০৫ জানুয়ারি ২০২৫, ২১ পৌষ ১৪৩১, ৪ রজব ১৪৪৬
`

‘স্পেডেক্স মিশন’ ভারতের জন্য কেন গুরুত্বপূর্ণ

স্পেডেক্স অভিযান মূলত 'ডকিং' এবং 'আনডকিং' প্রযুক্তি রপ্ত করার উদ্দেশ্যে লঞ্চ করা হয়েছে। - ছবি : বিবিসি

চলতি বছর শেষের ঠিক আগের দিনে অর্থাৎ ৩০ ডিসেম্বর ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের নেলোর জেলার সতীশ ধাওয়ান স্পেস সেন্টার থেকে ভারতীয় সময় রাত ৯টা ৫৮ মিনিটে লঞ্চ হতে চলেছে ‘স্পেডেক্স‘ মিশন।

এই ‘স্পেডেক্স‘ অর্থাৎ স্পেস ডকিং এক্সপেরিমেন্টের উদ্দেশ্য হলো মহাকাশযানকে ‘ডক‘ এবং ‘আনডক‘ প্রযুক্তির বিকাশ এবং প্রদর্শন।

এর মানে হচ্ছে, পৃথিবীর কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান দু’টি মহাকাশযানকে সংযুক্ত করা বা ডকিং এবং তাদের বিচ্ছিন্ন করা বা আনডকিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় যে প্রযুক্তি, তারই বিকাশ।

এ অভিযান সফল হলে ভারত বিশ্বের চতুর্থ দেশ হিসেবে এই গুরুত্বপূর্ণ অথচ জটিল প্রযুক্তি রফতানিকারী দেশ হবে। এর আগে কেবল রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন এ প্রযুক্তি আয়ত্ত করেছে।

ইসরো-র চেয়ারম্যান ড. এসপি সোমনাথ জানিয়েছেন, ‘স্পেডেক্স‘-এর সাফল্যের উপর অনেকটাই নির্ভর করছে ভারতের আগামী দিনের একাধিক মহাকাশ পরিকল্পনা।

দেশটির কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী, ভূ-বিজ্ঞান প্রতিমন্ত্রী ড. জিতেন্দ্র সিং গণমাধ্যমকে বলেছেন, চলতি বছরে ইসরোর শেষ অভিযান ‘ঐতিহাসিক‘। কারণ এর উদ্দেশ্য মহাকাশে দু’টি কৃত্রিম উপগ্রহকে একত্রিত করার জটিল পদ্ধতি রপ্ত করা।

তিনি এই অভিযানের জন্য জানিয়েছেন, ‘ভারতীয় ডকিং সিস্টেম‘ ব্যবহার করবে ইসরো।

‘ডকিং‘ এবং ‘আনডকিং‘ প্রযুক্তি ভারতের মহাকাশ অভিযানসংক্রান্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষা, যেমন চন্দ্রাভিযান, মহাকাশ থেকে নমুনা সংগ্রহ ইত্যাদির জন্য যেমন অপরিহার্য, একইভাবে মহাকাশ প্রযুক্তিতে বলীয়ান দেশের তালিকায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রেও এটি ভারতকে সুবিধা দেবে বলে বলছেন বিশ্লেষকেরা।

‘স্পেডেক্স‘ অভিযান কী
‘স্পেডেক্স‘ অভিযান দু’টি ছোট মহাকাশযান ব্যবহার করে ‘ইন-স্পেস‘ ডকিংয়ের জন্য এটি একটা সাশ্রয়ী প্রযুক্তি মিশন। একই উদ্দেশ্যে যখন একাধিক মহাকাশযান ব্যবহার করা হয়, তখন ‘ইন-স্পেস ডকিং‘ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়।

এই অভিযানে মূলত দু’টি ছোট মহাকাশযান রয়েছে- ‘এসডিএক্স ০১‘ এবং ‘এসডিএক্স ০২‘। এদের ওজন প্রায় ২২০ কেজি।

এগুলো পিএসএলভি-সি৬০- এর মাধ্যমে উৎক্ষেপণ করা হবে। পিএসএলভি হলো পোলার স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকেল বা মেরু উপগ্রহ উৎক্ষেপণ যান।

ভারতের সংবাদমাধ্যমে বলা হচ্ছে, দু’টি মহাকাশযান বানাতে এবং অন্যান্য সরঞ্জামের জন্য ভারতীয় মূল্যে আনুমানিক ১২৫ কোটি টাকা এবং উৎক্ষেপণ যন্ত্রের জন্য আনুমানিক ২৫০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।

কিভাবে কাজ করবে এটি
ইসরো জানিয়েছে, পিএসএলভি-সি৬০-র সাহায্যে সফলভাবে উৎক্ষেপণের পর তারা স্বাধীনভাবে এবং একযোগে পৃথিবী থেকে ৪৭০ কিলোমিটার দূরত্বে ৫৫ ডিগ্রিতে ঘুরপথে যাবে। এর স্থানীয় সময় চক্র হবে প্রায় ৬৬ দিনের।

এর মধ্যে এসডিএক্স ০১ হবে চেজার মানে স্যাটেলাইট এবং অন্যটি অর্থাৎ এসডিএক্স ০২ হবে টার্গেট।

প্রাথমিকভাবে চেজার এবং টার্গেটের মধ্যে দূরত্ব থাকবে। কিন্তু এক সময় তা কমতে কমতে এই দুই মহাকাশযান কাছাকাছি চলে আসবে। এরপর নির্দিষ্ট সময়ে ‘ডকিং‘ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। সফলভাবে ‘ডকিং‘ এবং নির্দিষ্ট কক্ষপথে অক্ষ স্থির করা পর এই দুই মহাকাশযানের মধ্যে বৈদ্যুতিক শক্তি স্থানান্তর হবে। এরপর শুরু হবে ‘আনডকিং‘ পদ্ধতি।

এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর নিজ নিজ অভিযানের উদ্দেশ্যে কাজ করা শুরু করবে ওই দুই উপগ্রহের পেলোড। তাদের প্রত্যাশিত অভিযানের মেয়াদ দুই বছর পর্যন্ত বলে আশা করা হচ্ছে।

প্রসঙ্গত, পেলোড হলো মহাকাশযানের এমন একটা অংশ যা কোনো নির্দিষ্ট অভিযানের উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়।

বেসরকারি টেলিভিশন এনডিটিভিকে ইসরোর চেয়ারম্যান ড. এসপি সোমনাথ বলেছেন, ‘যখন মহাকাশে থাকা একাধিক বস্তুকে কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে একত্রিত করার প্রয়োজন হয় তখন দরকার, তখন ডকিং নামে এক প্রক্রিয়া ব্যবহার করা হয়।’

‘ডকিং এমন এক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে দু’টি স্পেস অবজেক্ট একত্রিত হয় এবং সংযুক্ত করা হয়। এটা বিভিন্ন পদ্ধতির ব্যবহার করে সম্পন্ন হতে পারে। যেমন সফ্ট মেকানিজম, হার্ড মেকানিজম বা মানব স্থানান্তরের জন্য প্রেসারাইজড কম্পার্টমেন্টের ব্যবহার।’

উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, এটি আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে, ক্রু মডিউলগুলো স্টেশনে ডক করে, চাপ যাতে সমতাযুক্ত হয় তার ব্যবস্থা করে এবং মহাকাশচারীদের স্থানান্তর করে।’

ভারতের মহাকাশ বিজ্ঞানের বিকাশ এবং আগামী অভিযানের জন্য এই প্রযুক্তি রপ্ত করা প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন তিনি। এই ডকিং প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল বলে ব্যাখ্যা করেছেন তিনি। অভিযান শুরুর আগে বহু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়েছে বিজ্ঞানীদের।

ড. সোমনাথ ব্যাখ্যা করেছেন, তীব্রগতিতে দুই উপগ্রহকে মহাকাশে কাছাকাছি এনে সংযোগ স্থাপন করা বেশ কঠিন।

তাদের উচ্চ বেগ সত্ত্বেও, নিরাপদ সংযোগ নিশ্চিত করতে তাদের মধ্যে আপেক্ষিক গতি প্রতি সেকেন্ডে মাত্র সেন্টিমিটার বা মিলিমিটারে হ্রাস করতে হবে।

ড. সোমনাথের কথায়, ‘সংঘর্ষ এড়াতে স্যাটেলাইটগুলোর অ্যাপ্রোচ বেগ প্রতি সেকেন্ডে এক সেন্টিমিটারের কম হতে হবে।’

অভিযানের প্রস্তুতির সময় যে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়েছে তাও ব্যাখ্যা করেছেন তিনি। তার কথায়, ‘পৃথিবীতে মহাকাশের মতো মাধ্যাকর্ষণ শূন্য পরিবেশ নেই। সেই কারণে গ্রাউন্ড টেস্টিং-এর কাজটা ভীষণ কঠিন। এজন্য প্রয়োজন আমাদের উদ্ভাবনী হার্ডওয়্যার এবং রোবোটিক টেস্ট সেটআপ।‘

স্পেডেক্স-এর উদ্দেশ্য
ভারতের মহাকাশ উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্য ডকিং এবং আনডকিং প্রযুক্তি আয়ত্ত করা অপরিহার্য। যেমন চাঁদে পাড়ি দেয়া, চাঁদ থেকে নমুনা সংগ্রহ, ভারতীয় মহাকাশ স্টেশন বিএএস নির্মাণ ও পরিচালনা করা ইত্যাদি।

ড. সোমনাথ ব্যাখ্যা করেছেন, ‘স্পেডেক্স মিশন ডকিংয়ের চেয়ে আরো বেশি কিছু ক্ষমতা প্রদর্শন করবে। ডকিংয়ের পরে উপগ্রহগুলো রিমোট সেন্সিং বা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মতো স্বতন্ত্র কাজগুলো বাস্তবায়ন করার জন্য তাদের পৃথক করা যেতে পারে। এছাড়া পিএসএলভি উৎক্ষেপণে একটা পেলোড পরীক্ষামূলক অরবিটাল মডিউল (পিওইএম) অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এর মাধ্যমে স্টার্টআপ এবং গবেষকরা মহাকাশে নতুন প্রযুক্তি পরীক্ষা করতেও সক্ষম করবে।‘

এই প্রযুক্তি সফল হলে প্রস্তাবিত ভারতীয় মহাকাশ স্টেশন নির্মাণ ও পরিচালনা এবং চাঁদে ভারতীয় নভোচারী পাঠানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দিকে একধাপ এগোবে ভারত।

চন্দ্রযান-৪ অভিযানের দিকে তাকিয়েও ‘স্পেডেক্স‘ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

কেন ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ
মহাকাশে ডকিং একটা অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়া। ‘স্পেডেক্স‘ অভিযানের মাধ্যমে স্পেস ডকিং প্রযুক্তি আয়ত্ত করার সুযোগ রয়েছে ভারতের।

ড. জিতেন্দ্র সিং জানিয়েছেন, স্পেস ডকিং আয়ত্ত করে ফেলতে পারলে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং চীনের সাথে ভারতের নামও একই তালিকায় যুক্ত হবে। এছাড়া ভারতের দীর্ঘমেয়াদি পরকল্পনার জন্যও এটা গুরুত্বপূর্ণ।

‘গগনযান‘ অভিযান, ‘চন্দ্রযান-৪‘ এবং ভবিষ্যতে ভারতীয় মহাকাশ স্টেশন পরিচালনার মতো দীর্ঘমেয়াদী মিশনের জন্য ডকিং প্রযুক্তি রপ্ত করা গুরুত্বপূর্ণ।

ড. এস সোমনাথ বলেন, ‘এই পরীক্ষার (ডকিং এবং আনডকিং) মাধ্যমে স্যাটেলাইট মেরামত, পুনরায় জ্বালানি সরবারহ, (মহাকাশ থেকে) ধ্বংসাবশেষ অপসারণ এবং আরো অনেক সম্ভাবনার ভিত্তি স্থাপন হতে পারে।‘

চন্দ্রযান -৪ এর জন্য এই অভিযান নিশ্চিতভাবেই একটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তবে ড. সোমনাথ জানিয়েছেন, তার জন্য আরো অনেক আধুনিক পরীক্ষার প্রয়োজন হবে।

পাখির চোখে চন্দ্রযান-৪
‘চন্দ্রযান-৪‘ অভিযানের দিকে তাকিয়ে রয়েছে ভারত। পরিকল্পনা রয়েছে, এলএমভি-৩ এবং পিএসএলভি নামে রকেটের মাধ্যমে চাঁদের বুকে দু’টি ভিন্ন যন্ত্র উৎক্ষেপণ করা হবে। মহাকাশযান চাঁদে অবতরণ করবে, প্রয়োজনীয় মাটি ও পাথরের নমুনা সংগ্রহ করে পৃথিবীতে ফিরে আসবে।

ভারত সরকারের বিজ্ঞান প্রসার সংগঠনের প্রবীণ বিজ্ঞানী টিভি ভেঙ্কটেশ্বরন আগের চন্দ্রযান অভিযান নিয়ে বিবিসিকে বলেছিলেন, ‘আমরা এখন বিস্তারিত গবেষণার পরবর্তী ধাপের জন্য চাঁদের মাটি ও পাথরের নমুনা সংগ্রহ করব।‘

তিনি বলেছিলেন, ওই নমুনা সংগ্রহ করা ভারতের মহাকাশ বিজ্ঞানের বিকাশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

কেন্দ্রীয় সরকার এ প্রকল্প অনুমোদন করেছে এবং ইতোমধ্যে এজন্য ২১০৪ কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ করেছে।

চন্দ্রযান-৪ কে ২০৪০ সালের মধ্যে ভারতের চাঁদে মানুষ পাঠানোর যে পরিকল্পনা রয়েছে, তারই একটা পদক্ষেপ বলে বিবেচনা করা হয়।

আর এই সব কিছুর জন্য ডকিং এবং আনডকিং পদ্ধতি রপ্ত করাটা খুব প্রয়োজন। ঠিক সেই কারণেই ‘স্পেডেক্স‘-এর দিকে তাকিয়ে রয়েছে পুরো দেশ।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement
বিএসএমএমইউতে রোগীদের অনলাইন অ্যাপয়েনমেন্ট সেবা জোরদারে সভা অনুষ্ঠিত চলনবিলে ২ লাখ টন সরিষা উৎপাদনের আশা এমিরেটসের নতুনতম এয়ারবাস এ৩৫০ এর প্রথম গন্তব্য এডিনবার্গ মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশীসহ ১৩৮ অভিবাসী আটক শ্রমজীবী মানুষ হচ্ছে দেশ গড়ার কারিগর ঘোড়াঘাটে ২৩৪টি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে শীতবস্ত্র দিলেন ডা: জাহিদ এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ২৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপিত ১২ বছরে পদার্পণ করেছে তারিফ ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের অভিষেক অনুষ্ঠিত জাতীয়তাবাদী ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন সোনালী ব্যাংকের কমিটি গঠন ঢাবিতে অপরাজেয় ৯৮-এর পুনর্মিলনী অনুষ্ঠিত

সকল