কাবুলে সরকার গঠন নিয়ে পাকিস্তানের তৎপরতা
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ২১ আগস্ট ২০২১, ১৩:৪৮, আপডেট: ২১ আগস্ট ২০২১, ১৩:৫২
কাবুলে নতুন একটি সরকার গঠন নিয়ে তালেবান নেতৃত্ব এবং তালেবান বিরোধী আফগান রাজনীতিকদের পাশাপাশি তৃতীয় যে পক্ষটি তৎপর সেটি হলো পাকিস্তান।
কাবুলে ভবিষ্যৎ সরকারে তালেবানের সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে দেন-দরবার করতে গত পাঁচদিন ইসলামাবাদে অবস্থান করছেন বিলুপ্ত তালেবান বিরোধী জোট উত্তরাঞ্চলীয় জোটের শীর্ষ সাত আফগান রাজনীতিবিদ।
ইসলামাবাদে অবস্থান করা আফগান রাজনীতিবিদদের মধ্যে দেশটির কিংবদন্তী তাজিক নেতা আহমদ শাহ মাসুদের দুই ভাই, আহমদ জিয়া মাসুদ ও আহমদ ওয়ালি মাসুদ, তালেবানের প্রথম আমলের পূর্ববর্তী আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট বুরহানউদ্দিন রাব্বানির ছেলে সালাহউদ্দিন রাব্বানি, হাজারা নেতা করিম খলিলি ও আফগান পার্লামেন্টের স্পিকার মীর রহমান রহমানি রয়েছেন।
পাকিস্তানে আসা এই আফগান নেতারা অবশ্য বলেছেন তার নিজেদের উদ্যোগে আসেননি, বরং পাকিস্তান সরকারের আমন্ত্রণেই তারা এসেছেন।
পাশাপাশি, ২০০১ সালে তালেবানের প্রথম সরকারের পতন পরবর্তী আফগান সরকারের প্রথম প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই ও কাতারের দোহায় মীমাংসায় আলোচনা আফগান সরকারের প্রতিনিধি আবদুল্লাহ আবদুল্লাহর সাথে কাবুলে ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে যে কথাবার্তা চলছে তাতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত মনসুর আহমদ খানের পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট থাকার স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। বৃহস্পতিবার মনসুর আহমদ খানের সাথে হামিদ কারজাইয়ের একটি বৈঠকও হয়েছে।
লন্ডনে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির বিশ্লেষক ড. আয়েশা সিদ্দিকা বলছেন, আফগানিস্তানে পাকিস্তান যে তাদের পছন্দমত একটি সরকার চাইছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
পাকিস্তানের লক্ষ্য
ড. আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, 'পাকিস্তানের লক্ষ্য খুব স্পষ্ট। তারা কাবুলে এমন একটি সরকার চাইছে যেখানে তালেবানের প্রাধান্য থাকবে। কারণ পাকিস্তান মনে করে তালেবান সবসময় পাকিস্তানের পক্ষে থাকবে এবং আফগানিস্তানে ভারতের প্রভাব তাতে খর্ব হবে।'
পাকিস্তান সবসময় মনে করে, দেশটির অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য কাবুলে পাকিস্তানবান্ধব সরকারের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তালেবানের পতনের পর আফগানিস্তানে পাকিস্তানের প্রভাব দ্রুত কমে এসেছে। এর বিপরীতে দেশটিতে পাকিস্তানের চির প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের প্রভাব বেড়েছে।
বিশেষ করে, আশরাফ গনি আফগানিস্তানের ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকে তার সাথে ভারতের বিশেষ ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের জেরে পাকিস্তানের সাথে আফগান সরকারের সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছিল। পাকিস্তান বিশ্বাস করে, আফগানিস্তানে প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ পেয়ে ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসী তৎপরতায়, বিশেষ করে বেলুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদে মদদ দিচ্ছে। ভারতের এই তৎপরতায় সহায়তা করেছে কাবুলের আশরাফ গনি সরকার।
তালেবানের কাবুল দখলের পর পাকিস্তান সেই বাস্তবতা বদলানোর মোক্ষম সুযোগ পেয়েছে।
তবে বেশিরভাগ বিশ্লেষক বলছেন, অন্য অনেকের মত পাকিস্তানও চাইছে কাবুলে ভবিষ্যৎ সরকারে তালেবানের প্রাধান্য থাকলেও সরকারে তালেবান ছাড়াও অন্যান্য রাজনৈতিক পক্ষ এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ পশতুন ছাড়াও আফগানিস্তানের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর – তাজিক, হাজারা, উজবেক – প্রতিনিধিত্ব থাকুক।
ড. আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, পাকিস্তান আফগানিস্তানে এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা চাইছে যাতে এক ধরণের একটি নির্বাচন পদ্ধতি থাকবে এবং বাকি বিশ্বের কাছে কিছুটা হলেও তা গ্রহণযোগ্য হয়।
তবে কাবুলে একেবারে নিজেদের পছন্দমত সরকার চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা পাকিস্তান করছে বলে মনে করেন না ড. সিদ্দিকা।
তার মতে, পাকিস্তান চাচ্ছে অন্য আফগান নেতারা নিজেরাই তালেবানের সাথে দেন-দরবার করে ক্ষমতার অংশীদারিত্ব গ্রহণ করুক।
ড. সিদ্দিকা বলেন, 'একইসাথে পাকিস্তান চাচ্ছে সবকিছুই যেন তাদের নজরদারির মধ্যে হয়। ওই কারণেই ইসলামাবাদে এখন পুরো উত্তরাঞ্চলীয় জোটের অবস্থান। সেইসাথে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত কাবুলে তৎপর রয়েছেন।'
স্বীকৃতির প্রতিশ্রুতি
ক্ষমতা ভাগাভাগিতে তালেবান যাতে রাজী হয়, সেই কারণে এখনই ভবিষ্যৎ তালেবান সরকারকে স্বীকৃতির কোনো প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে না পাকিস্তান।
১৯৯৬ সালে তালেবান কাবুলের ক্ষমতা দখলের পর যে মাত্র তিনটি দেশ তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল তার একটি ছিল পাকিস্তান। এবার পাকিস্তান সতর্কভাবে এগুচ্ছে। মঙ্গলবার পাকিস্তান জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের এক বৈঠকের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ভবিষ্যতে কাবুল সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি 'আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে পরামর্শ' করে নেয়া হবে।
এটি স্পষ্ট যে, পাকিস্তানও তালেবানের কাছ থেকে ক্ষমতা ভাগাভাগিসহ নারী শিক্ষা এবং সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে প্রশ্রয় বন্ধের প্রতিশ্রুতি চায়।
ক্ষমতা ভাগাভাগির জন্য তালেবানের ওপর পাকিস্তানের চাপ দেয়ার বিষয়ে পাকিস্তানি নিরাপত্তা বিশ্লেষক মোহাম্মদ আমির রানা বলেন, পাকিস্তানের আশংকা রয়েছে সরকারে অন্য পক্ষের প্রতিনিধিত্ব না থাকলে আফগানিস্তানে একসময় আবারো অরাজকতা শুরু হবে।
তিনি বলেন, অন্যসব প্রতিবেশী দেশ এবং পশ্চিমা সরকারগুলোর সাথে পাকিস্তানের নীতি নির্ধারকরা এই বিষয়ে একমত হয়েছেন।
তালেবানের ওপর পাকিস্তানের প্রভাব
তবে এই ক্ষেত্রে প্রশ্ন আসে, তালেবানের ওপর পাকিস্তানের প্রভাব কতখানি এবং তারা কি পাকিস্তানি সরকারের কথা মানবে কি না।
ড. আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, এই নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, তালেবানের ওপর পাকিস্তানের বিশেষ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রভাব অনেক।
'প্রতিদিন পাকিস্তানের প্রতিটি খুঁটিনাটি কথা হয়তো তালেবান শুনবে না। কিন্তু বৃহত্তর কৌশলগত নীতির প্রশ্নে তালেবানের ওপর পাকিস্তানের প্রভাব অন্য যে কারোর চেয়ে বেশি।'
আফগানিস্তানের যুদ্ধে তালেবানের নাটকীয় বিজয় এবং দেশটিতে তাদের সরকার গঠন পাকিস্তানের ভেতর সন্ত্রাসী এবং ধর্মীয় কট্টরপন্থীদের উৎসাহিত করবে, শক্তিশালী করবে, এই নিয়ে পাকিস্তানের জনগণের একাংশ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
পাকিস্তানের উগ্রবাদী গোষ্ঠী তেহরিকে তালেবান (টিটিপি), তালেবানের বিজয়ে অভিনন্দন জানিয়েছে। দলটির বেশিরভাগ নেতাই আফগানিস্তানে পালিয়ে আছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
লন্ডনের দৈনিক গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জয়ের পর যে সব বন্দীদের তালেবান কারাগার থেকে মুক্ত করে দিয়েছে, তাদের মধ্যে টিটিপির উপপ্রধান ফকির মুহাম্মদ অন্যতম।
ড. আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, তালেবানের বিষয়ে পাকিস্তানে জনমত যে দ্বিধাবিভক্ত, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
তিনি বলেন, 'আফগানিস্তানে তালেবানের এই সাফল্যে পুরো দক্ষিণ এশিয়াতেই কট্টর ইসলামপন্থীরা চাঙ্গা হবে, তারা ভাবছে তাদের নীতিই সঠিক। পাকিস্তানে এর প্রভাব হবে সবচেয়ে বেশি। কট্টর ইসলামপন্থীরা একসময় পাকিস্তানেও একই ধরনের ইসলামি শাসন কায়েমে চাপ শুরু করবে, এমন আশংকা বহু মানুষের।"
তবে, ড. সিদ্দিকা বলেন, পাকিস্তানের ভেতরে এসব দ্বিধা-শঙ্কা থাকলেও তালেবানকে আফগানিস্তানের ক্ষমতার কেন্দ্রে বসানোর ব্যাপারে পাকিস্তানের নীতি-নির্ধারকদের মধ্যে কোনো দ্বিধা নেই।
ড. আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, 'তারা এখন পাকিস্তানের জনগণ এবং বাইরে বিশ্বকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন ১৯৯৬ সালের তালেবান আর বর্তমান তালেবান এক নয়। এরা নারী শিক্ষাকে সমর্থন করে, অন্যদের ক্ষমতার ভাগ দিতে চায়।'
সূত্র : বিবিসি ও অন্যান্য সংবাদমাধ্যম
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা