ভারতের মন্দিরে পশুর চর্বি দিয়ে প্রসাদ?
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৬:৫৭
বিশ্বের সবথেকে সম্পদশালী হিন্দু তীর্থগুলোর অন্যতম তিরুপতি মন্দিরের লাড্ডু প্রসাদে পশুর চর্বি পাওয়ার পরে তা নিয়ে ভারত জুড়ে শুরু হয়েছে ব্যাপক বিতর্ক।
এতদিন মন্দিরের প্রসাদ তৈরির জন্য যে ঘি ব্যবহার করা হয়, তাতে পশুর চর্বি পাওয়ার বিষয়টি অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডুর অভিযোগ আকারেই এসেছিল।
কিন্তু এখন বিবিসি নিশ্চিত হতে পেরেছে যে পরীক্ষাগারের রিপোর্টেও লেখা আছে ব্যবহৃত ঘিয়ের মধ্যে পশুর চর্বি মেশানো হয়েছিল।
তিরুপতি মন্দির পরিচালনা করে যে তিরুমালা তিরুপতি দেবস্থানম, সেই টিটিডির নির্বাহী কর্মকর্তা শ্যামলা রাও বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
শ্যামলা রাও অবশ্য এর আগে বলেছিলেন যে শুধুমাত্র বনস্পতি ঘিতে ভেজাল মেশানো হয়। তবে এখন তিনিও জানিয়েছেন যে লাড্ডু তৈরির জন্য ব্যবহৃত ঘিয়ে পশুর চর্বিও রয়েছে।
তিরুপতিসহ ভারতের বহু মন্দিরের প্রসাদ সম্পূর্ণভাবে নিরামিষ হয়ে থাকে। আবার দক্ষিণ ভারতীয় ভক্তদের একটা বড় অংশ নিরামিষাশী। তাই তাদের আরাধ্য দেবতার যে প্রসাদ তারা খাচ্ছেন, তাতে পশুর চর্বির উপস্থিতির খবর খুবই বিচলিত করেছে বলে জানা যাচ্ছে।
টিটিডি-র নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, ‘দায়িত্ব নেয়ার পর আমি যখন মুখ্যমন্ত্রীর সাথে দেখা করি, তখন তিনি আমাকে প্রসাদের গুণাগুণ সম্পর্কে বলেছিলেন। সেজন্যই আমি এই বিষয়ে মনোযোগ দিই। সেই সময়ে পাঁচটি সংস্থা ঘি সরবরাহ করছিল, কিন্তু যখন আমি গুণগত মানের ব্যাপারে সতর্ক করি, তখন একটি বাদে বাকি সংস্থাগুলো মান উন্নত করে। অন্য সংস্থাটিকে আমরা কালো তালিকাভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করি।’
কী আছে রিপোর্টে?
টিটিডি গুজরাটের ন্যাশনাল ডেয়ারি ডেভেলপমেন্ট বোর্ড বা এনডিডিবি-র ‘কাফ ল্যাব’ বা সেন্টার ফর অ্যানালিসিস অ্যান্ড লার্নিং ইন লাইভস্টক অ্যান্ড ফুডের কাছে ওই ঘিয়ের নমুনা পরীক্ষার জন্য পাঠিয়েছিল।
গত ১৭ জুলাই নমুনা সংগ্রহ করা হয় এবং ২৩ জুলাই পরীক্ষা শেষ হয়।
রিপোর্টে লেখা হয়েছে ‘ঘিয়ের ‘এস ভ্যালু’ কখনো কখনো বেশি বা কম হয়, আর এরকম হলেই বোঝা যায় যে ঘিয়ের সাথে চর্বি মেশানো হয়েছে।
রিপোর্টে এটাও বলা হয়েছে যে বনস্পতি তেল এবং প্রাণিজ চর্বি- দুই-ই মেশানো হয়েছে ঘিয়ের সাথে।
প্রথম ধাপের পরীক্ষায় পাওয়া গেছে সয়াবিন, সূর্যমুখী, রেপসিড, তুলোর বীজ ইত্যাদির সাথে মাছের তেল ব্যবহার করা হয়েছে ভেজাল হিসেবে।
দ্বিতীয় মাপকাঠিতে দেখা গেছে যে ঘিয়ের মধ্যে নারকেল ও তালের বীজের চর্বি মেশানো হয়েছে।
তৃতীয় পর্যায়ে পাম তেল ও গরুর চর্বি আর চতুর্থ পর্যায়ে ভেজাল হিসেবে শূকরের চর্বি পাওয়া গেছে।
এনডিডিবির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা যে নমুনা পেয়েছি তা গোপনীয়। যারা এই নমুনা পাঠিয়েছে, তাদের তথ্য, এমনকি শহরের নামও নেই। আমরা শুধু নমুনা পেয়েছি। তবে তদন্তের ফলাফল নিয়ে আমরা কিছু বলব না। নমুনাগুলো কোথা থেকে এসেছে তা কেউ জানে না।’
কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?
পরীক্ষাগারের রিপোর্টটি দেখেছেন এমন দুজন বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বলেছে বিবিসি, যারা দুগ্ধ ও খাদ্য নিরাপত্তার ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তাদেরই একজন বলেন, ‘ঘিতে ভেজাল দেয়া হয়েছে, সেটা স্পষ্ট কিন্তু শুধু এই রিপোর্টের ভিত্তিতে ভেজাল হিসেবে ভেজিটেবল অয়েল মেশানো হয়েছিল নাকি পশুর চর্বি, সেটা নিশ্চিত করা যাবে না। সাধারণত ছয় লাখ লিটার গরুর দুধে ১৫ টন ঘি পাওয়া যায়। আমার জানা মতে, সরবরাহকারী সংস্থাটির কাছে এই পরিমাণ গরুর দুধ সংগ্রহের কোনো ব্যবস্থা নেই। এ ছাড়া এই ঘিয়ের দামও খুবই কম। তাই ভেজাল নিশ্চয়ই হয়েছে। তবে কোনোটা ভেজাল তা বলা যাবে না।’
আরেকজন বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘শুধু একটি রিপোর্টের ভিত্তিতে আমরা বলতে পারব না যে ভেজাল হিসেবে পশুর চর্বি মেশানো হয়েছে কি না। সাধারণত ভারতে পাম তেল ঘিয়ের সাথে মেশানো হয়। নানা কারণেই এইসব পদার্থগুলোর উপস্থিতি পাওয়া যেতে পারে ওই নমুনাতে। যেমন কোনো একটি গরুকেও যদি পাম তেল, তুলার তেল, রেপসিড তেল মেশানো খাবার খাওয়ানো হয়, তাহলে তার দুধে এসব উপাদান পাওয়া যেতে পারে। আবার যদি গরুকে বেশি পুষ্টিকর খাদ্য দেয়া হয় বা যদি কোনো গরু অপুষ্টিতে ভোগে, তাহলেও ওইসব গরুর দুধে এসব উপাদান পাওয়া যেতে পারে। দুধ থেকে কিছু বিশেষ পদ্ধতিতে কোলেস্টেরল নিষ্কাশন করা হলেও এমনটা ঘটতে পারে।’
তিরুপতি মন্দিরের জনপ্রিয় প্রসাদ লাড্ডু
শেষাচলম পাহাড়ের মাথায় অবস্থিত তিরুমালা তিরুপতি মন্দির বিশ্বের সবথেকে ধনী মন্দিরগুলোর অন্যতম।
হিন্দুদের ভগবান ভেঙ্কটেশ্বরের এই মন্দিরটি রাজা তোন্ডমান নির্মাণ করেছিলেন।
একাদশ শতাব্দীতে রামানুজাচার্য মন্দিরটির প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন।
এই মন্দিরে সোনা দান করা নিয়ে প্রায়ই খবর বের হয়। প্রতিদিন গড়ে এক লক্ষেরও বেশি ভক্ত মন্দিরে পুজো দিয়ে অর্থ দান করে থাকেন।
মন্দিরের দানবাক্সে লাখ লাখ টাকা জমা হয়, গয়নাও দেন বহু ভক্ত।
প্রাচীন বিশ্বাসমতে ভগবান ভেঙ্কটেশ্বর যখন পদ্মাবতীকে বিয়ে করছিলেন, তখন তার অর্থের টান পড়ে, তাই তিনি ধনসম্পদের দেবতা কুবেরের কাছে গিয়েছিলেন তার কাছে এক কোটি টাকা এবং এক কোটি সোনার গিনি প্রার্থনা করেছিলেন।
এটি বিশ্বাস করা হয় যে ভগবান ভেঙ্কটেশ্বরের সেই ঋণ এখনো রয়েছে, তাই ভক্তরা তাদের ঈশ্বরকে ওই দেনার সুদ পরিশোধে সাহায্য করার জন্য উদার হয়ে দান করে থাকেন।
তিরুপতি মন্দিরে প্রতি বছর অনুদান হিসাবে প্রায় এক টন সোনা জমা পড়ে।
এই মন্দিরের লাড্ডু প্রসাদ মন্দিরের গোপন রান্নাঘরে তৈরি করা হয়। এই রান্নাঘরের নাম পোটু।
তিরুমালা তিরুপতি দেবস্থানমের কর্মকর্তাদের মতে, ভক্তদের মধ্যে লাড্ডু, বড়া, আপ্পাম, মনোহরম এবং জিলিপির মতো প্রসাদ বিতরণ করা হয়।
এর মধ্যে লাড্ডু প্রাচীনতম এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রসাদ। এটিকে প্রসাদ হিসাবে দেওয়ার ঐতিহ্য ৩০০ বছর ধরে চলে আসছে। প্রতিদিন সাড়ে তিন লাখ লাড্ডু তৈরি হয় এখানে।
তিরুপতির লাড্ডু ২০০৯ সালে জিআই ট্যাগ পায়।
প্রসাদ নিয়ে রাজনীতি
একদিকে প্রসাদের গুণাগুণ নিয়ে ভক্তদের ভাবাবেগে আঘাত লেগেছে, অন্যদিকে তা নিয়ে রাজনীতিও শুরু হয়েছে।
তিরুমালা ট্রেড ইউনিয়ন নেতা সাইদ মুরলী বলেন, ‘ঘিয়ের গুণগত মান ভালো না হলে আগেও তারা তা ফিরিয়ে দিয়েছে। তবে বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক বিরোধীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা উচিত নয়। যদি দেখা যায় কোনো ভুল হয়েছে, তাহলে কড়া ব্যবস্থা নিতে হবে।
আবার ক্ষমতাসীন তেলুগু দেশম পার্টির নেতা ও ভি রমন বলেন, ‘কর্ণাটক ছাড়া আর কোনো রাজ্যে এত গরু নেই। দূরত্বের কারণে পাঞ্জাব থেকেও ঘি আমদানি করা কঠিন। কিন্তু সমস্যা শুরু হয় যখন কর্ণাটক ডেয়ারি থেকে ঘি নেয়া বন্ধ করে বেসরকারি সংস্থার কাছ থেকে কম দামে ঘি কেনা শুরু হয়।’
বেসরকারি কোম্পানিগুলো বিদেশ থেকে আমদানি করা ঘিয়ের মধ্যে ভেজাল হিসাবে বাটার অয়েল মেশায়।
বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডুর রাজনৈতিক বিরোধী ও সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জগনমোহন রেড্ডি শুক্রবার বলেছেন, ‘চন্দ্রবাবু নাইডুর প্রথম ১০০ দিনের শাসনকালকে সুশাসন বলা যায় না, তিনি সেখান থেকে নজর ঘোরাতে এই বিষয়টি সামনে এনেছেন। টিটিডি-র ঘি সংগ্রহের নিজস্ব প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি রয়েছে। তারা খারাপ ঘি ফিরিয়ে দেয়। টিটিডিতে তিনটি পরীক্ষার পরেই ঘি ব্যবহার করা হয়। অতীতেও চন্দ্রবাবুর আমলে ১৪-১৫টি ট্যাঙ্কার ঘি ফেরানো হয়েছে, আমরা ক্ষমতায় থাকাকালীন ১৮ ট্যাঙ্কার ঘি ফিরিয়ে দিয়েছি। এটা একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।’
সূত্র : বিবিসি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা