২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ভারতের মণিপুরে নতুন করে সহিংসতার নেপথ্যে কী?

- সংগৃহীত

ভারতের মণিপুর রাজ্যের দু’টি জেলায় কারফিউ এবং অন্য আরেকটি জেলায় চলাচলের ওপরে নিষেধাজ্ঞা বলবৎ রয়েছে। ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে পাঁচটি জেলায়।

পুলিশ বলছে, বুধবার নতুন কোনো সহিংসতা না ঘটলেও মঙ্গলবার সারাদিন দফায় দফায় যে সংঘর্ষ চলেছে ছাত্র-আন্দোলনকারী ও নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে, তা রাত পর্যন্ত জারি ছিল।

এডিটর্স গিল্ড অফ মনিপুরের মহাসচিব ও সিনিয়র সাংবাদিক ওয়াই রূপাচন্দ্র সিং বলেন, ‘মঙ্গলবার রাত পর্যন্তও গুলির শব্দ শোনা গেছে ইম্ফলে। বহু জায়গায় টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ দেখিয়েছে আন্দোলনকারী ছাত্ররা। নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে তাদের ছোটখাটো সংঘর্ষও হয়েছে একাধিক জায়গায়।’

তিনি বলেন, ‘তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক ধরনের ভুয়া ভিডিও ছড়াচ্ছে, ভুয়া খবরও ছড়াচ্ছে। যেমন এখানে নাকি স্বাধীনতার দাবিতে মানুষ পথে নেমেছেন। মণিপুরে কোনো স্বাধীনতার দাবি ওঠেনি। বরং মেইতেই আর কুকি- দুই গোষ্ঠীই এক ধরনের প্রতিযোগিতায় নেমেছে যে কারা কত বেশি ভারতের জাতীয় পতাকা ওড়াতে পারে।’

পুলিশ যা বলছে
মণিপুর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের আইজি কে কবিব বুধবার বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘গত ২৪ ঘণ্টায় ইম্ফল উপত্যকায় বহু বিক্ষোভ হয়েছে। ইম্ফল পূর্ব, বিষ্ণুপুর, কাকচিঙ এবং ইম্ফল পশ্চিমে বিক্ষোভ মিছিলগুলি মূলত শান্তিপূর্ণ ছিল। তবে ইম্ফল পশ্চিমের কয়েকটি এলাকায় বিক্ষোভকারীরা সহিংস হয়ে ওঠেন।’

তিনি আরো বলেন, ‘কাকোয়া বাজার এলাকার বিক্ষোভে বন্দুকসহ সহিংস পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। উরিপক অঞ্চলের একটি বিক্ষোভে পেট্রল বোমাও ছোঁড়া হয়েছে। ওই ঘটনায় ১০ জন পুলিশকর্মী আহত হয়েছেন। বিক্ষোভকারীদের মধ্যে অনেক ছাত্র ছিল। তবে যারা আহত হয়েছেন বা ধরা পড়েছে, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন উস্কানিদাতাও ছিল। এরা সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের বাসিন্দা নন।’

মঙ্গলবার কারফিউ জারি হওয়ার পরে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর যৌথ ফ্ল্যাগ মার্চ চলছে এবং রাজধানী ইম্ফলের রাস্তায় যানবাহন খুবই কম চলছে বলেও জানান সিনিয়র সাংবাদিক ওয়াই রূপাচন্দ্র সিং।

গত বছর ১৩ মে থেকে মেইতেই ও কুকি জনগোষ্ঠী দু’টির মধ্যে যে সহিংসতা শুরু হয়েছিল, তা গত বেশ কয়েকমাস ধরে একরকম বন্ধই ছিল। কিন্তু সেপ্টেম্বরের শুরু থেকে আবারো সহিংসতা শুরু হয়। গত ১০ দিনে অন্তত ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদনে জানা যাচ্ছে। নিহতদের মধ্যে একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাও আছেন।

মুখ্যমন্ত্রীর ফাঁস হওয়া কথোপকথন
সেপ্টেম্বরের শুরু থেকে নতুন করে সহিংসতা হওয়ার আগে গত মাসে দু’দফায় একটা অডিও রেকর্ড ফাঁস হয়। সেখানে মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংয়ের কথিত এক কথোপকথনের ফাঁস হয়ে যায় বলে দাবি করা হয়। প্রথম দফায় কুকিদের একটি সংগঠন এবং তারপরে একটি জাতীয়-স্তরের ইংরেজি সংবাদ পোর্টাল ওই অডিওটি ফাঁস করে।

ক্ষমতাসীন বিজেপির কয়েকজন কুকি জনগোষ্ঠীর বিধায়কসহ ওই জনজাতির বিভিন্ন সংগঠন ফাঁস হয়ে যাওয়া অডিও কথোপকথনের সূত্র ধরে অভিযোগ করে যে গত বছর থেকে মেইতেই ও কুকিদের মধ্যে যে সংঘর্ষ চলছে, তা আসলে মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংয়েরই মস্তিষ্ক-প্রসূত। তিনিই কুকিদের ওপরে হামলা চালিয়ে ‘এথনিক ক্লেনসিং’ চালাতে শুরু করেন বলে ওই ফাঁস হওয়া অডিও টেপে শোনা গেছে, যা মুখ্যমন্ত্রীর গলা বলেই মনে করছে কুকিরা।

তবে রাজ্য সরকার ফাঁস হয়ে যাওয়া ওই কথোপকথনের বিষয়ে অত্যন্ত কড়া প্রতিক্রিয়া দিয়েছিল।

তারা বলেছিল, ওই ‘জাল’ অডিও রেকর্ডের মাধ্যমে কোনো একটি অংশ সাম্প্রদায়িক সহিংসতা উস্কিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা করছে। এই ‘ষড়যন্ত্রে লিপ্ত’ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে এবং তাতে জড়িত সব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেয়া হবে।

তবে ওই কথোপকথনের পুরোটাই বিচারপতি লম্বা তদন্ত কমিশনের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত করে দেখার জন্য জমা দেয়া হয়েছে বলে কুকি সংগঠনগুলো জানিয়েছে। গত বছর মে মাস থেকে মণিপুরে সহিংসতার কারণ খুঁজে দেখছে কেন্দ্রীয় সরকার গঠিত ওই তদন্ত কমিশন।

ভারতে প্রথমবার ড্রোন থেকে বোমা নিক্ষেপ
সেপ্টেম্বর মাসের শুরু থেকে যে সব সহিংসতা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে ড্রোন থেকে বোমা হামলার ঘটনা।

এছাড়াও স্থানীয়ভাবে, দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি একধরনের ক্ষেপণাস্ত্র বা রকেটও ব্যবহার করা হয়েছে বলে জানাচ্ছিলেন সিনিয়র সাংবাদিক রূপাচন্দ্র সিং।

তিনি বলেন, ‘আমার সংস্থার এক সাংবাদিক ড্রোন ব্যবহার করে বোমা নিক্ষেপের সাক্ষী। প্রথমবার যখন ড্রোন থেকে বোমা ফেলা হচ্ছিল সেখানে হাজির মানুষজনকে তিনি সাবধান করে দিয়ে দ্রুত সরে যেতে বলেন। কিন্তু পরের হামলায় তিনি নিজেই আহত হয়েছেন। বোমা হামলার জন্য ড্রোনের ব্যবহার এই প্রথমবার দেখা গেল মনিপুরে।’

নিরাপত্তা বাহিনীগুলোও বলছে শুধু মণিপুরে নয়, পুরো ভারতেই এই প্রথমবার ড্রোন থেকে বোমা ফেলা হলো।

যেসব কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী মনিপুরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে আছে, সেগুলোরই অন্যতম বিএসএফ।

সীমান্তরক্ষী বাহিনীর এক অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুরজিৎ সিং গুলেরিয়ার কথায়, ‘ভারতে আমরা এরকম হামলা আগে দেখিনি। তবে মণিপুর লাগোয়া মিয়ানমারে সেখানকার বিদ্রোহীরা ড্রোন থেকে নিয়মিতই বোমা হামলা চালিয়ে থাকে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ওপরে হামলা চালাতে তারা এই পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকে আখছার। আর এটাও আমরা জানি যে কুকি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর শিবির রয়েছে মিয়ানমারে, সেখান থেকে তারা নিয়মিতই সরঞ্জাম নিয়ে আসে।’

সুরজিৎ সিং গুলেরিয়া বলেন, ‘মণিপুর আর মিয়ানমারের সীমান্তে অনেক ফাঁকফোকর আছে। আবার মিয়ানমারে চীনের তৈরি সস্তার ড্রোন সহজলভ্য। মণিপুরে যেসব ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলো ওই ধরনেরই ড্রোন। অতএব বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় কোথা থেকে এই প্রযুক্তি আনা হয়েছে। এতে আমরা মোটেই আশ্চর্য হচ্ছি না।’

ড্রোন থেকে বোমা হামলা ছাড়াও দেশীয় প্রযুক্তিতে স্থানীয়ভাবে তৈরি একধরনের ক্ষেপণাস্ত্র বা রকেট ব্যবহার করা হয়েছে সাম্প্রতিক সহিংসতায়।

সিনিয়র সাংবাদিক রূপাচন্দ্র সিং বলেন, ‘দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি এসব ক্ষেপণাস্ত্রকে এখানে বলা হয় পম্পি। সেটারও ব্যবহার করা হয়েছে এ মাসের সহিংসতায়।’

পম্পি অবশ্য মূল শব্দ ‘বম্পি’-র বিকৃত রূপ। বম্পির মধ্যে ‘বম’ অংশটি হলো বোমা আর পি অর্থ বড়, মানে বড় বোমা।

রূপাচন্দ্র সিং, ‘কিন্তু এখন শব্দটা বদলে গিয়ে পম্পি হয়ে গেছে। এগুলো একেবারেই স্থানীয়ভাবে তৈরি মর্টার এবং রকেট গোত্রীয় বোমা। দেশীয় প্রযুক্তির এই অস্ত্রগুলো খুবই সহজলভ্য মণিপুরে। এর আগেও এর ব্যবহার দেখা গেছে।’

দৃষ্টি ঘোরানোর চেষ্টা?
কুকি জনজাতিভুক্ত এক কলেজ অধ্যাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ওইসব ড্রোন থেকে বোমা হামলা বা দেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র সাম্প্রতিক সহিংসতায় ব্যবহৃত হয়েছে ঠিকই কিন্তু সেগুলো যে কুকি অধ্যুষিত অঞ্চল থেকেই ছোড়া হয়েছে, তার তো কোনো তদন্ত এখনো হয়নি। এভাবে নিশ্চিত করে কী বলা যায় যে ওইসব মারণাস্ত্র কুকিরাই ছুঁড়েছে?’

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ওই অধ্যাপকের পাল্টা প্রশ্ন, ‘সহিংসতা, বোমা হামলা ইত্যাদির কথা বলা হচ্ছে। কুকি অঞ্চল থেকে হামলা হচ্ছে, এটাও বলা হচ্ছে। কিন্তু তার ঠিক আগেই যে মুখ্যমন্ত্রীর একটা কথোপকথন ফাঁস হলো, তা নিয়ে তো বিশেষ প্রচার দেখছি না জাতীয় সংবাদমাধ্যমে।’

তিনি আরো বলেন, ‘যদিও ওই ফাঁস হয়ে যাওয়া কথোপকথনে গলাটা মুখ্যমন্ত্রীরই কিনা, তা শতভাগ নিশ্চিত নয়, কিন্তু ওই ফাঁস হয়ে যাওয়া কথোপকথন থেকে দৃষ্টি ঘোরাতেই নতুন করে এই সহিংসতা শুরু হলো না তো ‘

মণিপুরের এক মানবাধিকারকর্মী, যিনি বর্তমানে মনিপুরের বাইরে আছেন নিরাপত্তাজনিত কারণে, তিনি বলছিলেন যে ওই অডিও টেপ ফাঁস হয়ে যাওয়ার ফলে মুখ্যমন্ত্রী কিছুটা তো বিব্রত হয়েছেন নিশ্চিতভাবেই। এবং তারপরেই দেখা গেল যে সহিংসতা শুরু হলো, জানাচ্ছিলেন ওই মানবাধিকারকর্মী।

ওই মানবাধিকারকর্মীও নিজের নাম প্রকাশ না করতে অনুরোধ করেছেন।

কবে থামবে অস্থিরতা?
ওই মানবাধিকারকর্মীর কথায়, ‘আপনি যদি লক্ষ্য করে দেখেন যেভাবে, যে অঞ্চলে ড্রোন থেকে বোমা ফেলা হয়েছে পর পর দু’দিন ধরে, সেটা সেনাবাহিনীর ৫৭ নম্বর মাউন্টেন ডিভিশনের সদর দফতরের খুব কাছে, যদিও এলাকাটিতে সরাসরি ২২ আসাম রাইফেলসের অধীন। ড্রোন কোথা থেকে ওড়ানো হলো, সেই জায়গাটি নির্দিষ্টভাবে দু’দিনেও চিহ্নিত করা গেল না কেন?’

ওই মানবাধিকার কর্মী আরো বলেন, ‘এই বড় প্রশ্নটা তো মানুষ তুলছেন। আবার রকেট হামলা হয়েছে প্রায় ছয় ঘণ্টা ধরে। নিরাপত্তা বাহিনী কেন ধরতে পারল না কাউকে? এগুলো করা হলে তো মানুষ বিক্ষোভ দেখাতে রাস্তায় নামতেন না! মানুষ তো মনে করছেন যে তারা একেবারে অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছেন।’

সিনিয়র সাংবাদিক ওয়াই রূপাচন্দ্র সিং অবশ্য মনে করছেন, কোনো একটি কারণে যে সাম্প্রতিকতম সহিংসতাগুলি হচ্ছে, তা নয়।

তার কথায়, ‘অডিও কথোপকথন ফাঁস হওয়া, মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে মিছিল-বিক্ষোভ আর তারপরেই নতুন করে সহিংসতা- এই সবই একটি অন্যটির সাথে সম্পর্কিত। তাই এটা বলা যাবে না যেকোনো একটা কারণে নতুন করে সহিংসতা ছড়ালে। এর সাথে রয়েছে ভুয়া তথ্য, ভুয়া ভিডিও এবং ভুল খবর ছড়ানোর ব্যাপারগুলো তো আছেই। তবে সবই যে ভুয়া খবর বা ভিডিও ছড়ানো হচ্ছে, তাও নয়, সত্য ঘটনাও আছে। কোনো একটি বিষয়কে বিচ্ছিন্নভাবে দেখলে চলবে না।’

তবে এই সহিংসতা কবে থামবে, তা কেউ নিশ্চিতভাবে বলতে পারছেন না।

রূপাচন্দ্র সিং বলছিলেন, ‘মুখ্যমন্ত্রী একটা সময়সীমা দিয়েছিলেন যে ছয় মাসের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু তারপরেই তো নতুন সহিংসতা শুরু হলো।’

আবার কুকি জনজাতির ওই অধ্যাপকে কথায়, ‘কবে যে এসব থামবে, তা বলা কঠিন।’

বিএসএফের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুরজিৎ সিং গুলেরিয়া মনে করেন, ‘শুধু নিরাপত্তা বাহিনী দিয়ে এই সমস্যার সমাধান হবে না। মণিপুরে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে গেলে রাজনৈতিক এবং সামাজিক পর্যায়ে তার সমাধান খুঁজতে হবে।’
সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement