সন্দেশখালির তৃণমূল কংগ্রেস নেতা শাহজাহান গ্রেফতার
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:৩৮
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সন্দেশখালির তৃণমূল কংগ্রেস নেতা শাহজাহান শেখের বিরুদ্ধে দীর্ঘ দিন ধরে যৌন নির্যাতনসহ নানা অভিযোগ করে আসছিলেন স্থানীয়রা, তাকে অবশেষে বৃহস্পতিবার ভোররাতে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
তবে স্থানীয় মানুষদের ওপরে নির্যাতনের মামলায় নয়, কেন্দ্রীয় তদন্ত অ্যাজেন্সি এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের কর্মকর্তাদের ওপরে হামলার ঘটনায় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।
চলতি ৫ জানুয়ারি সকালে শাহজাহান শেখের বাড়িতে কেন্দ্রীয় অর্থদফতরের তদন্ত শাখা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট বা ইডির কর্মকর্তারা গিয়েছিলেন তল্লাশি চালাতে। রেশন দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া সাবেক খাদ্য মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের সাথে ঘনিষ্ঠতার অভিযোগে ওই তল্লাশিতে গিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় অ্যাজেন্সির কর্মকর্তারা। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই শাহজানের বাড়িতে কয়েক শ’ নারী-পুরুষ জড়ো হয়ে ওই কেন্দ্রীয় কর্মকর্তা, তাদের সাথে থাকা কেন্দ্রীয় বাহিনীর সদস্য এবং সংবাদমাধ্যমকে ব্যাপক মারধর করা হয়।
ভোররাতে গ্রেফতার
উত্তর ২৪ পরগণা জেলার মিনাখাঁর সাব-ডিভিশনাল পুলিশ অফিসার আমিনুল ইসলাম খান জানান, তার এলাকার বামনপুকুর অঞ্চল থেকে বৃহস্পতিবার রাত ২টার দিকে গ্রেফতার করা হয়েছে শাহজাহান শেখকে। তাকে সরাসরি বসিরহাট আদালতের লকআপে রাখা হয়েছে। বৃহস্পতিবারই তাকে আদালতে হাজির করা হবে।
সন্দেশখালির ওই তৃণমূল কংগ্রেস নেতা শাহজাহান শেখের বিরুদ্ধে অন্যান্য যেসব অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে ফেব্রুয়ারি মাস থেকে, সেইসব ঘটনা আসলে বেশ পুরনো, তাই সেগুলোর তদন্ত করতে আরো কিছুটা সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন পুলিশের অতিরিক্ত মহা-নির্দেশক (দক্ষিণ বঙ্গ) সুপ্রতিম সরকার।
হাইকোর্টের নির্দেশ
এর আগে রাজ্য পুলিশ এবং ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস দল বলছিল যে আদালতের স্থগিতাদেশ আছে বলেই শাহজাহান শেখকে গ্রেফতার করতে পারছে না পুলিশ। তবে কলকাতা হাইকোর্ট দু’দিন আগেই স্পষ্ট করে দিয়েছিল যে শাহজাহান শেখকে গ্রেফতারের ব্যাপারে কোনো স্থগিতাদেশ তারা দেয়নি। রাজ্য পুলিশ অথবা কেন্দ্রীয় তদন্ত অ্যাজেন্সিগুলো- যে কেউই গ্রেফতার করতে পারে শাহজাহানকে।
বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত মহা-নির্দেশক সুপ্রতিম সরকার বলেন, ‘সংবাদমাধ্যমে লাগাতার বলা হয়েছে পুলিশ ইচ্ছাকৃত শাহজাহানকে গ্রেফতার করছে না। আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, এটা ঠিক নয়। এটা ভুল। এটা অপপ্রচার। আমাদের আইনি বাধ্যবাধকতা ছিল। দিন দুয়েক আগে যখন মাননীয় উচ্চ আদালতের তরফে স্পষ্ট করে বলে দেয়া হয় যে গ্রেফতারির ওপরে কোনো বিধিনিষেধ নেই, তখন আমরা জোরকদমে তল্লাশি শুরু করি। গত রাতে মিনাখাঁ থানার বামনপুকুর অঞ্চল থেকে শেখ শাহজাহানকে গ্রেফতার করি।’
তবে ঠিক কোথা থেকে, কিভাবে গ্রেফতার করা হলো শাহজাহান শেখকে, তার বিস্তারিত তথ্য ‘তদন্তের স্বার্থে’ জানাতে চাননি সুপ্রতিম সরকার। সব তথ্য আদালতে দেয়া হবে বলেও তিনি জানান।
কে এই শাহজাহান শেখ
সুন্দরবনের একটি দ্বীপ সন্দেশখালি। সেখানে তৃণমূল কংগ্রেসের একচ্ছত্র নেতা শাহজাহান শেখ। তিনি উত্তর ২৪ পরগণা জেলা পরিষদে মৎস্য ও পশুপালন বিভাগের প্রধান।
এক সময়ে বামফ্রন্টের প্রধান শরিক সিপিআইএম দলে ছিলেন তিনি। কিন্তু বাম জমানার শেষ দিকে তিনি ধীরে ধীরে তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে ঝোঁকেন। পরে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন ওই জেলার নেতা জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের।
শাহজাহান শেখের নাম সংবাদমাধ্যমে প্রথমবার আসে চলতি বছরের জানুয়ারিতে। রাজ্যের রেশন দুর্নীতির যে তদন্তে গ্রেফতার হয়েছেন সাবেক খাদ্য মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, তার সাথে ঘনিষ্ঠতার সূত্রেই ৫ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় তদন্ত অ্যাজেন্সি এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট বা ইডি তল্লাশি চালাতে গিয়েছিল শাহজাহান শেখের বাড়িতে।
সেদিন কয়েক শ’ নারী পুরুষ জড়ো হয়ে সূত্রে ইডির কর্মকর্তা, তাদের সাথে থাকা কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী, সংবাদমাধ্যম- সবাইকে মারধর করে তাড়িয়ে দেয়। তারপর থেকে শাহজাহান শেখ নিখোঁজ।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, এক সময়ে মাছের ভেড়ির শ্রমিক বা কখনো ভ্যানগাড়ির চালক এই শাহাজাহান এখন বিপুল সম্পত্তির মালিক। আর এইসব সম্পত্তির অনেকটাই সাধারণ মানুষের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছেন শাহাজাহান বা তার ঘনিষ্ঠ তৃণমূল কংগ্রেস নেতারা, এমনটাই অভিযোগ স্থানীয় মানুষের।
‘পিঠে পুলি বানানোর ডাক’
সন্দেশখালির স্থানীয়দের অনেকে অভিযোগ করেন যে শাহজাহান শেখ ও তার দুই সঙ্গী শিবু হাজরা এবং উত্তম সর্দার নিজেদের সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে গত দুই আড়াই বছর ধরে স্থানীয় মানুষের ওপরে অত্যাচার করে চলেছেন। এই সব অত্যাচারের মধ্যে নারীদের যৌন নির্যাতন এবং ধর্ষণের অভিযোগও আছে।
শিবু হাজরা এবং উত্তম সর্দারকে আগেই গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
গত তিন সপ্তাহ ধরে সন্দেশখালির নারীরা শাহাজাহান শেখ ও তার সঙ্গীদের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন লাঠি-ঝাঁটা নিয়ে।
তৃণমূল কংগ্রেসের ওই স্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অন্তত দুটি এফআইআর দায়ের হয়েছে।
সেখানকার বাসিন্দা এক নারী নিজের পরিচয় গোপন করে জানান, ‘মেয়েদেরকে পিঠে পুলি করতে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের কি মা বোন নেই বাড়িতে? তাদের বাড়িতে কি পিঠে পুলি কেউ করে না? কেন আজকে সুন্দরী সুন্দরী মা বোনদের নিয়ে গিয়ে পিঠে পুলি করানো হতো? ভেতরে কী করেছে, সেটা জিগ্যেস করলে মেয়েরা বলে লজ্জার কথা কী বলব!’
আরেক নারী বলেন, ‘মেয়েদের পিঠে পুলি বানানোর নাম করে নিয়ে যেত। সেখানে মেয়েদের সাথে যেসব খারাপ কাজ, সেসব করা হতো। এই অত্যাচারের কথা কী কোনো মেয়ে নিজ মুখে বলতে পারে? পুলিশের কাছে গেলে তারা আবার ওই দাদাদের কাছেই গিয়ে মিটিয়ে নিতে বলত।’
তার ডাকে সাড়া দিয়ে কেউ যদি দলীয় অফিসে না যেতেন, তাহলে পরের দিন ওই পরিবারের পুরুষ সদস্যদের মারধর করা হতো বলেও একাধিক বাসিন্দা অভিযোগ করেছেন।
বিবিসি বাংলা অবশ্য সন্দেশখালিতে ঘুরে এমন কোনো নারীর সঙ্গে কথা বলতে পারেনি, যিনি নিজে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারাও গ্রেফতার বা পলাতক থাকার কারণে তাদের বক্তব্যও পাওয়া যায়নি।
চাষের জমি দখল
যৌন নির্যাতন ছাড়াও এলাকার চাষের জমি জোর করে দখল করে মাছ চাষের ভেড়ি বানানোর অভিযোগও আছে শাহজাহান শেখ এবং তার ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে।
সেই সব অভিযোগ, এখন লিখিতভাবে এক গণপিটিশন করে সরকারের কাছে জানিয়েছেন তারা।
উর্মিলা দাস নামে এক নারী জানান, ‘৩৩ শতক জমি ছিল, বছরে তিন বার ধান হতো। দু’বছর আগে নোনা পানি ঢুকিয়ে দিয়ে জমি নিয়ে নেয়। সেখানে মাছের ভেড়ি করেছে। এদিকে এক বছর আমাদের কিছু টাকা দিয়েছিল লিজ নেয়ার বদলে, তারপর থেকে আর কিছু দেয় না। ওইটুকু জমিই ছিল আমার। এখন খেটে খেতে হয়। টাকা চাইতে গেলে হেনস্থা করত ওরা। তাই সরকারের কাছে আবেদন করেছি আমাদের জমি ফিরিয়ে দেয়া হোক, সেখানে আবারো চাষ করব আমরা।’
সূত্র : বিবিসি