২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`
সমকালীন প্রসঙ্গ

স্মার্ট সরকার, ডিজিটাল কারফিউ

স্মার্ট সরকার, ডিজিটাল কারফিউ - নয়া দিগন্ত

প্রায় এক সপ্তাহ গৃহবন্দিত্বের পর আজ দুপুর ১২টার দিকে কর্মস্থলে এসে পৌঁছালাম। আজ মানে ২৪ জুলাই, ২০২৪ সালে বসে যখন এই নিবন্ধ লিখছি তখন চিন্তাচেতনায় আমি এক ভিন্ন জগতের মানুষে পরিণত হয়ে গেছি। অথচ মাত্র এক সপ্তাহ আগেও আমি এমনটি ছিলাম না। গত বৃহস্পতিবার ছিল জুলাই মাসের ১৮ তারিখ। রাত ৮টা পর্যন্ত আমি অফিসে কাজ করছিলাম। হঠাৎ করেই ইন্টারনেটের ব্রডব্যান্ড সেবা বন্ধ হয়ে গেল। হাতের টুকটাক কাজ সারতে আরো ঘণ্টা দুয়েক লাগল। তারপর রাত ১০টার দিকে একটি রিকশা নিয়ে সম্পূর্ণ একাকী বাসার দিকে রওনা হলাম। পুরো রাস্তা ফাঁকা। শাহবাগে জটলা। সাইন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে কিছুক্ষণ আগে যুদ্ধাবস্থা ছিল। চারদিকে ছড়ানো ছিটানো ধ্বংসাবশেষ, কিন্তু কেন জানি আমার মনে ভয়ের সঞ্চার হলো না। বাসায় গিয়ে গোসল করে রাতের খাবার খেয়ে সারা দিনের ক্লান্তি-অবসাদ আর গ্লানির ত্রিচক্রে বেহুঁশের মতো কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি, মনে করতে পারছি না।

১৯ জুলাই শুক্রবার থেকে শুরু হলো আমার বিবর্তন। ইন্টারনেটবিহীন জীবন, নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমের ফরমায়েশি খবর এবং আকাশে হেলিকপ্টারের দাপটসহ নানা গুজব আমার মনে ভয় ধরিয়ে দিলো। এই ভয় নিজের জন্য নয়, দেশের জন্য। ১৯৮৬ সাল থেকে দেশটিকে পেশাগত জীবনের বিভিন্ন উপাখ্যান ও অভিজ্ঞতার আলোকে দেখে আসছি। কিন্তু চলমান রাজনৈতিক বিপর্যয়, অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও মানুষের ক্রোধের মতো এমনতর কিছু অতীতে দেখিনি। দিনদুপুরে বড় বড় চেয়ারে বসা ছোট মনের মানুষদের নির্জলা মিথ্যা কথা, অপরিমিত অহঙ্কার, নির্বোধের মতো অঙ্গভঙ্গি পোশাক পরিচ্ছদ এবং বেকুবের মতো আচরণ দেখে আমি দেশের ১৮ কোটি মানুষের তকদির নিয়ে ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলাম।

উল্লিখিত অবস্থায় সময় পার করা আমার জন্য দুর্বিষহ হয়ে পড়ল। আমার এই ক্ষুদ্র জীবনে ব্যক্তিগতভাবে বহু ঝক্কি ঝামেলায় পড়েছি। বিপদ-আপদও কোনো কালে কম ছিল না। কিন্তু কখনোই সময়কে দুর্বিষহ মনে হয়নি; বরং কঠিনতর পরিস্থিতিতেও সময়কে উপভোগ করেছি। যেদিন আমাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল সে দিনও বাংলাদেশ প্রতিদিন অফিসে বসে মোগল হেরেমের দুনিয়া কাঁপানো প্রেমের রোমাঞ্চকর পর্বটি লিখছিলাম। যখন কারাগারে নেয়া হলো এবং রাত ২টায় যখন কাশিমপুর কারাগারে প্রবেশ করলাম তখন সব কিছুর চিন্তা ছাপিয়ে হাসনাহেনা ফুলের গন্ধ কোত্থেকে আসছে তা জানার জন্য ব্যাকুল হয়েছিলাম। অর্থাৎ জীবনের কঠিনতর মুহূর্তগুলোতেও আমি সময়কে উপভোগ করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু গত ১৯ জুলাই শুক্রবার থেকে আজ অবধি যে দুর্বিষহ সময়ের কবলে পড়ে মানবিক কল্পনাশক্তি হারিয়ে ফেলেছি তা আজকের দিনে রাস্তায় বের না হলে টেরই পেতাম না।

আজকের দিনে রাস্তায় বের হয়ে অনেক পরস্পরবিরোধী দৃশ্য দেখতে পেলাম। রাস্তায় দেদারছে রিকশা চলছে, কিছু দোকানপাট খুলেছে কিন্তু ক্রেতাশূন্য বিপণিবিতানের দিকে তাকালে মনে হচ্ছে পণ্য দোকানি এবং রাজপথ সমস্বরে কাঁদছে আর অভিসম্পাত দিচ্ছে। অন্য সময় রিকশায় উঠলে আমি রিকশাওয়ালার সাথে ভাব জমাই, আলাপ করি, আশপাশের লোকজনের সাথে সালাম বিনিময় করি এবং ভিক্ষুকদের বিমুখ করি না। কিন্তু আজ আমার যে কী হলো তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। আমি যা দেখলাম এবং গত এক সপ্তাহে মনোজগতে যা ঘটেছে তার সম্মিলনে আমার এমন কিছু করতে ইচ্ছে করছিল যেমনটি বিভূতি বাবু এবং সত্যজিৎ রায় মিলে পথের পাঁচালিতে করেছেন। আমার রিকশাটি যখন নীলক্ষেত থানা পার হচ্ছিল তখন দেখলাম থানার গেটে তালা ঝুলছে। একটু এগোনোর পর নীলক্ষেত কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলের সামনে এসে আমার চোখ আটকে গেল। যতবার দেখছি ততবারই মহিলা হোস্টেলের সদর দরজা বন্ধ দেখিছি। কিন্তু আজ কর্মজীবী মহিলাদের সাহস দেখে অবাক হয়ে গেলাম। যেখানে ভয়, আতঙ্ক এবং নিরাপত্তাহীনতার অজুহাতে থানার দরজায় তালা লাগানো হয়েছে, সেখানে মহিলারা তাদের আবাসস্থলের সদর দরজা খুলে রেখেছে।

আগেই বলেছি যে, গত শুক্রবার থেকে আমার চিন্তাচেতনার জগতে বন্ধ্যত্ব নেমে এসেছিল। হৃদয়ের নান্দনিকতা উঠে গিয়েছিল। আহার বিহারের রুচি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সঙ্গীত কবিতা সাহিত্য অসহ্য হয়ে উঠেছিল এবং শরীর মনে হেলিকপ্টার আতঙ্ক বাসা বেঁধেছিল। কিন্তু আজকের দিনে রাজপথে নেমে মনের মধ্যে অদ্ভুত সব প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি দিতে আরম্ভ করল। প্রথমেই যে বিষয়টি খটকা লাগল তা হলো, কোটাবিরোধী আন্দোলন ঘিরে ঢাকার যেসব স্থানে মারাত্মক অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল সেগুলোর মধ্যে সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, শনিরআখড়া থেকে শুরু করে নারায়ণগঞ্জ, সাইনবোর্ড মোড় ছিল এক নম্বরে। এরপর মোহাম্মদপুর, বসিলা, সাভার, বাড্ডা রোড, মিরপুর-১০, উত্তরা, গাজীপুর এবং স্বল্প সময়ের জন্য লালবাগ এলাকা। এর বাইরে রামপুরা, বনশ্রী এলাকাও ছিল উত্তাল।

অবাক করা বিষয় হলো, দুষ্কৃতকারীরা যেসব সরকারি বা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়েছে সেখানে যে খুব বেশি খারাপ পরিস্থিতি ছিল তা বলা যাবে না। বিশেষ করে মহাখালী সেতু ভবন, বিআরটিএ ভবন এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরে হামলা, গাড়ি পোড়ানোর কার্যকারণ আমার মাথায় ঢুকছে না। দ্বিতীয়ত মেট্রোরেল বর্তমান জমানার সবচেয়ে জনপ্রিয় একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। মেট্রোরেলে আক্রমণ বিশেষ করে মিরপুরের যে দু’টি স্টেশনে ভাঙচুর করা হয়েছে তা রীতিমতো অবিশ্বাস্য। ব্যাপক প্রস্তুতি অভিজ্ঞতা এবং অপকর্ম করে শতভাগ নিরাপদে পালানোর নিশ্চয়তা না থাকলে মানুষ তো দূরের কথা শয়তানকে দিয়েও মেট্রোরেলে ভাঙচুর ও ধ্বংসলীলা সম্ভব নয়। কারণ মেট্রোরেলের প্রতিটি যন্ত্রপাতির সাথে এত হাই-ভোল্টের বিদ্যুৎ সংযোগ থাকে যে, ওগুলোতে স্পর্শ করে প্রাণ নিয়ে ফিরে আসা অসম্ভব।

দ্বিতীয়ত, মেট্রোরেল দেশের যেকোনো স্পর্শকাতর স্থান যা কি না কেপিআই জোন হিসেবে পরিচিত। যেমন, ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের অস্ত্রাগার, সেনাপ্রধানের বাসভবন, বঙ্গভবন, গণভবন, পদ্মা সেতু, বেতার ভবন, বিটিভি ভবন ইত্যাদির মতোই গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং এমন স্থানে হামলার জন্য কেমন অভিজ্ঞতা, কেমন প্রস্তুতি এবং কেমন নিশ্চয়তা দরকার তা বোঝার জন্য খুব বেশি পাণ্ডিত্যের দরকার নেই।

এখানে আরো একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়, মেট্রোরেল, বিআরটিএ, সেতু ভবন, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের মন্ত্রণালয়ের অধীন। দুর্ঘটনার পর তিনি ঘটনাস্থলে যাননি। অধিকন্তু কারফিউ চলাকালীন মেট্রোরেল প্রজেক্টের প্রধান যিনি দীর্ঘদিন সেতু সচিব ছিলেন এবং সরকারের মধ্যে তিনি ওবায়দুল কাদেরের অতি খাস লোক হিসেবে পরিচিত তিনি মেট্রোরেলের ক্ষতিগ্রস্ত স্টেশন দেখার জন্য যখন তিনতলার উপরে গিয়েছিলেন ঠিক তখন দুর্বৃত্তরা তার গাড়িটি পুড়িয়ে দেয়, যার কার্যকারণ মেলাতে গেলে মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হবে।

জনাব ওবায়দুল কাদেরকে নিয়ে দলে ও সরকারে যেমন অসংখ্য বিতর্ক ও বিরোধ রয়েছে তদ্রƒপ নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে নিয়েও স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির রাঘববোয়ালরা ভীষণ অসন্তুষ্ট। কাজেই স্বাস্থ্য দুর্নীতির আখড়া হিসেবে পরিচিত স্বাস্থ্য অধিদফতরের পুরনো ভবনে নাশকতা কোনো সাধারণ ঘটনা হতে পারে না।

উল্লিখিত ক্ষয়ক্ষতির পর সবচেয়ে বিপজ্জনক ক্ষয়ক্ষতির কবলে পড়েছে বাংলাদেশ পুলিশ। গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে সীমাহীন ক্ষমতার অপপ্রয়োগ, অতিরিক্ত বল প্রয়োগ এবং আকাশ ফুটো করা দুর্নীতির পাহাড় তৈরির অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে জনরোষ এতটা তুঙ্গে, যার সাথে অতীতের বাংলাদেশ তো দূরের কথা- পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের জনরোষের তুলনা করা যায় কি না তা বলতে পারব না। ফলে কোটাবিরোধী আন্দোলন কেন্দ্র করে পুলিশ-বিক্ষুব্ধ জনতার মারামারি ছাড়াও পর্দার অন্তরালে এমন কিছু ঘটেছে যা হয়তো অনাগত দিনে জানা যাবে। তবে চলমান সহিংসতায় পুলিশের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বিশেষ করে তাদের মনোজগতে, পরিবারে, সামাজিক জীবনে এবং পেশাগত জীবনে তা কাটিয়ে উঠতে কয়েক যুগ সময় লাগবে।

আমরা আজকের আলোচনার একেবারে শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। এতক্ষণ ধরে যে আলোচনা করলাম তা কেবল আজকের দিনের যাত্রাপথে বাসা থেকে কর্মস্থলে রিকশা করে আসার সময় যা দেখেছি এবং যা ভেবেছি তার সামান্য নমুনা। এসব নিয়ে বিস্তারিত লিখতে গেলে মহাকাব্য রচনা করতে হবে। সুতরাং ওদিকে না গিয়ে এবার শিরোনাম প্রসঙ্গে আলোচনা করা যাক। আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ধরে নিজেদের স্মার্ট সরকার হিসেবে প্রচার করে আসছে। তারা যে কী পরিমাণ স্মার্ট হতে পেরেছে তা আমরা চলমান সহিংসতা মোকাবেলায় তাদের তৎপরতা দেখে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। তারা রাস্তায় সেনাবাহিনী নামিয়ে প্রচলিত কারফিউর মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টার আগে যেভাবে ইন্টারনেট বন্ধ করে ডিজিটাল কারফিউ জারি করে বাঁচার চেষ্টা করেছেন তা সমসাময়িক দুনিয়ায় বিরল নজির সৃষ্টি করেছে। তাদের সেই স্মার্ট কারফিউর ফলে যেভাবে নিজেদের দুর্বলতা-অক্ষমতা-অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে তা ইহজনমে আর কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। কারণ-

সাহস যেমন একটি প্রণোদনামূলক ভাইরাসরূপে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এবং একবার যদি কোনো মানুষ-দল-গোষ্ঠী এবং জাতি সাহসী হয়ে পড়ে তবে বিজয় অর্জন ছাড়া আর কোনো বিকল্প থাকে না। অন্য দিকে, কেউ যদি একবার ভয় পেয়ে যায় তবে তার পক্ষে ঘুরে দাঁড়ানো অসম্ভব। জন্মগত ভীতু বা পরিস্থিতির কারণে ভয়ের সঞ্চার হওয়া এবং ভয় পাওয়া এক জিনিস নয়। জন্মগত ভীতু যেকোনো পরিস্থিতিতে অসীম সাহসীতে পরিণত হতে পারে। আবার অসীম সাহসী মানুষও হঠাৎ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে যেতে পারে। তবে এটি সাময়িক। অর্থাৎ এই পরিস্থিতি কেটে গেলে ভীতু শেষ অবধি ভীতুই থেকে যায় এবং সাহসী মানুষ ভীতিকর পরিস্থিতি কেটে গেলে আবার সাহসী হয়ে পড়ে। কিন্তু-

মানুষ যখন আপন কুকর্মের জালে বন্দী হয়ে নিজের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে, নিজের চরিত্রহীনতা-দুর্নীতি ও অপকর্মের কারণে মানব চরিত্রের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি হারিয়ে সবাইকে তার মতো চরিত্রহীন ভাবতে থাকে এবং সবাইকে সন্দেহের চোখে দেখতে থাকে; তখন তার মধ্যে এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়ে যায়। এই অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য সে সর্বদা মুখোশ পরে থাকে এবং হাতে অত্যাচারের চাবুক ও নিজেকে পাহারা দেয়ার জন্য নির্মম ও নিষ্ঠুর পাশবিক প্রাণী দ্বারা প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করে। তার প্রতিপক্ষ যদি অত্যাচারের চাবুক ও পশুবাহিনীর দেয়াল ভেদ করে একবার তার সামনে এসে দাঁড়ায় তবে সে কী পরিমাণ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে চূড়ান্ত পরিণতির দিকে দৌড়াতে থাকে তা বোঝার জন্য রবীন্দ্রনাথের রক্ত করবী, সত্যজিৎ রায়ের হীরক রাজার দেশে, শেক্সপিয়রের হ্যামলেট কিংবা গ্রিক ট্র্যাজেডি ইডিপাসের কাহিনীগুলোতে ঢুঁ মেরে আসতে পারেন।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য


আরো সংবাদ



premium cement

সকল