কেন ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত? দুই ভারতীয় মুসলিম নারী
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ২১ ডিসেম্বর ২০১৯, ২২:০৯
কলকাতায় আত্মীয়- স্বজন, প্রতিবেশীদের মধ্যে এখন সারাক্ষণই কাগজ-পত্র জোগাড়ের চিন্তা, তা নিয়েই সবসময় আলোচনা হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী (মমতা ব্যানার্জি) ভরসা দিচ্ছেন এখানে এন আর সি (জাতীয় নাগরিক পঞ্জী) করতে দেবেন না, কিন্তু মুসলিমরা ভরসা পাচ্ছেন না। তারা ধরেই নিচ্ছেন আজ হোক, কাল হোক তাদেরকে কাগজপত্র দিয়ে প্রমাণ করতে হবে যে তারা ভারতীয় নাগরিক।
আমার পরিবারের কথা ধরুন - শ্বশুর কুলের কাগজ-পত্র সব ঠিকঠাক আছে, কিন্তু আমার বাবার জমি-জমা নেই বললেই চলে, ফলে দলিল-পত্রও নেই। সেটা নিয়ে আমার চিন্তা হয়। কাগজপত্র সব দেয়া যাবে তো।
আমাদের বা আমাদের ছেলে-মেয়েদের জন্মের সার্টিফিকেট না হয় আছে। গুরুজনদের তো নেই। গরীব-অশিক্ষিত মুসলিমরা কাগজ-পত্র তো রাখেই না। ওদের কি হবে?
আমি এই কলকাতাতেই জন্মেছি। আশুতোষ করে পড়াশোনা করেছি। এখন শিক্ষকতা করছি। এই শহরেই সব। তারপরও কেন যে এখন ভবিষ্যৎ নিয়ে ভরসা পাইনা, এটা ভাবলেই নিজের কাছেও যেমন কেমন অবাক লাগে।
কিছু রাজনীতিকের কথা শুনে খুব ভয় লাগে। মনে হয় তারা বোধ চাইছেন না আমরা মুসলিমরা এদেশে থাকি। অন্তত মুসলিমের সংখ্যা তারা মনে হয় কমাতে চায়।
আমাদের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। কিন্তু সবাই যদি ভেতরটা দেখতো, তাহলে দেখতে পেত আমরা মুসলিমরা এদেশকে কতটা ভালোবাসি।
এই শহরে বড় হয়েছি। এত হিন্দু-মুসলিম ভেদাভেদের কথা কখনো শুনিনি।
মেয়ে কলেজে পড়ে। কিন্তু এদেশে ওর ভবিষ্যৎ কি তা নিয়ে এখন আর পুরোপুরি ভরসা পাইনা।
নাগরিকত্ব আইন, এন আর সি এসব নিয়ে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ হচ্ছে, কিন্তু তাতে লাভ কি হবে? আমরা কি পারবো?
ভারতে অনেক মুসলিমের মত আমিও এখন দিন-রাত ভাবি এদেশে আমার ভবিষ্যৎ কী?
অমার ধর্মের কারণে কি আমাকে চাকরি দেওয়া হবেনা? আমাকে কি বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হবে? এই ভয়-দুশ্চিন্তা থেকে আমাদের কি কখনো মুক্তি হবে?
অমার ইউনিভার্সিটি জামিয়া মিলিয়াতে রাতভর সহিংসতার পর মা আমাকে আশ্বস্ত করতে বলেছিলেন, ‘ধৈর্য ধর।’
নতুন নাগরিকত্ব আইন নিয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে পুলিশের হাতে বেধড়ক পিটুনি খান জামিয়ার ছাত্র-ছাত্রীরা। তাদের ক্লাসরুমে, লাইব্রেরিতে পর্যন্ত পুলিশ ঢুকে ভাঙচুর করে, কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে।
নতুন নাগরিকত্ব আইনে আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে থেকে আসা শরণার্থীদের ভারতীয় নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শুধু মুসলিমদের এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
পুলিশ বলছে, তারা গুলি করেনি। তাহলে হাসপাতালে গুলিতে জখম লোকগুলো কি মিথ্যা বলছে?
আমি জামিয়া ইউনিভার্সিটিতে ডেনটিস্ট্রি পড়ছি। গত কয়েক বছরে আমি ক্যাম্পাসে বেশ কিছু শন্তিপূর্ণ বিক্ষোভ-সমাবেশ দেখেছি।
রোববার বিক্ষোভে আমি অংশ নিইনি। কিন্তু পুলিশ যে হামলা চালালো আমি তার শিকার হয়েছিলাম।
পুলিশ যখন আমাদের হস্টেলের দিকে আসছিল, আমি ভয়ে চিৎকার শুরু করে দিয়েছিলাম। আমরা বাতি বন্ধ করে লুকানোর চেষ্টা করছিলাম।
ভাগ্যিস তেমন কোনো দুর্ঘটনা ছাড়া রাত পার হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেল : তুমি সমালোচনা বা প্রতিবাদ করো আর নাই করো, মুসলিম হিসাবে তুমি টার্গেট হবে।
ছোটবেলায় অনেক দিন সকালে আমার ঘুম ভাঙতো ভজনের সুরে। উড়িষ্যার একটি হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় আমরাই ছিলাম একমাত্র মুসলিম পরিবার।
আমরা সবসময় বিভিন্ন ধর্মীয় পালা-পার্বন একসাথে উপভোগ করেছি। ইদের সময় আমার হিন্দু বন্ধুরা আমার হাতে মেহেদি দিয়ে দিয়েছে। আবার একসাথে নবরাত্রিতে মজা করেছি।
বিরিয়ানির লোভে আমার অনেক হিন্দু বন্ধু হর-হামেশা আমাদের বাড়িতে আসতো।
আমাদের মহল্লায় বা ধারে কাছে কোনো মসজিদ ছিলনা। কিন্তু আমার বাবা কোনোদিন তার ধার ধারেননি, কারণ তিনি নামাজ পড়তেন না। আমার মা ঘরেই নামাজ পড়তেন।
আমি যে কনভেন্ট স্কুলে পড়তাম, সেখানকার সিংহভাগ শিক্ষার্থীই ছিল হিন্দু। কিন্তু কোনোদিন আমি কোনো বৈষম্যের শিকার হইনি।
শুধু একদিন একদিন আমার এক হিন্দু বন্ধু আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল মুসলিমরা নাকি প্রতিদিন গোসল করেনা। শুনে আমি হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলাম।
ধর্ম আমাদের জীবনের অংশ ছিল ঠিকই, কিন্তু কোনোদিন আমি নিজেকে শুধু মুসলিম হিসাবে ভাবিনি। এখনও ভাবিনা।
কিন্তু একটি গোষ্ঠী এখন মাঠে নেমে আমাদের ভাগ করে দিতে চাইছে। ফলে আমার এখন আর ভরসা হয়না যে যে জীবন আমার এতদিন ছিল, তা আর থাকবে।
আমাদের দিন দিন এমন কথা বেশি বেশি শুনতে হচ্ছে যে আমরা মাংস-খেকো, আমার ধর্ষণকারী, সমাজকে কলুষিত করছি, আমরা সন্ত্রাসী, পাকিস্তানের স্বার্থ রক্ষা করছি, প্রেমের ছলে হিন্দুদের মুসলমান বানাচ্ছি, এবং আমরা দেশকে দখল করে নিতে চাই।
বাস্তব সত্য যেটা তা হলো - আমাদেরকে এদেশে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক বানানো হচ্ছে, যাদেরকে ভয়ে ভয়ে টিকে থাকবে হবে।
এক টুইটে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘এখন শান্তি, ঐক্য এবং ভ্রাতৃত্ব স্থাপনের সময়।’
অথচ তার আগের দিনই তিনি হাজার হাজার মানুষের সামনে, ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে বলেছেন, ‘কারা সরকারি সম্পত্তিতে আগুন দিচ্ছে তাতো টিভিতেই দেখা গেছে- তাদের পোশাক দেখেই তো চেনা যায়।’
তিনি খুলে বলেননি, কিন্তু আসলে তিনি একটি ধর্মের দিকে আঙ্গুল তুলেছেন। দুঃখের বিষয় যে এসব দেখে আমি এখন ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়ছি।
আমি শারীরিক বা পোশাকের কথা বলছি না, কারণ আমি ১৬ বছর বয়স থেকে হিজাব পরি। যখন আমি আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম তখন দেখলাম অনেক ছাত্রী হিজাব পরে। আমিও হিজাব ধরলাম।
২২ বছর বয়সে আমাকে এখন আমার ধর্মের বিরুদ্ধে অপপ্রচার এবং দেশের সংবিধানের বিরুদ্ধে আঘাতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে বাধ্য করা হচ্ছে।
আমি বৈষম্যের বিরুদ্ধে, অর্থনীতির বেহাল অবস্থার সমালোচনা করতে চাই।
কিন্তু প্রতিবারই আমাকে ‘দেশ-বিরোধী’ ‘হিন্দু-বিরোধী’ বলে আমাকে ঠেলে পেছনে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বলতে গেলেও আমাকে বলা হয়, আমি ‘হিন্দু-মুসলিম’ইস্যু টেনে আনছি।
আমরা এখন এমন এক সময়ে বসবাস করছি যেখানে ধর্ম আর জাতীয়তাবাদকে এক করে ফেলা হয়েছে। এখন রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় আমার মনে হয়, হিজাবের কারণে মানুষজন আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
হয়তে আমি অযৌক্তিকভাবে এসব ভাবছি, কিন্তু ইসলাম বিদ্বেষ যে ছড়িয়ে পড়ছে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
আমরা এখন ফিসফিস করে নিজেদের মধ্যে আলাপ করি নতুন আরেকটি আইন এলে আমাদের কী হবে? সবাইকেই কি নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে হবে?
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মন্ত্রী তো বলেছেন ২০২৪ সালে নির্বাচনের আগে ভারত-জুড়ে নাগরিক-পঞ্জী চালু করা হবে।
কিন্তু এখনও আশা পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়নি।
এই ঘৃণা এবং জঘন্য বিদ্বেষী মনোভাবের বিরুদ্ধে দেশে জুড়ে মানুষজন কথা বলতে শুরু করেছে। হয়তো অনেক মানুষের মনে প্রশ্ন তৈরি হবে, তারা যুক্তি দিয়ে ভাববে। কিন্তু এখন আমার চারপাশের এতদিনকার পরিচিত পরিবেশ ধসে পড়ছে আর আমি চুপ করে চেয়ে দেখছি ।
আমাকে হস্টেল থেকে বের করে জোর করে ছুটিতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। পড়াশোনা আপাতত বন্ধ। পরিবারের কাছে যেতে পারছি না, কারণ তারা যে শহরে থাকে সেখানেও বিক্ষোভ শুরু হয়েছে।
সুতরাং আমি দিল্লিতে এক আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নিয়েছি এবং মায়ের কথাগুলো নিয়ে ভাবছি - ‘ধৈর্য ধরো, শক্তি হারিও না।’ সূত্র : বিবিসি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা