পশ্চিমবঙ্গে হঠাৎ মরিচঝাঁপি নিয়ে বিজেপির রাজনীতি কেন?
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৭:৪৫
ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বাম সরকার ১৯৭৭ সালে ক্ষমতায় আসার পর ‘বাংলাদেশ থেকে যাওয়া’ উদ্বাস্তুরা আশা করেছিলেন, তাদের দ্রুত পুনর্বাসন হবে। দণ্ডকারণ্যে বসবাসকারী দেশছাড়া মানুষদের একাংশ সুন্দরবনের মরিচঝাঁপি দ্বীপে চলে আসেন। এই এলাকা সংরক্ষিত বনাঞ্চল হওয়ায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সরকার উদ্বাস্তুদের এলাকা খালি করে দিতে বলে। কিন্তু তারা মাটি কামড়ে পড়ে থাকায় শুরু হয় সংঘাত। অভিযোগ, অভিযানে পুলিশের গুলিতে বহু মানুষ নিহত হয় মরিচঝাঁপিতে। অনেক উদ্বাস্তু জনতাকে গ্রেফতার করা হয়।
১৯৭৯ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে এসব ঘটনা ঘটে। এ নিয়ে যে রাজনৈতিক উত্তেজনা শুরু হয়েছিল, তা ফের মাথাচাড়া দিয়েছে বিজেপির কর্মসূচিকে ঘিরে।
৪০ বছর আগের এই ঘটনাকে স্মরণ করে গত ৩১ জানুয়ারি রাজ্য বিজেপি ‘মরিচঝাঁপি চলো’র ডাক দেয়। দলের তফসিলি জাতি মোর্চার নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল দক্ষিণ ২৪ পরগনার গোসাবার অধীন মরিচঝাঁপিতে যায়।
মোর্চার সভাপতি সুদীপ দাস জার্মান গণমাধ্যম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসকে ফিরিয়ে আনতে আমাদের এই স্মরণ। আমরা সুন্দরবনের কুমিরমারি, মরিচঝাঁপি এলাকায় গিয়ে শহীদদের শ্রদ্ধা জানিয়েছি। কুমিরমারির ৫২ বছর বয়সী বলরাম মন্ডল নামে ঘটনার এক প্রত্যক্ষদর্শীকে সংবর্ধনা দিয়েছি। বলরামের মা মুনি মুন্ডাকে যখন মারা হয়, তখন তার বয়স ১১ বছর। এই অন্যায়ের বিচার চাইতেই আদালতে বিষয়টি তুলতে চাইছি।’
কিন্তু বিরোধীরা প্রশ্ন তুলছে, হঠাৎ এবছর মরিচঝাঁপি নিয়ে এতটা তৎপর কেন রাজ্যের গেরুয়া ব্রিগেড?
বিজেপির মুখপাত্র অধ্যাপক বিমলশঙ্কর নন্দ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘কলকাতা পৌরসভা ভোটে কিছু ভোট পেয়ে তৃণমূলের বিকল্প হিসেবে বামেরা নিজেদের তুলে ধরার চেষ্টা করছে। তৃণমূল একটা অংশের ভোট নিজেরাই বামেদের দিয়ে প্রমাণ করতে চাইছে যে এখানে বিজেপি বলে কিছু নেই। বামেদের মরিচঝাঁপি কাণ্ড তুলে ধরেই আমরা প্রমাণ করতে চাইছি যে বামেরা কখনোই বিকল্প শক্তি হয়ে উঠতে পারে না।’
ইতিহাসের বিতর্কে বিজেপি ও পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস একসুরে বলছে, বামফ্রন্ট সরকার মরিচঝাঁপি গণহত্যা চালিয়েছিল। কিন্তু বিজেপির কর্মসূচিকে কটাক্ষ করে তৃণমূল নেতা, কলকাতার মেয়র পরিষদ বৈশ্বানর চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘বিজেপি হঠাৎ এ নিয়ে আন্দোলনে নামছে কেন? আসলে গোবলয়ের মতো জাতপাতের রাজনীতিকে বিজেপি বাংলায় প্রতিষ্ঠা দিতে চাইছে।’
অনেকে বলছেন, এটা আসলে বিজেপির অন্দরে চলা বিদ্রোহ থেকে নজর ঘোরানোর একটা কৌশল। নইলে এখন মরিচঝাঁপির কথা মনে পড়ল কেন?
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও সাংসদ শান্তনু ঠাকুরের নেতৃত্বে বঙ্গ বিজেপিতে কার্যত বিদ্রোহ চলছে। মতুয়া জনগোষ্ঠীর নেতা শান্তনু। বাংলাদেশ বাংলা থেকে যাওয়া এই মতুয়ারা নমঃশূদ্র। আবার মরিচঝাঁপিতে যারা বসতি করেছিলেন তারা একই গোষ্ঠীর। সে কারণেই কি মরিচঝাঁপি নিয়ে বিজেপি এত আন্তরিক?
অধ্যাপক নন্দ বলেন, ‘শান্তনু ঠাকুর তার মত প্রকাশ করেছেন। গণতান্ত্রিক দলে সেটা করাই যায়। তার সাথে মরিচঝাঁপির কোনো সম্পর্ক নেই। এর আগে দল হিসেবে না গেলেও বিভিন্নভাবে একাধিক সংস্থার পক্ষ থেকে মরিচঝাঁপি যাওয়া হয়েছিল।’
তৃণমূল-বিজেপির নিশানা যে বামেরা তারা আজও গণহত্যার অভিযোগ খারিজ করে দেয়। সিপিএম নেতা ও সুন্দরবন উন্নয়ন দফতরের সাবেক মন্ত্রী কান্তি গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘এত মানুষের হত্যার গল্প বছরের-পর-বছর বলা হচ্ছে যার বাস্তবতা নেই। কিন্তু কারা মারা গিয়েছেন তাদের নামের তালিকা যদি বিরোধীরা পেশ করেন, তাহলে আমরা খুশি হব।’
বরং সিপিএম নেতৃত্ব বলছেন, জ্যোতি বসুর ওই সিদ্ধান্ত ছিল ঐতিহাসিক। কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে, ‘সেই সময় মুখ্যমন্ত্রী যদি ব্যবস্থা না নিতেন, তাহলে সুন্দরবনের এই চেহারা আজ থাকত না। এখন যেখানে পরিবেশ রক্ষা এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, সেখানে সুন্দরবনকে বাঁচানোর ক্ষেত্রে জরুরি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন জ্যোতি বসু।’
গণহত্যা নিয়ে বিজেপির তৎপরতাকে সরিয়ে রাখলে মানবিক প্রশ্নটি উঠতে বাধ্য, যদি সত্যি হত্যা হয়ে থাকে, তার বিচার হবে না? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার এই ঘটনার পুনরায় তদন্তের জন্য একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে নিয়ে গঠন করেছিলেন মরিচঝাঁপি কমিশন। যদিও নিহতদের পরিবারের মানুষরা দাবি করেছেন, সাত বছর কেটে গেলেও তদন্ত কিছু এগোয়নি।
মরিচঝাঁপি আন্দোলনের প্রধান সংগঠন উদ্বাস্তু উন্নয়নশীল সমিতির বর্তমান সাধারণ সম্পাদক প্রবীণ রাধিকারঞ্জন বিশ্বাস সেই গণহত্যার সাক্ষী। তিনি বলেন, ‘মরিচঝাঁপির ঘটনা সবাই জানেন। কিন্তু এই ঘটনা ঘটার পর উদ্বাস্তু পরিবারগুলো কোথায় গেল, তার খবর কেউ রাখেনি। সেদিন পরিবারগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। যে যেদিকে পারেন পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন গ্রেফতার হওয়ার ভয়ে। এই ঘটনা ঘটার পর বামফ্রন্ট সরকারের পক্ষ থেকে মিথ্যা কথা বলা হয়েছিল যে বিনা রক্তপাতে সব উদ্বাস্তু পরিবার দণ্ডকারণ্য ফিরে গেছেন।’
সূত্র : ডয়চে ভেলে