২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

কেরালার ভূমিধসে মৃতের সংখ্যা ৩০০ ছাড়িয়েছে

উদ্ধার তৎপরতা এখনো চলছে - ছবি : বিবিসি

কেরালার ভূমিধসে মৃতের সংখ্যা ৩০০ ছাড়িয়েছে


কেরালার ওয়েনাড জেলায় গত মঙ্গলবার ভোররাতে প্রবল ভূমিধসে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে অন্তত ৩০৮।

শুক্রবার (২ আগস্ট) সকালে সংবাদ সংস্থা এএনআই কেরালার স্বাস্থ্য মন্ত্রী ভিনা জর্জকে উদ্ধৃত করে এ খবর জানিয়েছে।

তারিখটা ছিল ৩০ জুলাই। কেরলের ওয়েনাড জেলার মুন্ডাক্কাই। সেলসম্যান অজয় ঘোষ প্রচণ্ড একটা আওয়াজে কেঁপে উঠেছিলেন।

প্রথম কিছুক্ষণ তিনি বুঝতেই পারেননি ওই আওয়াজটা কিসের। এরপরই ভারী বৃষ্টির সাথে বয়ে আসতে থাকে কাদার স্রোত।

অজয় ঘোষ বলেন, ‘রাত ১টা ৫০ মিনিট নাগাদ বিকট শব্দে আমাদের ঘুম ভাঙে। আমরা বুঝতে পারলাম যে চারদিক থেকে প্রচুর পরিমাণে কাদার স্রোত বইছে।’

ঘোষ বলছিলেন যে তিনি ‘ভাগ্যবান’ কারণ তিনি ভূমিধসে তার পরিবারের কোনো সদস্যকে হারাননি, তবে তার বাড়ির কাছেই এক জায়গাতেই ৪০ জনের মৃত্যু হয়েছে।

ভূমিধস এতটাই তীব্র ছিল যে প্রায় ৯০ কিলোমিটার দূরে পাশের জেলা মালাপ্পুরমের নীলাম্বুর জঙ্গলেও তার প্রভাব পড়েছে। ওই এলাকা থেকে ৩০টি লাশ উদ্ধার করেছেন উদ্ধারকারীরা।

ত্রাণ শিবিরে ১১ হাজার মানুষ
বুধবার পার্লামেন্টের উচ্চ-কক্ষ রাজ্যসভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ দাবি করেন যে ২৩ জুলাই কেরালা সরকারকে সতর্ক করা হয়েছিল।

তবে কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন বলেছেন, ওয়েনাডে ধ্বংসযজ্ঞের বেশ কয়েক ঘণ্টা পর কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে তথ্য পাওয়া গেছে।

বিরোধী সংসদ সদস্যদের অভিযোগ, আরো উন্নত ব্যবস্থাপনা থাকলে বহু মানুষকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানো যেত।

অন্যদিকে ওয়েনাডে ভূমিধসে কয়েক হাজার মানুষ ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন। রাজ্য সরকারের দেয়া তথ্য অনুযায়ী ১০২টি শিবিরে প্রায় ১১ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। চুড়ামালার চা বাগিচা এবং মুন্ডাক্কাইয়ে এলাচ বাগিচা অঞ্চলেও ত্রাণ শিবির খোলা হয়েছে।

ওইসব বাগিচার এলাকাগুলোতে আসাম ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে কাজ করতে যাওয়া কয়েক হাজার পরিযায়ী শ্রমিক বসবাস করেন।

বৃহস্পতিবার ওয়েনাডে গিয়েছিলেন সেখানকার সদ্য সাবেক সংসদ সদস্য রাহুল গান্ধী ও তার বোন প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। রাহুল গান্ধী ওই আসনটি থেকে পদত্যাগ করার পরে এখন সেখান থেকে ভোটে লড়বেন তার বোন।

ভূমিধসের ঘটনা আগেও হয়েছে
কেন্দ্রীয় সরকার নিযুক্ত পশ্চিমঘাট পর্বতমালার পরিবেশ সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ কমিটি, যা মাধব গ্যাডগিল কমিশন নামে পরিচিত, তাদের ২০১১ সালে জমা দেয়া রিপোর্টে এই পুরো এলাকাকে ইকো-সেনসিটিভ এরিয়া (ইএসজেড) হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। ওই প্রতিবেদনটিকে মাধব গ্যাডগিল রিপোর্ট নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে।

প্রতিবেদনে বেশি সংবেদনশীল, কিছুটা কম সংবেদনশীল ও সবথেকে কম সংবেদনশীল – এই তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছিল।

কেরালা, কর্ণাটক এবং তামিলনাড়ুর সমস্ত রাজনৈতিক দল এবং রাজ্য সরকার ধারাবাহিকভাবে ওই প্রতিবেদনের বিরোধিতা করে এসেছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চা-কফি-এলাচ বাগিচা ছাড়াও কিছু অন্য কর্মকাণ্ডেরও অনুমতি দিয়েছে কেরালা সরকার। ওয়েনাড জেলার পার্বত্য অঞ্চলে ভূমিধস কোনো নতুন বিষয় নয়।

চুড়ালমালা-মুন্ডাক্কাই অঞ্চল থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছিল ২০১৯ সালে। ওই এলাকায় ছোটবড় মিলিয়ে ২০১৮ ও ২০১৯ সালে অন্তত ৫১টি ভূমিধসের ঘটনা ঘটেছে।

প্রবল বৃষ্টিপাত
কেরালা ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (কেএফআরআই) এক প্রতিবেদনে ভূমিধসের জন্য পাথর উত্তোলনকে দায়ী করা হয়েছে।

কোচি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাডভান্সড সেন্টার ফর অ্যাটমোস্ফেরিক রেডার রিসার্চের পরিচালক অভিলাষ এস বিবিসির ইমরান কুরেশিকে বলেন, ‘গত দুই সপ্তাহের ভারী বৃষ্টির পর মঙ্গলবার আরো বেশি বৃষ্টি হয়েছে। এটা হয়ত ভূমিধসের প্রধান কারণ নয়, তবে নিশ্চিতভাবেই এটিকে অন্যতম মূল কারণ বলা যেতে পারে।

অভিলাষ এস বলেন, ‘গোটা অঞ্চলে ৬০-৭০ শতাংশ বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। সব আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র থেকেই ৩৪ সেন্টিমিটার বৃষ্টিপাতের খবর পাওয়া গেছে। এর আগে ২০১৯ সালে মাত্র একদিনে বৃষ্টিপাত হয়েছিল ৩৪ সেন্টিমিটার।

অন্যদিকে কেরালা ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (কেএফআরআই) বিজ্ঞানী ডক্টর টিভি সঞ্জীব মানচিত্র দেখিয়ে বলেছেন, চুড়ালমালা থেকে ৪ দশমিক ৬৫ কিলোমিটার এবং মুন্ডাক্কাই থেকে ৫ দশমিক ৯ কিলোমিটার দূরে খনন কাজ চলছিল।

তার কথায়, ‘খনিতে বিস্ফোরণ ঘটানো হলে সেখান থেকে যে কম্পন তৈরি হয়, তা অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। এই পুরো এলাকাটি এখন ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। একমাত্র কিছুটা স্বাভাবিক রয়েছে বড় বড় বৃক্ষগুলো।

সঞ্জীব বলছিলেন,‘সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একটি নতুন আইন চা-কফি-এলাচ বাগিচার কিছুটা অংশ অন্য কাজে ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়। ফলস্বরূপ, বাগান মালিকরা পর্যটনের দিকে মন দেন, বড় বড় ভবন নির্মাণ শুরু করেন। এ জন্য জমি সমতল করতে হয়েছে।’

চার বছর আগে কেএফআরআই তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছিল ওয়েনাডে ২০টিরও বেশি পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে, যেখানে প্রতি বছর ২৫ হাজার বিদেশী পর্যটক এবং এক লাখ দেশীয় পর্যটক বেড়াতে আসেন।

তিনি বলেন,‘আমাদের জন্য গ্যাডগিল রিপোর্ট মেনে চলাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা পরামর্শ দিয়েছিল যে এই সংবেদনশীল এলাকার ব্যবস্থাপনা অন্যভাবে করা উচিত। দুঃখের বিষয় হল, গোটা রাজনৈতিক মহল এর বিরোধিতা করে এসেছে।

সঞ্জীব জানাচ্ছিলেন, ‘কেরালার জমি খুবই সংবেদনশীল হওয়ায় সমস্যা আরো বেড়ে গেছে। ভারী বৃষ্টি হচ্ছে আর মাটি এতটাই ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে যে ভারী বৃষ্টি সহ্য করতে পারছে না।’

প্রায় দেড় দশকের অপেক্ষা
মাধব গ্যাডগিলের প্রতিবেদনে পশ্চিমঘাট পর্বতমালাকে পরিবেশগত-ভাবে সংবেদনশীল হিসাবে বর্ণনা করার পর ১৩ বছর কেটে গেছে।

ওই প্রতিবেদন প্রকাশ পাওয়ার পরে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড বন্ধ করা দরকার ছিল। কেন্দ্রীয় সরকার ২০১৪ সালের মার্চ থেকে বিজ্ঞপ্তির পাঁচটি খসড়া জারি করেছে, তবে এখনও চূড়ান্ত বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়নি।

এর মূল কারণ দুই প্রতিবেশী রাজ্য কেরালা ও কর্ণাটকের বিরোধিতা। কর্ণাটক চায় মানুষের জীবন জীবিকার ক্ষতি হবে, তাই ওই খসড়া বিজ্ঞপ্তিটি বাতিল করা হোক।

এই শিথিলতার ফলে পরিবেশগতভাবে ক্ষতিকারক নানা কাজ যেমন গাছ কাটা, খনন এবং ভবন নির্মাণ বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলে পাহাড়ে অস্থিরতা বেড়েছে। ড: সঞ্জীব এটিকেই ভূমিধ্বসের প্রধান কারণ বলে মনে করেন।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement