শিক্ষার সঙ্কট
- অধ্যাপক ডা: শাহ মো: বুলবুল ইসলাম
- ২৯ জুলাই ২০২৪, ০৬:২৮
ইদানীং পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন তথ্য পাঠকমাত্র নাড়া দেবে নিঃসন্দেহে। এর ভেতর দুটো সংবাদ সবচেয়ে কষ্টদায়ক, দুঃখজনক ও লজ্জার। বিদেশে গাড়িচালক, রাঁধুনি, পরিচ্ছন্নতাকর্মী পদের জন্য যারা নাম লিখিয়েছেন তাদের মধ্যে ২০০০ জন পিএইচডি ডিগ্রিধারী। অন্যদিকে বাংলাদেশ রেলওয়েতে এসএসসি বা সমমান শিক্ষাগত যোগ্যতার বিপরীতে ওয়েম্যান হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন দুই হাজার ১৭২ জন। এরা সবাই স্নাতক বা স্নাতকোত্তর। কিছু দিন আগে মাধ্যমিক স্কুলের জন্য শিক্ষক নিয়োগের প্রজ্ঞাপনের বিপরীতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক আবেদনপত্র জমা পড়েনি। দেশের সম্ভাবনাময় খাত কৃষি ও শিল্পে দক্ষ জনশক্তির ব্যাপক চাহিদা। বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি খাতে পদশূন্য রয়েছে কয়েক লাখ। বিপরীতে দেশে এ মুহূর্তে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা প্রায় ২৬ লাখ। এক দিকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পদশূন্য অন্যদিকে শিক্ষিত বেকারের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা।
২০১৬-২০২২ প্রান্তিকে স্নাতক মানসম্পন্ন জনশক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে ৩.৫৯%। বিপরীতে একই প্রান্তিকে প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থান বেড়েছে ০.২%। অর্থাৎ শিক্ষিতের হার বাড়ছে ও বেকারের সংখ্যা পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চাকরি প্রান্তিক জনশক্তি তৈরি করছে। তাও চাকরির জন্য প্রয়োজনীয় গুণাবলী ছাড়া। দেশে ক্রমে বাড়ছে সনদধারী অসম্পূর্ণ প্রস্তুতিসম্পন্ন শিক্ষিত চাকরিপ্রার্থী। আমাদের দেশে শিক্ষিত হওয়ার অর্থ হচ্ছে ‘লেখা পড়া করে যে, গাড়ি ঘোড়া চড়ে সেই’। ফলে প্রকৃত শিক্ষা বা শিক্ষিত কোনোটা হচ্ছে না।
বিআইডিএসের মতে, বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষিতের ৪৭% বেকার। এ ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে রয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করা ৬৬% বেকার। ৭% অন্য কোনো বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছেন। মাত্র ৩% নিজ উদ্যোগে কর্মযোগ তৈরি করেছেন। বিশ^বিদ্যালয়গুলো দক্ষ জনশক্তি তৈরি না করে শিক্ষিত বেকার তৈরির মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রকাশিত এক প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, মাধ্যমিক পর্যায়ে ইংরেজি ও গণিতের শিক্ষকদের ৮৫%-এর সংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর যোগ্যতা নেই। এমন অনেক স্কুল রয়েছে যেখানে প্রয়োজনীয় শিক্ষক ছাড়া চলছে বিজ্ঞান বিভাগ। প্রাথমিক শিক্ষার চিত্র আরো করুণ। ৩০ জুন প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, ৮ লাখের বেশি শিক্ষার্থী ঝরেছে ২০২৩ প্রান্তিকে ২০২২ সালের তুলনায়। এক দিকে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা কমেছে, অন্যদিকে বেড়েছে স্কুলের সংখ্যা। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের করা শুমারিতে প্রকাশ পেয়েছে এ তথ্য। ১৩ জুন একই পত্রিকায় প্রকাশিত আরেকটি সমীক্ষায় দেখা যায় ৬-১৪ বছর বয়সের আনুমানিক ১০ লাখ শিশু বিদ্যালয়ে নাম লেখায়নি। ১৯৯৭ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়নে খরচ হয়েছে মোট প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা। এর একটি প্রক্রিয়া ছিল প্রাথমিক স্কুলগুলোতে অষ্টম শ্রেণী খোলা। অনেক কাঠ খড় পোড়ানোর পর এটি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। মাঝখানে খসে পড়েছে শিক্ষার্থীদের জীবনের অমূল্য সময়।
ইদানীং নতুন শিক্ষাপাঠ্যক্রম নিয়ে শুরু হয়েছে আরো একদফা পরীক্ষা-নিরীক্ষা। প্রাথমিক শিক্ষার স্থাপনা বেড়েছে নিঃসন্দেহে; বেড়েছে শিক্ষক; ছাত্রছাত্রীর সংখ্যাও বেড়েছে। একই সাথে ঝরে পড়ার সংখ্যাও বেড়েছে। বাড়েনি শিক্ষার মান। ইতঃপূর্বে প্রকাশিত বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, পঞ্চম শ্রেণী পাস করেও অধিকাংশ শিশু পড়তে, লিখতে বা গুনতে জানে না। শিক্ষক, শিক্ষাবিদ ও অভিভাবকদের আশঙ্কা নতুন পাঠ্যক্রমে এ অবস্থার আরো অবনতি ঘটবে। যারা বিত্তবান তারা তাদের শিশুদের বিভিন্ন ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করে দিচ্ছেন। কেউবা ছেলেমেয়েদের বিদেশে লেখাপড়া করাচ্ছেন। ফলে অদূর ভবিষ্যতে শিক্ষার ভারসাম্য বলতে কিছু থাকবে না। একই দেশে একদিকে তৈরি হবে বিশাল সংখ্যক তথাকথিত শিক্ষিত বেকার; যাদের বিভিন্ন ধরনের অনৈতিক কার্যক্রমে জড়িত হওয়ার আশঙ্কা বাড়িয়ে দেবে; যা সামাজিক শৃঙ্খলার ব্যত্যয় ঘটানোর শঙ্কা বাড়িয়ে দেবে। এর বহিঃপ্রকাশ দেশের ৫০ লাখ মানুষের জুয়ায় সম্পৃক্ত হওয়া এবং অপ্রতিহত গতিতে বেড়ে ওঠা কিশোর গ্যাংয়ের ভয়ঙ্কর চিত্র। অতি সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া ছাত্র আন্দোলনে বেকারদের এ ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ছিল না- তা জোর দিয়ে বলা যায় না।
আমাদের শিক্ষানীতি ও পাঠ্যক্রমের সাথে জাতির মানস ও চাহিদার প্রতিফলনের অনুপস্থিতির প্রতিফলন আলোচিত চিত্র। দেশের স্কুল কলেজ মাদরাসা ও বিশ^বিদ্যালয়গুলো চলমান শতক ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার উপযুক্ত জনশক্তি তৈরিতে ব্যর্থ হয়েছে। দেশ, জাতি, মাটি ও মানুষের চিন্তা-ভাবনা, আশা-আকাক্সক্ষা এবং ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জের প্রতিফলন শিক্ষাক্রমে অনুপস্থিত থাকায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসা এখন সময়ের দাবি। এ জন্য শিক্ষাক্রম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঢেলে সাজানো ছাড়া গত্যন্তর নেই। দেশের সব শিশুর শিক্ষা নিশ্চিত করা দরকার। শিক্ষার্থী, শিক্ষক, শিক্ষাঙ্গনকে ভবিষ্যতের বৈশি^ক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সক্ষম আঙ্গিকে তৈরি করা দরকার। দেশপ্রেম, জাতিবোধ ও জাতির সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের প্রতিফলন সমন্বিত করা আবশ্যিক হয়ে দাঁড়িয়েছে শিক্ষাক্রমে। চাকরিমুখী শিক্ষা থেকে কর্মযোগ সৃষ্টির শিক্ষা এখন জাতির প্রয়োজন। প্রয়োজন শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যয় বরাদ্দ বৃদ্ধি। শিক্ষা ব্যয়কে শিক্ষা বিনিয়োগ হিসেবে রূপান্তরিত করার, ভাবার মনোভাবে পরিবর্তন করা।
লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
Email-shah.b.islam@gmail.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা