২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

এবার বাসমতি চাল নিয়ে বিরোধে জড়াচ্ছে ভারত-পাকিস্তান

বাসমতি চালের বিরিয়ানি - ছবি : সংগৃহীত

বাসমতি চাল নিয়ে ভারত ও পাকিস্তান নতুন করে বিরোধে জড়িয়েছে।

স্বাদে ও গন্ধে অতুলনীয় এই চাল চিরবৈরী এই দুটো দেশের বিশেষ কিছু অঞ্চলেই শুধু উৎপন্ন হয়।

সম্প্রতি ভারতের পক্ষ থেকে বাসমতি চালকে 'ভারতীয় পণ্য' হিসেবে ঘোষণা দেয়ার জন্য ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কাছে আবেদন করার পর- এই বিরোধের সৃষ্টি হয়েছে।

ভারতের এই আবেদনে আপত্তি উঠেছে পাকিস্তানে। তারা বলছে, শুধু ভারতে নয়, এই একই চাল পাকিস্তানেও উৎপাদিত হয়। ফলে বাসমতি চালকে শুধু ভারতীয় পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া উচিত হবে না।

পাকিস্তানি ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই চালকে শুধুমাত্র ভারতীয় পণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হলে তারা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এজন্য ভারতীয় আবেদনের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা নেয়ার জন্য তারা পাকিস্তান সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছেন।

কিন্তু ভারতীয় কর্মকর্তারা বলছেন, ভারতের এই আবেদনে পাকিস্তানের উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই। পাকিস্তান চাইলে ভারতের মতো তারাও এই পণ্যটিকে নিজেদের দাবি করে আবেদন করতে পারে।

ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন বাসমতি চালের সবচেয়ে বড় আমদানিকারক এবং পাকিস্তান ও ভারত এই দুটো দেশই এই জোটের দেশগুলোর কাছে প্রচুর পরিমাণে বাসমতি চাল রফতানি করে থাকে।

কী আছে ভারতের আবেদনে?

ভারত সরকার সম্প্রতি এই বাসমতি চালের জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন বা জিআই ট্যাগের জন্য ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কাছে আবেদন করেছে।

ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অফিসিয়াল জর্নালে ভারতের এই আবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে ১১ সেপ্টেম্বর।

এই আবেদনে বলা হয়েছে বাসমতি চাল ভারতীয় উপমহাদেশের একেবারে স্বতন্ত্র একটি চাল। আকারে এটি লম্বাটে। অনন্য স্বাদ ও সুগন্ধের কারণে সারা বিশ্বে ভারতীয় এই চালের সুখ্যাতি রয়েছে।

ভারত বলছে, হিমালয়ের পাদদেশীয় অঞ্চল, বিশেষত ইন্দো-গাঙ্গেয় অঞ্চলে বাসমতি চাল উৎপন্ন হয়।

ভারতে কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটের প্রধান ড. অশোক কুমার সিং বলেছেন, সবচেয়ে ভাল মানের বাসমতি চাল উৎপাদিত হয় ভারতের যে সাতটি রাজ্যে সেগুলোকে ইতোমধ্যে জাতীয়ভাবে জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন বা জিআই দেয়া হয়েছে।

‘জম্মুর তিনটি জেলা, অরুণাচল, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, দিল্লি, উত্তরাখণ্ড ও উত্তর প্রদেশের কিছু এলাকায় ভাল মানের বাসমতি চাল হয়। এসব রাজ্যকে ইতোমধ্যেই জিআই ট্যাগ দেয়া হয়েছে। জাতীয়ভাবে এই ট্যাগ দেয়ার পর সেটা আন্তর্জাতিক পর্যায়েও নিতে হয়। ভারত এখন সেটাই করেছে।’

পাকিস্তানের উদ্বেগ

পাকিস্তান মনে করে ভারতের এ ধরনের পদক্ষেপ নেয়া একেবারেই উচিত হয়নি। কারণ এই চাল শুধু ভারতে নয়, পাকিস্তানেও উৎপাদিত হয়।

পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর, বালুচিস্তান এবং পাঞ্জাবে উৎপাদিত বাসমতি চালের খ্যাতি রয়েছে ইউরোপের বাজারে।

ভারতীয় এই আবেদনের পর পাকিস্তানি ব্যবসায়ীদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে যে দিল্লিকে এই ট্যাগ দেয়া হলে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে পাকিস্তানের বাসমতি চাল রফতানির বাজারে বড় ধরনের ধ্বস নামবে।

ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশের পর পাকিস্তান সরকারও ভারতীয় আবেদনের জবাবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কাছে পাল্টা আবেদন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এজন্যে তারা সরকারের বিভিন্ন দফতর ও এই খাতের সাথে বেসরকারি পর্যায়ে যারা যারা জড়িত তাদের সাথেও আলাপ আলোচনা শুরু করেছে।

পাকিস্তানি কর্মকর্তারা আশা করছেন যে ভারতের এই আবেদন শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হবে। তারা বলছেন, সফল কূটনীতির মাধ্যমে তারা দিল্লির এই পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দেবেন।

কর্মকর্তারা জানিয়েছেন যে খুব শিগগিরই তারা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কাছে ভারতীয় আবেদনের বিপরীতে পাল্টা আবেদন দায়ের করবেন।

জিআই আইন কী

বাসমতি চালকে নিজেদের দাবি করে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের জিআই আইনে আবেদন করেছে ভারত সরকার।

জিআই এর অর্থ হলো জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন। অর্থাৎ পণ্যটির উৎস, উৎপত্তি, চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি এই আইনটিতে নিশ্চিত করা হয়।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্য দেশগুলোকে ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য এই আইনটিকে গ্রহণ করতে হয়।

পাকিস্তানও ২০২০ সালের মার্চ মাসে এই আইনটি গ্রহণ করেছে। তবে এর বাস্তবায়ন এখনো শুরু হয়নি। কিন্তু ভারতে এই আইনটি গৃহীত হয়েছে বহু আগে, ১৯৯৯ সালে।

এই আইনের আওতায় যে পণ্যটির গায়ে জিআই ট্যাগ থাকবে সেটি যে অঞ্চলে উৎপন্ন হয় সেই এলাকা ছাড়া ওই পণ্যের নাম আর কেউ ব্যবহার করতে পারবে না।

ভারতের যে পণ্যটিতে সর্বপ্রথম এই জিআই ট্যাগ লাগানো হয় সেটি হচ্ছে দার্জিলিং চা। এর পর এই তালিকায় তিনশোটিরও বেশি পণ্য যুক্ত হয়েছে।

এখন তাদের টার্গেট : বাসমতি চাল।

পাকিস্তানের আপত্তি

পাকিস্তানের একজন চাল রফতানিকারক এবং চাল রফতানিকারক সমিতির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান তৌফিক আহমেদ খান বিবিসিকে বলেছেন, বাসমতি চালকে ভারতীয় পণ্য হিসেবে ঘোষণা দেয়ার জন্য দিল্লি সরকার কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে।

তিনি বলেন, ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হওয়ার আগের দলিলপত্রের ওপর ভিত্তি করে ভারত যুক্তি দিতে চাইছে যে বাসমতি চাল তাদের নিজেদের পণ্য।

তার মতে, ‘পাকিস্তানের যেসব অঞ্চলে বাসমতি চাল উৎপন্ন হয় সেসব ব্রিটিশ ভারতের অংশ ছিল এবং ভারত এখন এই কৌশলের আশ্রয় নিয়ে বাসমতি চালকে নিজেদের পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা করছে।’

কী বলছে ভারত

কিন্তু ভারত বলছে, এ নিয়ে পাকিস্তানের উদ্বেগের কিছু নেই।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভারতীয় একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘ভারত ও পাকিস্তানের সরকারি পর্যায়ে এ নিয়ে আগেও আলোচনা হয়েছে। বাসমতি চাল এই দুটো দেশেই উৎপাদিত হয়। দুটো দেশেরই পণ্য এই চাল।’

তিনি বলেন, ‘ভারত স্বীকৃতি চেয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আবেদন করেছে। পাকিস্তান চাইলে তারাও সেটা করতে পারে। এখানে তো বিরোধের কিছু নেই।’

বাসমতি চালের ঐতিহাসিক দিক

ভারতীয় উপমহাদেশে বাসমতি চাল উৎপাদনের ইতিহাস বহু পুরনো।

দুই শ’ বছরেরও বেশি সময় ধরে এ চালটি ব্রিটিশ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে চাষ করা হচ্ছে।

অভিনব সুগন্ধ ও স্বাদের জন্য চালের এই বিশেষ জাতটি বিশ্বখ্যাত যা অখণ্ড ভারতের বিশেষ কিছু এলাকায় উৎপন্ন হতো। এই বাসমতি চাল শুধু আজকের ভারত ও পাকিস্তানের কিছু অঞ্চলে হিমালয়ের পাদদেশের এলাকায় উৎপাদিত হয়।

প্রাচীন কাল থেকে সুতলেজ ও চানাবের মধ্যবর্তী সমতলভূমিতে বাসমতি চলের চাষ হয়ে আসছে। ব্রিটিশ ভারত ভাগ হওয়ার পর আজকের পাকিস্তানে যেসব অঞ্চলে এই চাল উৎপন্ন হয় সেগুলো হচ্ছে গুর্জরানওয়ালা, মান্দি বাহাউদ্দিন, হাফিজাবাদ, সিয়ালকোট, শেইখুপুরা, গুজরাট এবং আরো কিছু এলাকা।

আদিকাল থেকে ভারতের পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং জম্মু কাশ্মীরে বাসমতি চালের চাষাবাদ হয়ে আসছে। পাকিস্তানের পাঞ্জাবেও এই চালটির উৎপাদন হয়।

বাসমতি চাল এখন ভারত ও পাকিস্তানের আরো কিছু অঞ্চলেও উৎপন্ন হচ্ছে। কিন্তু এসব চালের গুণগত মান ও গন্ধ আদি জায়গাগুলোর চালের চেয়ে আলাদা।

পাকিস্তানের চাল রফতানিকারক তৌফিক আহমেদ খান জানান, আফ্রিকা ও আমেরিকাতেও বাসমতি চাল উৎপাদনের চেষ্টা করা হয়েছে। তবে সেগুলো সফল হয়নি।

তিনি বলেন, ‘বাসমতি চাল ভারত ও পাকিস্তানের যৌথ ঐতিহ্য এবং তাদের উৎপাদিত এই চালের স্বাদ ও গন্ধ চালের অন্যান্য জাতের চেয়ে ভিন্ন।’

এই চালের জন্য যেসব ভৌগলিক উপাদান প্রয়োজন সেগুলো শুধু ভারত ও পাকিস্তানের কিছু এলাকাতেই আছে।

বাসমতি চাল রফতানি

পাকিস্তান সাধারণ প্রতি বছর ৫০ থেকে ৭০ লাখ টন চাল রফতানি করে থাকে। গত অর্থ বছরে রফতানি করেছে ৪০ লাখ টন। তার মধ্যে পাঁচ লাখ টন ছিল বাসমতি চাল।

চাল রফতানি করে পাকিস্তান গত অর্থ বছরে আয় করেছে দুই শ’ কোটি ডলার।

ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, চীন এবং কেনিয়াতে সবচেয়ে বেশি চাল রফতানি করে পাকিস্তান। তার মধ্যে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন বাসমতি চাল, চীন সব ধরনের চাল আমদানি করে থাকে।

পাকিস্তানের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে বাসমতি চাল রফতানি করে ভারত। গত অর্থ বছরে তাদের রফতানির পরিমাণ ছিল ৪৪ লাখ টন যার আর্থিক পরিমাণ প্রায় পাঁচ শ’ কোটি ডলার।

কিন্তু ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে ভারতের বাসমতি চাল রফতানি হয় খুবই কম। ভারতের কাছে বাসমতি চালের সবচেয়ে বড় বাজার সৌদি আরব ও ইরান।

ভারতে বাসমতি চাল বিশেষজ্ঞ এবং ভারতে কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটের প্রধান অশোক কুমার সিং বলেন, ‘ভারত সারা বিশ্বে যতো বাসমতি চাল রফতানি করে তার ৭৫ শতাংশই করা হয় মধ্যপ্রাচ্যে। ভারতের জন্য বাসমতি চালের সবচেয়ে বড় বাজার সৌদি আরব ও ইরান।’

পাকিস্তানের উদ্বেগের কারণ কী

পাকিস্তানের চাল রপ্তানিকারক তৌফিক আহমেদ খান মনে করেন, অসৎ উদ্দেশ্য থেকেই ভারত বাসমতি চালকে নিজেদের পণ্য বলে দাবি করছে।

তিনি বলেন, ভারত যদি এতে সফল হয় তাহলে সবচেয়ে খারাপ যেটা হতে পারে তা হলো ভারত হয়তো পাকিস্তানকে বাসমতি নাম ব্যবহার করতে বাধা দিতে পারে।

‘তখন হয়তো পাকিস্তান তার চালের ব্যাগ কিম্বা প্যাকেটের গায়ে বাসমতি নামটি ব্যবহার করতে পারবে না।’

তার আশঙ্কা বাসমতি নামটি ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হলেও এই নামের জন্য ভারতকে হয়তো রয়্যালটি প্রদান করতে হতে পারে।

তিনি জানান, ভারতীয় আবেদনের বিরুদ্ধে পাল্টা আবেদনের জন্য পাকিস্তানের হাতে এখনো তিন মাস সময় আছে।

পাকিস্তান কী ঠেকাতে পারবে?

ভারতের আবেদনের পর এ বিষয়ে পাকিস্তান সরকার তৎপর হয়ে উঠেছে এবং তাদের পরবর্তী পদক্ষেপের ব্যাপারে সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন পক্ষের সাথে আলাপ আলোচনা শুরু করেছে।

পাকিস্তানি পার্লামেন্টের উচ্চ কক্ষ সেনেটের একটি প্যানেলও ভারতীয় আবেদন ঠেকানোর ব্যাপারে সক্রিয় হয়েছে।

সেনেট কমিটির চেয়ারম্যান মির্জা মোহাম্মদ আফ্রিদি বলেছেন, পাকিস্তানে জিআই আইনটি পাস হয়েছে এ বছরের মার্চ মাসে কিন্তু ভারতে বহু আগেই সেটা করা হয়েছে।

‘ভারত এ থেকে সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করছে,’ বলেন তিনি।

তিনি আশা করেন যে সরকারের গৃহীত উদ্যোগের ফলে ভারতের আবেদন ব্যর্থ হবে এবং তারাও ‘মেইড ইন পাকিস্তান’ এই ট্যাগ লাগিয়ে বাসমতি চালের রপ্তানি অব্যাহত রাখতে পারবেন।

পাকিস্তানে ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অর্গানাইজেশনের চেয়ারম্যান মুজিব খান বলেছেন, ২০০৬ সালের ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের এক আইনে বাসমতি চাল ভারত ও পাকিস্তানের যৌথ পণ্য হিসেবে ইতোমধ্যেই উল্লেখ করা হয়েছে।

তিনি বলেন, ভারতীয় আবেদনের বিরোধিতা করতে পাকিস্তানের প্রস্তুতি চলছে এবং ইউরোপিয়ান কাউন্সিলে হেরে গেলেও তারা ইউরোপিয়ান কোর্ট অফ জাস্টিসের কাছে নিয়ে যাবেন।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement