২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

পুতিনের সাম্রাজ্য-চিন্তা

ভ্লাদিমির পুতিন - ফাইল ছবি

আজ থেকে ৩৩ বছর আগে ২৫ ডিসেম্বর সোভিয়েত ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, এর কিছু দিন পরই রাশিয়াতে ব্যাপক দুর্নীতি এবং বেকারত্বে ছেয়ে যায়। অভাবনীয় মুদ্রাস্ফীতি জনমানুষকে অতিষ্ঠ করে তোলে। বলতে হয়, এই অভিজ্ঞতা ভ্লাদিমির পুতিনের নেতৃত্বে প্রশাসনের দীর্ঘায়ুর ভিত্তি স্থাপন করে, বিশৃঙ্খল পরিবেশ পুনরুদ্ধারের দিকে পথ চলতে শেখায়।

পুতিন প্রশাসন ভিন্নমতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় ও নির্বাচনের মাধ্যমে উঠে আসেন। পুতিনের কঠোর অবস্থানকে তিনি নিজেই বলেন, ‘উদারবাদ অচল হয়ে পড়েছে’। তিনি মুক্ত অর্থনীতির দিকেও ফেরেন এবং গণতন্ত্রকে পরিত্যক্ত করেননি। উভয় বিষয়কে তিনি রাশিয়ান রঙে রঞ্জিত করেন।

প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেন আক্রমণ করায় পশ্চিমারা অনেকটা ভীত। ক্রেমলিনের এই পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়ায় জো বাইডেন যুদ্ধের হুমকি দিয়ে, অস্ত্রসহায়তা দিয়ে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে নান নিষেধাজ্ঞা দিয়ে এবং বিদেশী ব্যাংকগুলোতে রাশিয়ার অর্থ বাজেয়াপ্ত করেছেন। ফলে পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও সম্প্রতি ন্যাটো। তারা ভয় করছেন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর পুতিন আবার সেদিকে ফিরে যাচ্ছেন এবং একটি শক্তিশালী ইউনিয়নে পরিণত করতে চাচ্ছেন।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মনে করছেন, পুতিন তার লক্ষ্যে সফল হতে, ইউক্রেনের বড় বড় অংশ দখল করে বাকি অংশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করবেন। ইতোমধ্যে পুতিন সেটি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। ইউক্রেন এতদিন পর রাশিয়ার সাথে ‘শান্তি স্থাপন’ করতে চায়। উল্লেখ্য, ১৯৯১ সালে রাশিয়ার কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে ইউক্রেন।

১৯৪৫ সালে রাশিয়ানরা কমিউনিস্টবিরোধী স্তম্ভগুলো, ১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরিয়ান বিদ্রোহ, ১৯৬৮ সালে চেকদের ‘প্রাগবসন্ত’ চূর্ণ করার কারণে পশ্চিমারা নপুংসক আতঙ্কে ভুগতে থাকে। রাশিয়া নিখুঁতভাবে ঘুঁটি চেলেছে। সোভিয়েতদের মোকাবেলা করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের ইচ্ছা ও সংহতি শীতল যুদ্ধে পরিণত হয়। বাইপোলার স্নায়ুযুদ্ধের বিশ্ব মাল্টিপোলারে প্রতিস্থাপিত হয়।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের খবরে গর্বাচেভ শারীরিক ও মানসিক কষ্টে আক্রান্ত হন। তার শেষ করা কোল্ড ওয়্যারের ৩০ বছর পর একটি ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ তিনি দেখতে চাননি। তার মা এবং স্ত্রী উভয়ই ইউক্রেনীয়। তিনি ইউক্রেনে যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু পুতিন অনুমতি দেননি। তখন পুতিন গর্ভাচেভের সাথে কোনো যোগাযোগ রাখতেন না এমনকি তার শেষকৃত্যেও উপস্থিত হননি। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার জন্য পুতিন গর্বাচেভকে দায়ী করতেন। গর্বাচেভ পাশ্চাত্য থেকে ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। পুতিন এসব কিছু নিকট দূরত্ব থেকে অবলোকন করেছেন। তিনি রাশিয়াকে শক্তিশালী করতে চান।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে এটি অশনি সঙ্কেতের মতো। ওয়াশিংটনের কৌশলগত লক্ষ্য হচ্ছে এটিকে দুর্বল করা অব্যাহত রাখা এবং ন্যাটোর পূর্বদিকের সম্প্রসারণকে ধাপে ধাপে এগিয়ে নেয়া, এসব পদক্ষেপের সবই শেষ পর্যন্ত রাশিয়া থেকে পাল্টা পদক্ষেপের চাপে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। পেছনে তাকালে দেখব, সোভিয়েত ইউনিয়ন যথেষ্ট প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ক্ষমতার অধিকারী ও শক্তিশালী ছিল। প্রথম মনুষ্যসৃষ্ট উপগ্রহ এবং প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সোভিয়েত ইউনিয়নে জন্মলাভ করে। ওই সময় দুর্বল কৃষি এবং হালকা শিল্প ছিল এক সমস্যা, প্রযুক্তির মাধ্যমে এসব সমাধান করা যেত। কিন্তু গর্বাচেভ সমস্যাগুলোকে ভুলভাবে বিচার করেছিলেন, সংস্কারের ভুল পথ বেছে নিয়েছিলেন এবং সঠিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছিল।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন একটি ধাঁধা হিসেবেই রয়ে গেছে। এটি অনিবার্য ছিল নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে পরিকল্পিত ছিল তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা এখনো বিতর্ক করেন। পশ্চিমারা রাশিয়াকে ঐতিহাসিকভাবে পশ্চিমা সভ্যতার অংশ হিসেবে দেখতে চেয়েছে, যা কেবল বলশেভিজমের কারণে বিঘ্নিত হয়েছিল। রাশিয়ার পররাষ্ট্রনীতি এখন বিকশিত হয়েছে, কিন্তু কিছু ধারাবাহিকতা রয়ে গেছে। এটি তার আশপাশে প্রভাব বিস্তার করতে চায় সোভিয়েতের মতো উচ্চাকাক্সক্ষা অনুসরণ করার অভিযোগ সত্ত্বেও, সমসাময়িক মস্কো শীতল যুদ্ধ-যুগের ব্লকগুলোতে প্রতিবেশী দেশগুলোকে জড়িত করার চেষ্টা করেনি। রাশিয়া একটি সূক্ষ্ম রেখা অতিক্রম করে, দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের জটিলতাগুলো নেভিগেট করার সময় তার অতীত থেকে শিক্ষা নেয় বৈকি।

পুতিন অনেক সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে কিছুটা বিপর্যস্ত সমাজের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি সামরিক বাহিনীকে পুনরুজ্জীবিত করতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি এককভাবে ন্যাটোকে সামাল দিতে প্রস্তুত। তিনি জানেন যে, ইউরোপ বিভক্ত এবং দুর্বল, বাল্টিক রাজ্যে দখলসহ তিনি যেকোনো কিছুর জন্য সামরিকভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে প্রস্তুত হলেও অনিচ্ছুক। জার্মান নৌবাহিনীর প্রধান, অ্যাডমিরাল কে-আচিমশোয়েনবাখ, ইউক্রেনের প্রতি রুশ হুমকিকে কল্পনাপ্রসূত দাবি করার পর পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এ থেকে প্রমাণিত হয় পশ্চিমারা ও বৃহৎ শক্তির দেশগুলো রাশিয়াকে যত দুর্বল ভেবেছিল বিষয়টি সে রকম মোটেই নয়।
পুতিন ইউক্রেনে আক্রমণ করে, গুরুতর সামরিক পরিণতি ভোগ না করেই নির্দিষ্ট অঞ্চলগুলো সুরক্ষিত করছেন। এখন পুতিন সরাসরি কিয়েভে আক্রমণ চালাচ্ছেন। তার সোজা কথা, দখলকৃত শহরগুলো, ক্রিমিয়া, দনবাস এবং নভোরোসিয়ার যেগুলো রাশিয়াকরণ করা হয়েছে সেগুলোর দাবি ছেড়ে দিলে তিনি যুদ্ধ বন্ধ করতে পারেন। বাইডেন পুতিনকে বৈঠকের আহ্বান জাানিয়েছেন, পুতিন আলোচনা করতে প্রস্তুত যদি এজেন্ডায় ইউক্রেন অন্তর্ভুক্ত থাকে। তেমন কোনো বৈঠক হলে সেটি উত্তপ্ত ও আক্রমণাত্মক হবে তাতে সন্দেহ নেই। ইতঃপূর্বে জাতিসঙ্ঘ যে বৈঠকের আয়োজন করেছে সেটি উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের মাধ্যমেই শেষ হয়েছে, সম্পর্ক আরো তিক্ত হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার বিরুদ্ধে অনেক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তবে তা দিয়ে পুতিনকে দমন করা সম্ভব হয়নি। পূর্বের বহু দেশের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে পুতিন প্রমাণ করেছেন তিনি কোনো সাধারণ খেলোয়াড় নন। পুতিনের অর্থবহ অস্ত্র হলো ক্রেমলিনের গ্যাংস্টার চক্র, যেমন বালতাগুইয়া। যারা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে আছে এবং বিনিয়োগ করেছে। পুতিন অনেক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, তার প্রধান লক্ষ্য হলো জীবনযাত্রার উন্নতি করা এবং রাশিয়ানদের আয় বাড়ানো। তার প্রেসিডেন্ট মেয়াদের মাইলফলকগুলোর মধ্যে রয়েছে চেচনিয়ার পুনর্মিলন, সন্ত্রাসবিরোধী প্রচেষ্টা, বাধ্যতামূলক সামরিক খসড়ার মেয়াদ কমানো, সোচিতে ২০১৪ সালের শীতকালীন অলিম্পিক, ২০১৮ সালে বিশ্বকাপ, অগ্রাধিকার জাতীয় প্রকল্প, পাশাপাশি বিখ্যাত মিউনিখ বক্তৃতা, সিরিয়ায় অভিযান, ব্রিকস এবং ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়ন (ইএইইউ) গঠন, ক্রিমিয়া, দনবাস এবং নভোরোসিয়ার সাথে পুনর্মিলন এবং বিশেষ সামরিক অভিযান, ইউরেশিয়া সিস্টেমের জন্য পাঁচ ধাপ পরিকল্পনা।

পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সঠিকভাবে জানে পুতিনের বন্ধু ও সহযোগী কারা; ধনী রাশিয়ানরা তাদের অর্থব্যয় করার জন্য ক্রমাগত পশ্চিমে ভ্রমণ করে, দেশের জন্য কাজ করে। লন্ডন, নিউ ইয়র্ক, তুরস্ক ও আরো বিভিন্ন স্থানে অনেকেরই প্রাসাদ রয়েছে। ক্রেমলিনের সমর্থন ছাড়া আধুনিক রাশিয়ায় কেউ বড় বা ধনী হতে পারে না।

রাশিয়ার পুতিন এবং চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং উভয়ই তাদের নিজস্ব আঙিনায় আগ্রাসন চালালে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরোধ করতে পারবে না এবং সেটি সাধারণ যুদ্ধের মতো বিবেচনা করা ঠিক হবে না। পুতিন ও তার বন্ধুদের জেলে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে যুক্তরাষ্ট্র অন্তত তাদের পশ্চিমা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দের মাধ্যমে কিছুটা প্রতিশোধ নিতে পারছে।

ব্লু-প্রিন্ট স্পিচ ১৯৯৯ সালের ১৬ আগস্ট ফিরে যাওয়া যাক। রাশিয়া অর্থনৈতিক পতন, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং সামাজিক অস্থিরতায় জর্জরিত ছিল। দেশটির সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ ছিল অভিজাতদের হাতে এবং একদা পরাক্রমশালী রুশ সেনাবাহিনী চেচনিয়ায় ব্যর্থ হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকায় সাবেক কেজিবি কর্মকর্তা পুতিন স্টেট ডুমায় দেয়া ভাষণে রাশিয়ার পুনরুত্থানের নীলনকশা তুলে ধরেন। তার কথার প্রতিধ্বনি সময়ের সাথে সাথে অনুরণিত হয়েছিল : ‘এই দেশে মৌলিক শৃঙ্খলা আরোপ না করে, শক্তিশালী না করে এই কাজগুলোর একটিও সম্পাদন করা যায় না।’ বিশ্ব এখন বুঝতে পারছে পুতিনের ওসব কথার অর্থ কী।

সোভিয়েত নস্টালজিয়া ও কৌশলগত বাস্তবতা সোভিয়েত আমলে লেনিনগ্রাদে (বর্তমানে সেন্ট পিটার্সবার্গ) জন্মগ্রহণকারী পুতিন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজয় এবং শেষ পর্যন্ত এর পতন উভয়ই প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তিনি সোভিয়েত উত্তরাধিকারকে ঘনিষ্ঠভাবে বোঝেন। পুতিন বুঝতে পেরেছেন যে সোভিয়েত ইউনিয়নের পূর্ণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়তো অসম্ভব, ভূ-রাজনৈতিক দৃশ্যপট বদলে গেছে এবং বিশ্ব এগিয়ে গেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন একটি টার্নিং পয়েন্ট ছিল এবং পুতিন স্বীকার করেছেন, এর ইতিহাসের কিছু দিক ত্রুটিপূর্ণ ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন পুনর্গঠনের পরিবর্তে পুতিন রাশিয়ার প্রভাবের বৃত্ত আরো প্রসারিত করতে চান। তিনি চান সাবেক সোভিয়েত অঞ্চলগুলো রাশিয়ার হাতের মুঠোয় থাকুক। ক্রিমিয়ার সংযুক্তি এবং ইউক্রেনে চলমান উত্তেজনা এই কৌশলের বহিঃপ্রকাশ। পুতিন কৌশলগত অঞ্চলগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে চাইছেন, তিনি অবিচল রয়েছেন।

পুতিনের উদ্দেশ্য বহুমুখী। পুতিনের সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য নস্টালজিয়ার প্রচার রাশিয়ার পররাষ্ট্রনীতিতে প্রভাব ফেলেছে। রাশিয়া প্রাক্তন সোভিয়েত অঞ্চলগুলোতে তার প্রভাবের বৃত্ত প্রসারিত করে চলেছে। নস্টালজিয়া, বাস্তববাদ এবং কৌশলগত অপরিহার্যতার সংমিশ্রণ বিশ্ব মঞ্চে তার নীতিগুলো রূপান্তরিত হচ্ছে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব ও গ্রন্থকার


আরো সংবাদ



premium cement