেশিভাগই পাকিস্তানি টিভিতে প্রচারের পর আপলোড হয় ইউটিউবে। তারপরই দেখেন এ দেশের দর্শক। জানা যায়, ওই দেশের 'হাম টিভি', 'আরি ডিজিটাল', 'হারপাল জিও' ও 'গ্রীন এন্টারটেইনমেন্ট' চ্যানেলগুলোতে এসব সিরিজ বেশি দেখা যায়।

এসব চ্যানেলে একেকটি সিরিজের এপিসোডে মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউ রয়েছে।

'গল্পটা বেশি ভালো লাগে, একেক ড্রামার আলাদা কনস্পেট থাকে, পোশাক-আশাক অত্যান্ত মার্জিত, সবার অভিনয়গুলো একদম রিয়েলস্টিক লাগে এবং সব ড্রামা সাথে একেকটা গান থাকে যেটা সিরিয়ালে আলাদা ফ্লেবার এড করে' বলছিলেন পাকিস্তানি নাটকের নিয়মিত দর্শক সানজিদা আক্তার জারা।

আরেকজন নিয়মিত দর্শক আহসান আহমেদ আনাস জানান, তিনি আগে নিয়মিত ভারতীয় ও তুর্কির সিরিজ দেখতেন। এখন পাকিস্তানি ড্রামার ভক্ত হয়ে গেছেন। গত বছর তিনি কমপক্ষে ১০টির বেশি সিরিজ দেখেছেন বলে জানান।

জনপ্রিয় হওয়ার আরো একটি কারণ জানান গ্রুপের এডমিন আলবিয়া। এসব সিরিজ খুব অল্প এপিসোড বা পর্বের হয়ে থাকে। কোনোটা ১৫, কোনোটা ২০ বা ৩০ হয়ে থাকে।

নিয়মিত দর্শক নিকিতা নুসরাত নিয়মিত বিভিন্ন দেশের সিরিজ উপভোগ করেন। বিশেষ করে কোরিয়ান, টার্কিশ, চাইনিজ ড্রামা প্রচুর দেখেন তিনি। তবে সহজেই অন্য দেশের চেয়ে পাকিস্তানি সিরিজ আলাদা করেন তিনি। 'তাদের অভিনয়, সেট অনেক স্বাভাবিক বা ন্যাচারাল হয়। নিজেদের কাহিনীর সাথে রিলেট করা যায়।' বলেন তিনি।

ভারতীয় টিভি সিরিজের সাথে পাকিস্তানি সিরিজের 'বেসিক' একটা পার্থক্য আছে বলে জানান তিনি। তার মতে, 'বেসিক পার্থক্য হচ্ছে মেকআপ, ন্যাচারাল কাহিনী দেখানোর কৌশল, ইমোশন। পাকিস্তানি গায়কদের গান দেখলে বুঝা যায় তারা কত আবেগ নিয়ে গান গায়।'

বেশিভাগ সিরিয়ালে পারিবারিক সম্পর্কে জটিলতা বেশি দেখানো হয় বেশি বলে দাবি করেন আরেক দর্শক তাবাসসুম তুবা। 'তথাকথিত ঝগড়াঝাটি, শয়তানি নেই, সিরিয়ালগুলোতে যা থাকে আরকি। পাকিস্তানি সিরিজ অনেক ভালো লাগে। তারা মানুষের অনুভূতিগুলোর প্রতিচ্ছবি ভালো করে দেখাতে পারে। মেকাপ, গেটাপ, পোশাক, কথা বলা সবই শালীন। মন্তব্য করেন তুবা।

'জিন্দেগি গুলজার হে' সিরিয়ালটা দেখে তার এমন অনুভূতি বলে জানান তিনি।

দর্শক কারা?
বিভিন্ন গ্রুপ ও দর্শকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, টিনএজ বয়সী দর্শকই বেশি দেখেন পাকিস্তানি টিভি সিরিজ। তবে তাদের পাশাপাশি সব বয়সী দর্শক বিনোদনের ক্ষুধা মেটান এই সিরিজ থেকে।

আলবিয়া বলেন, 'এই সিরিজের গল্প ও পোশাকের শালীনতার কারণে পরিবারের সবাই মিলে উপভোগ করতে পারে। তবে বয়সের দিক থেকে অপেক্ষাকৃত তরুণরা বেশি দেখেন।'

তবে পাকিস্তানি ড্রামা সিরিজ নিয়ে গড়ে ওঠা বাংলাদেশী গ্রুপগুলোর দাবি, এসব সিরিজের বেশিভাগ দর্শক ঢাকা ও চট্টগ্রামের। যারা অনেকেই হিন্দী ও উর্দু ভাষার সাথে পরিচিত বা জানেন।

বাংলাদেশে পাকিস্তানি টিভি সিরিজ জনপ্রিয় হওয়া প্রসঙ্গে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল বাংলা ভিশনের অনুষ্ঠান প্রধান তারেখ আকন্দ বলেন, ‘এখন ফ্রি স্ট্রিমিং এর সময়। তাই দর্শক সহজেই সবকিছু দেখতে পারেন। এ কারণে জনপ্রিয়ও হতে পারে।’

তিনি আরো বলেন, ‘এসব কনটেন্ট দেখার জন্য ইন্টারনেট একসেস এবং গ্যাজেট লাগবে। এসব সুবিধা নিশ্চিত করার পর তবেই দেখা যায় এসব সিরিজ। তবে জনপ্রিয় হলে অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে ভালোমন্দ বলার দায়িত্ব দর্শকদের। আমি বলতে পারি, দর্শকদের বিনোদনের খোরাক জোগাতে ভূমিকা রাখছে এসব সিরিজ।’

জনপ্রিয় অভিনেতা ও নাট্য পরিচালক সালাহউদ্দিন লাভলু বলেন, ‘একসময় আমাদের সিরিয়ালগুলো জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু এখন সেটা কমে গেছে। তবে আমাদের দেশের মানুষ যদি বিদেশী সিরিয়াল দেখেন সেটা দুর্ভাগ্যজনক।’

তবে যেহেতু ইউটিউবে দেখে তাই কেউ কাউকে নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ নেই। আমরা চাইবো আমাদের সিরিয়াল মানুষ দেখুক। মন্তব্য করেন সালাহউদ্দিন লাভলু।

তারকারাও সমান জনপ্রিয়
সিরিজের সূত্র ধরে বাংলাদেশে জনপ্রিয় হয়েছেন পাকিস্তানি তারকারা। অভিনেত্রীদের মধ্যে রয়েছেন দূরে ফিশা সালিম (Dure Fishan Saleem), ইউমনা জাইদী (Yumna Zaidi), হানিয়া আমির (Hania Amir) এবং অভিনেতাদের মধ্যে রয়েছেন বিলাল আব্বাস খান (Bilal Abbas Khan) বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন।

বাংলাদেশের দর্শকদের সাথে যোগাযোগ বাড়াতে নানারকম ইস্যুতে তারা সাড়াও দেন। যেমন কিছুদিন আগে বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লবকে সমর্থন জানিয়ে সামাজিক মাধ্যমে স্টোরি দিয়েছিল দানানীর মোবিন (Dananeer Mobeen)। এছাড়া বিভিন্ন দিবসগুলোতে বাংলাদেশ নিয়ে পোস্ট দেন পাকিস্তানি তারকারা।

এসব কারণে বাংলাদেশের দর্শকদের মধ্যে বেশ সাড়াও পড়ে।
সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement

সকল