মুনতাহাকে মুখে ওড়না ঢুকিয়ে ও গলায় রশি পেঁচিয়ে হত্যা
- এম জে এইচ জামিল, সিলেট
- ১০ নভেম্বর ২০২৪, ২০:৫৬
সিলেটে মুনতাহা আক্তার জেরিনকে মুখে ওড়না ঢুকিয়ে ও গলায় রশি পেঁচিয়ে হত্যা করা হয়েছে। শিশু মুনতাহার এক সময়ের গৃহশিক্ষিকা আলিফজান বিবির মেয়ে শামীমা বেগম মার্জিয়া (২৫)। খারাপ আচরণের কারণে শামীম তার মেয়েকে পড়াতে নিষেধ করেন। এতে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠে মার্জিয়া। মুনতাহার মা-বাবার উপর প্রতিশোধ নিতে গত ৩ নভেম্বর নিখোঁজের দিন মুনতাহাকে কৌশলে মার্জিয়া ও তার মা আলিফজান বিবি তাদের বাড়িতে নিয়ে যান।
পরে মুনতাহার মুখের মধ্যে ওড়না ঢুকিয়ে ও গলায় রশি পেঁচিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে। তারা প্রথমে লাশ বস্তাবন্দী করে ঘরের মধ্যে রাখেন। এরপর গভীর রাতে মুনতাহার লাশ পলিথিনে মুড়িয়ে বাড়ির পাশে নর্দমায় পুতে রাখেন।
এদিকে একাধিকবার মুনতাহার পরিবারের লোকজন মার্জিয়াসহ তার পরিবারের কাছে মুনতাহা নিখোঁজ সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরণের কথা বলতে থাকেন। এতে মার্জিয়ার পরিবারের লোকজনের চলাফেরা ও কথাবার্তায় সন্দেহ হলে শনিবার রাতে পুলিশ মার্জিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে যায়। মার্জিয়াকে থানায় নেয়ার পর তার মা আলিফজান বিবি নিহত মুনতাহার পুতে রাখা লাশ তুলে নিয়ে পাশে বাড়ির পুকুরে ফেলার চেষ্টাকালে তাকে হাতেনাতে আটক করেন স্থানীয়রা।
এ সময় থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে আলিফজান বিবি ও তার মা কুতুবজান বিবিকে আটক করে থানায় নিয়ে যান।
এদিকে আটক আলিফজান বিবি ও তার মেয়ে শামীমা বেগম মার্জিয়ার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত স্থানীয় বীরদল ভাড়ারিফৌদ গ্রামের মরহুম ছইদুর রহমানের ছেলে ইসলাম উদ্দিন (৪০) ও মামুন রশিদের স্ত্রী নাজমা বেগমকে (৩০) রোববার গ্রেফতার করে পুলিশ।
কানাইঘাট থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আব্দুল আউয়াল জানিয়েছেন, শিশু মুনতাহাকে পৈশাচিক কায়দায় হত্যারয় গ্রেফতার আলিফজান, মার্জিয়া, ইসলাম উদ্দিন ও নাজমা বেগমের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করা হয়েছে। পরে
আসামিদের আদালতে পাঠানো হয়।
নিখোঁজের সাত দিন পর বাড়ির পাশের খালে মিলেছে শিশু মুনতাহা আক্তার জেরিনের (৬) লাশ। মুনতাহার সন্ধানের আশায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষার প্রহর গুণছিলেন পরিবারসহ দেশের মানুষ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাড়ির পাশ থেকেই তার অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার হয়েছে। এমন ঘটনায় বাকরুদ্ধ এলাকার মানুষ।
কতটা পাষাণ হলে একটা নিষ্পাপ শিশুর সাথে এমন ঘৃণ্য আচরণ করতে পারে উল্লেখ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠে।
যেভাবে উদ্ধার হয় লাশ
রোববার রাত সাড়ে ৩টার দিকে নিজ বাড়ির পাশে খালে পুতে রাখা মুনতাহার লাশ ওঠিয়ে প্রতিবেশীর পুকুরে ফেলার চেষ্টাকালে গলায় রশি পেঁচানো মুনতাহার লাশসহ আলিফজান বিবিকে আটক করেন স্থানীয়রা। মুনতাহার অর্ধগলিত লাশ উদ্ধারের সংবাদ পেয়ে কানাইঘাট থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে লাশ উদ্ধার করে একই বাড়ির মরহুম ময়না মিয়ার স্ত্রী আলিফজান বেগম (৫৫), বৃদ্ধ কুতুবজান বেগমকে(৭০) পুলিশ আটক করে থানায় নিয়ে যায়।
এ সময় এলাকার বিক্ষুব্ধ জনতা হত্যাকারী আলিফজান বিবির বাড়ি ভেঙে অগ্নিসংযোগ করে।
পুলিশ আলিফজানকে আটকে রাখলেও কুতুবজানকে ছেড়ে দেয় বলে জানা গেছে।
এর আগে মুনতাহার পরিবারের সন্দেহের আলোকে কানাইঘাট থানা পুলিশ শনিবার গভীর রাতে প্রতিবেশী আলিফজান বিবির মেয়ে নিখোঁজ মুনতাহার হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী সাবেক গৃহশিক্ষিকা শামীমা বেগম মার্জিয়াকে আটক করে। মার্জিয়াকে থানা পুলিশের হেফাজতে নিয়ে যাওয়ার পর পুলিশের ভয়ে আলিফজান বিবি তাদের ঘরের পাশে একটি নর্দমায় পুতে রাখা মুনতাহার লাশ তুলে রাত সাড়ে ৩টার দিকে পাশের আব্দুল ওয়াহিদের পুকুরে ফেলার চেষ্টার সময় আব্দুল ওয়াহিদসহ আরো কয়েকজনকে হাতেনাতে আটক করেন।
গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিরা প্রত্যক্ষভাবে হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত রয়েছে বলে জানিয়েছেন কানাইঘাট থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আব্দুল আওয়াল।
জানা গেছে, গত ৩ নভেম্বর দুপুরবেলা শিশু মুনতাহা তার বাড়ি থেকে পাশে আব্দুল ওয়াহিদের বাড়ির শিশুদের সাথে খেলতে যায়। ওই দিন বিকেল পর্যন্ত মুনতাহা বাড়িতে ফিরে না আসায় তার খোঁজ করে পরিবার। খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে পরদিন ৪ নভেম্বর মুনতাহার পিতা শামীম আহমদ কানাইঘাট থানায় মেয়ে নিখোঁজের একটি জিডি করেন।
এদিকে মুনতাহা নিখোঁজের পর থেকে র্যাব-পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, তার আত্মীয়-স্বজন ও এলাকার সবাই সম্ভাব্য সব জায়গায় তার খোঁজ করতে থাকেন।
মুনতাহা নিখোঁজের সংবাদ গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। সারাদেশের মানুষ নিখোঁজ মুনতাহাকে ফিরে পেতে ফেসবুকে আবেগঘন পোস্ট দেন। এমনকি কেউ কেউ সন্ধানদাতাকে নগদ টাকা ও স্বর্ণালংকার উপহার দেয়ার ঘোষণাও দেন। সকলের প্রত্যাশা ছিলো নিখোঁজ মুনতাহার সন্ধান পাওয়া যাবে, সে জীবিত অবস্থায় তার বাবা-মার কোলে ফিরে আসবে। সেই সূত্র ধরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাকে ফিরে পেতে সন্দেহজনক ব্যক্তিদের ডাটাবেজ ধরে প্রযুক্তির আশ্রয় নেন। শেষে মার্জিয়াকে আটকের পর মুনতাহা নিখোঁজের মূল রহস্য উন্মোচিত হয়। নিখোঁজের এক সপ্তাহ পর নিজ বাড়ির আলিফজান বিবির ঘরের পাশে নর্দমায় পুতে রাখা মুনতাহার অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করা হয়।
পরিদর্শনে সিলেট পুলিশ সুপার
এদিকে রোববার বিকেল ২টার দিকে সিলেটের পুলিশ সুপার মো: মাহবুবুর রহমান নিহত মুনতাহার বাড়িতে গিয়ে পরিবারের লোকজনকে শান্তনা দেন। তিনি হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে এলাকাবাসীর সাথে কথা বলেন। এ সময় স্থানীয় লোকজন হত্যাকারীদের সর্ব্বোচ্চ শাস্তির দাবী জানান।
পুলিশ সুপার মাহবুবুর রহমান জানান, ‘মুনতাহাকে উদ্ধার করে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য পুলিশ সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিল। ইতোমধ্যে মুনতাহার হত্যাকারী চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
তিনি বলেন, এ হত্যাকাণ্ডের সাথে যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে তাদেরকে দ্রুততম সময়ে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হবে।
এ সময় পুলিশ সুপারের সাথে ছিলেন সিলেটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম, কানাইঘাট সার্কেলের এএসপি অলক কান্তি শর্মা ও থানার ওসি আব্দুল আউয়াল।
উদ্ধারের পর মুনতাহার লাশ ময়নাতদন্তের জন্য সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠায় পুলিশ। রোববার বাদ আসর বীরদল পুরানফৌদ জামে মসজিদে জানাজা শেষে গ্রামের পঞ্চায়েত কবরস্থানে মুনতাহার লাশ দাফন করা হয়েছে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা