২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১ ফাল্গুন ১৪৩১, ২৪ শাবান ১৪৪৬
`

আফ্রিকার আসক্তিকর ওপিওয়েড সংকটে ইন্ধন দিচ্ছে যে ভারতীয় কোম্পানি

আফ্রিকার আসক্তিকর ওপিওয়েড সংকটে ইন্ধন দিচ্ছে যে ভারতীয় কোম্পানি - ছবি - সংগৃহীত

ভারতের একটা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি লাইসেন্সবিহীন ও উচ্চ আসক্তির ওপিওয়েড তৈরি করে সেগুলো পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোতে অবৈধভবে রফতানি করছে। এর ফলে ঘানা, নাইজেরিয়া ও আইভোরি কোস্টসহ কয়েকটি দেশে বড় পরিসরে জনস্বাস্থ্য সংকট সৃষ্টি হয়েছে।

বিবিসি আইয়ের তদন্তে এমন তথ্যই উঠে এসেছে।

উল্লেখ্য, ওপিওয়েড হলো প্রাকৃতিক, অর্ধেক কৃত্রিম ও সংশ্লেষণের মাধ্যমে তৈরি এক জাতীয় ওষুধ। ব্যথার চিকিৎসায় এটি ব্যবহার করেন চিকিৎসরা। তবে হেরোইনের মতো মাদক হিসেবেও একে ব্যবহার করা হয়।

মুম্বাইভিত্তিক অ্যাভিও ফার্মাসিউটিক্যালস বিভিন্ন ধরনের ওষুধ তৈরি করে। এসব ওষুধ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নামে ও প্যাকেটে এমনভাবে বাজারে ছাড়া হয় যেগুলোকে দেখলে বৈধ ওষুধ বলেই মনে হয়। কিন্তু এসব ওষুধ টাপেন্ডাটলের মতো শক্তিশালী ওপিওয়েড ও পেশী শিথিলকারী ওষুধ ক্যারিসোপ্রোডলের সংমিশ্রণে তৈরি। উচ্চ মাত্রার আসক্তি সৃষ্টির কারণে এগুলো ইউরোপে নিষিদ্ধ।

এসব উপাদানের সমন্বয়ে তৈরি করা ওষুধ শ্বাসপ্রশ্বাসে সমস্যা তৈরি করতে পারে এবং খিঁচুনি তৈরির জন্য দায়ী হতে পারে। এগুলো অতিমাত্রায় সেবনের কারণে মৃত্যুও ঘটতে পারে। যে কারণে এগুলো ব্যবহারের অনুমোদন বা লাইসেন্স বিশ্বের কোনো জায়গাতেই নেই।

তবে স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকার পরও পশ্চিম আফ্রিকার অনেক দেশে এসব ওপিওয়েড ‘স্ট্রিট ড্রাগ’ (ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়াই পাওয়া যায় এবং অনেক ক্ষেত্রে নেশার জন্য এর অপব্যবহার করা হয়) হিসেবে খুবই জনপ্রিয়। এর কারণ হচ্ছে এগুলো দামে সস্তা ও সহজলভ্য।

বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস ঘানা, নাইজেরিয়া ও আইভরি কোস্টের শহর ও শহরতলির রাস্তায় বিক্রি হওয়া ওষুধের প্যাকেট খুঁজে পেয়েছে যেখানে অ্যাভিও কোম্পানির লোগো রয়েছে।

এ ওষুধের সাথে অ্যাভিওর সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি জানার পর বিবিসি ওই কোম্পানির কারখানায় পরিচয় গোপন করে একজন প্রতিনিধি পাঠায়। তিনি নিজেকে আফ্রিকান একজন ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দেন এবং বলেন যে নাইজেরিয়ায় ওপিওয়েড সরবরাহের জন্য খোঁজ চালাচ্ছেন।

গোপন ক্যামেরা ব্যবহার করে বিবিসি যে ভিডিও রেকর্ড করেছে, সেখানে অ্যাভিওর অন্যতম পরিচালক বিনোদ শর্মাকে সেই বিপজ্জনক ওষুধই প্রকাশ্যে তুলে ধরতে দেখা গেছে যেগুলো পশ্চিম আফ্রিকাজুড়ে রাস্তায় রাস্তায় বিক্রি হয়।

পরে তিনি ব্যাখ্যা করেন, ব্যবহারকারীরা যদি একবারে দুটি বা তিনটি বড়ি সেবন করেন তবে তারা ‘রিল্যাক্সড’ বোধ করবেন। পাশাপাশি এটাও বলেন, তারা নেশাগ্রস্ত অনুভব করতে পারে।

এ বৈঠকের একেবারে শেষের দিকে বিনোদ শর্মা বলেন, ‘এটা স্বাস্থ্যের পক্ষে খুবই ক্ষতিকর। কিন্তু আজকালকার দিনে এটাই ব্যবসা।’

উত্তর ঘানার তামালে শহরে এত বেশি সংখ্যক তরুণ ওপিওয়েড জাতীয় অবৈধ এসব ওষুধ সেবন করছে যে শহরের প্রধান কর্মকর্তাদের মধ্যে অন্যতম আলহাসান মাহাম প্রায় ১০০ জন স্থানীয় নাগরিককে নিয়ে একটি স্বেচ্ছাসেবী টাস্কফোর্স গঠন করেছেন।

তাদের লক্ষ্য মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো এবং রাস্তার আনাচ-কানাচ থেকে এ জাতীয় বড়িগুলো নির্মূল করে ফেলা।

আলহাসান মাহাম বলেন, ‘সেবনকারীদের চিন্তাশক্তিকে গ্রাস করে এই মাদক। ঠিক যেমন কেরোসিন ঢালার পর আগুন আরো বেশি করে জ্বলে ওঠে।’

অ্যাভিওর ওই বড়ি যে শুধুমাত্র তামালেই দুর্ভোগ ডেকে এনেছে এমনটা নয়। অ্যাভিওর তৈরি একই জাতীয় ওষুধ ঘানার অন্য এলাকা থেকেও পুলিশ বাজেয়াপ্ত করেছে।

বিবিসি আরো প্রমাণ পেয়েছে, অ্যাভিওর বড়ি নাইজেরিয়া ও আইভরি কোস্টের রাস্তায় বিক্রি হচ্ছে এবং সেখানকার কিশোর-কিশোরীরা নেশা করতে অ্যালকোহলযুক্ত এনার্জি ড্রিংকে ওই বড়ি মিশিয়ে ব্যবহার করে।

জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত রফতানি সংক্রান্ত তথ্য থেকে জানা গেছে, অ্যাভিও ফার্মাসিউটিক্যালস ও তাদের সহযোগী সংস্থা ওয়েস্টফিন ইন্টারন্যাশনাল মিলে এ জাতীয় লাখ লাখ ট্যাবলেট ঘানা ও পশ্চিম আফ্রিকার অন্যান্য দেশগুলোতে পাঠাচ্ছে।

২২ কোটি ৫০ লাখ জনসংখ্যার দেশ নাইজেরিয়া এ জাতীয় বড়ির বৃহত্তম বাজার হয়ে উঠেছে। নাইজেরিয়ার জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, আনুমানিক ৪০ লাখ নাইজেরিয়ান কোনো না কোনো ধরনের ওপিওয়েডের অপব্যবহার করে।

স্ট্রিট ড্রাগ হিসেবে ওপিওয়েড জাতীয় ওষুধের বিক্রি সম্পর্কে ২০১৮ সালে বিবিসি আফ্রিকা আইয়ের তদন্তের পরে নাইজেরিয়ান কর্তৃপক্ষ ট্রামাডল নামে এক ধরনের ব্যথা উপশমকারী ওপিওয়েড নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছিল।

সরকারের প্রচেষ্টায় প্রেসক্রিপশন ছাড়া ট্রামাডল বিক্রি নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়। এর সর্বাধিক ডোজের ওপর কঠোর সীমা আরোপ করা হয় এবং অবৈধভাবে এ জাতীয় ওষুধের বড়ি আমদানির ওপর কঠোর ব্যবস্থাও নেয়া হয়।

একইসাথে ভারতীয় কর্তৃপক্ষও ট্রামাডল রপ্তানির ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে।

এর খুব অল্প সময়ের মধ্যেই অ্যাভিও ফার্মাসিউটিক্যালস টাপেন্টাডল নামক আরো শক্তিশালী ওপিওয়েডের সাথে মাসল-রিল্যাক্সান্ট (পেশী শিথিলকারী ওষুধ) ক্যারিসোপ্রোডল মিশিয়ে এক ধরনের নতুন বড়ি রফতানি শুরু করে।

পশ্চিম আফ্রিকার কর্মকর্তারা সতর্ক করে জানান, ধরপাকড় এড়াতে ওপিওয়েড রফতানিকারকরা ট্রামাডলের বিকল্প হিসেবে এই নতুন সংমিশ্রণের বড়ি ব্যবহার করছে।

বিবিসির ছদ্মবেশী প্রতিনিধিকে বিনোদ শর্মা বলেন, তার কারখানায় কর্মরত ‘বিজ্ঞানীরা’ বিভিন্ন ওষুধ একত্রিত করে ‘নতুন প্রোডাক্ট তৈরি’ করতে পারেন।

অ্যাভিওর তৈরি ট্রামাডল প্রতিস্থাপনকারী নতুন পণ্যটি আগেরটির চেয়েও বেশি বিপজ্জনক।

ভারতের বেঙ্গালুরুর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড নিউরো সায়েন্সের সহকারী অধ্যাপক ড. লেখাংশ শুক্লার মতে, ‘ট্যাপেন্টাডল সেবনে গভীর ঘুমসহ ওপিওয়েডের মতোই প্রভাব দেখা যায়।’

তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘এটা এত গভীর হতে পারে যে মানুষ শ্বাস নিতে পারে না এবং ব্যাপারটা ড্রাগ ওভারডোজের দিকে চলে যায়। এর পাশাপাশি ক্যারিসোপ্রোডল নামের আরো এক জাতীয় এজেন্ট দেয়া হচ্ছে যার ফলে ঘুম খুব গভীর হয়। এটা খুব বিপজ্জনক সংমিশ্রণ বলেই মনে হচ্ছে।’

ক্যারিসোপ্রোডল ইউরোপে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবহারের অনুমোদন থাকলেও তা স্বল্প সময়ের জন্য ব্যবহার করা যায় এবং এর সর্বাধিক সময়সীমা তিন সপ্তাহ।

তবে অ্যাভিও একমাত্র ভারতীয় সংস্থা নয় যারা লাইসেন্সবিহীন ওপিওয়েড তৈরি ও রফতানি করে।

জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত রফতানি সংক্রান্ত তথ্য থেকে জানা গেছে, অন্যান্য একাধিক ফার্মা একই ধরণের পণ্য তৈরি করে এবং বিভিন্ন ব্র্যান্ডের এ ওষুধগুলো পশ্চিম আফ্রিকা জুড়ে ব্যাপকভাবে পাওয়া যায়।


আরো সংবাদ



premium cement
যৌন নীপিড়ন ও শ্লীলতাহানির অভিযোগে ওসির বিরুদ্ধে মামলা, বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ ঢাকায় কেমন রাজনৈতিক বিন্যাস চায় দিল্লি বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কের বিষয়ে ভারতকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে : তৌহিদ শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করল কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় পুলিশের উপর হামলা করে আ’লীগ নেতাকে ছিনতাই বর্তমান পরিস্থিতিতে আনসার সদস্যরা দৃঢ় ভূমিকা পালন করছে : ডিজি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা জামায়াতের আমির হলেন মুবারক হোসাইন আকন্দ বিডিআর গণহত্যা : জাতীয় নিরাপত্তা উদ্বেগ প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সামনে জামায়াত ঘোষিত কর্মসূচি আপাতত স্থগিত ‘দেশ ও জনগণের জন্য সেবা করতে চাই’ বাংলাদেশে নৈরাজ্যের ষড়যন্ত্র ও ভারতের অপপ্রচার

সকল