২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

জর্দানের ইসরাইলপ্রীতি

জর্দানের ইসরাইলপ্রীতি - ছবি : নয়া দিগন্ত

(লেখাটি দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকায় ১৯ জুলাই, ২০২৪ তারিখে প্রকাশিত হয়েছে)

জর্দান প্রায় প্রতিনিয়ত জেরুসালেম ও আল আকসা মসজিদে ইসরাইলি হামলার নিন্দা করে। এই নিন্দাবাদ বলতে গেলে কয়েক দশক ধরে চলে আসছে, তথাপি আম্মান ইসরাইলি দখলদারিত্ব রোধ করতে বা কোনো স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে পারেনি বা করেনি। জর্দানসহ কিছু আরব ও মুসলিম রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোনো শক্ত প্রতিরোধ ছাড়াই ইসরাইলি দখলদার কর্তৃপক্ষ পবিত্র শহরটির ইহুদীকরণ চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। ফিলিস্তিনিদের দাবি ও অধিকারের কোনো ইসরাইলি লঙ্ঘন জর্দান আজ পর্যন্ত সাফল্যের সাথে ঠেকাতে পারেনি।

জর্দান ও আশপাশের আরব অঞ্চলে সিসা পান যেন এক অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। জর্দানি সমাজে বিকেল হলে দলে দলে লোকজন ধূমপানের হাতল নিয়ে বাজারে যায়। সোনা, রুপা, পিতল নানা কিছুর তৈরি বাহারি কারুকাজ সংবলিত সে হাতল নিয়ে তারা আয়েশ করে গুড়গুড়ি টানে। মনসফ খায়, কফি পান করে, সাথে আরবি ও পশ্চিমা গানের মিউজিক শুনে রাত করে বাড়ি ফেরে। আম্মানে গড়ে উঠেছে অনেক বলরুম যেখানে নিয়মিত ড্যান্স ও আধুনিক আরবি পপ মিউজিকের আসর বসে, ফলে তরুণ শ্রেণী বেশি এ দিকে আসক্ত হচ্ছে।

আর্থিক দুরবস্থার জন্য জর্দানকে বিদেশী সহায়তার ওপর বেশি নির্ভরশীল হতে হয়। এক হিসাবে দেখা গেছে, ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বার্ষিক ১২৭৫ কোটি ডলার দ্বিপক্ষীয় বৈদেশিক সহায়তা দেয়া হয়েছে যা মোট ৬.৩৭৫ বিলিয়ন ডলার। এই তহবিলে ৪২৫ মিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা ছাড়াও অর্থনৈতিক সহায়তার ১.০৮ বিলিয়ন ডলার রয়েছে। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে নতুন সমঝোতা স্মারক অনুসারে ২০২৬ সাল পর্যন্ত জর্দানকে ৬.৫ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দেয়া হবে। উল্লেখ্য, জর্দান বিশ্বে বার্ষিক মার্কিন বৈদেশিক সহায়তাপ্রাপ্তির তৃতীয় বৃহত্তম দেশ। জর্দানে সুপেয় পানিরও বড় সঙ্কট রয়েছে। জাতীয় পানি প্রকল্পে অতিরিক্ত ১০০ মিলিয়ন ডলার দেয়া হচ্ছে।

অর্থনীতিবিদরা দেখছেন, নগদ সহায়তা ছাড়া জর্দানের অর্থনীতি বাঁচানো সম্ভব নয়। সৌদি আরব, আরব আমিরাত ও কুয়েত এ দেশকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার সাহায্য দিয়ে থাকে। কাতার জর্দানিদের জন্য ১০ হাজার চাকরির সুযোগ দিয়েছে। পর্যটন ও পর্যটন অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য এই দেশগুলো প্রতিনিয়ত অর্থ জোগান দিয়ে থাকে। তাই আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে তাদের মতামত ও উদ্দেশ্যের বাইরে যাওয়া আম্মানের পক্ষে সম্ভব নয়। এত কিছুর পরও ইসরাইলের অনুরোধে কাতারভিত্তিক আলজাজিরার অফিস বন্ধ করে দিয়েছে আম্মান।

অর্থনৈতিক দুরবস্থা পর্যালোচনায় জর্দানের জিডিপি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। চলতি বছরে এ পর্যন্ত জর্দানের জিডিপি ৫৩.৫৭ বিলিয়ন ডলারের মতো। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ২০২৩ সালে ছিল ২.৬ শতাংশ এবং বর্তমান বছরে এই পর্যন্ত হিসাবে ২.৬ শতাংশ অতিক্রম করেনি। সরকারিভাবে বেকারত্বের হার ১৮.৩ শতাংশ, তবে অনানুষ্ঠানিক হার প্রায় ৩০ শতাংশ। প্রধান রফতানি অংশীদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব ও ইরাক। প্রধান আমদানি অংশীদার চীন, সৌদি আরব, আরব আমিরাত ও যুক্তরাষ্ট্র। দেখা যায়, একটি নির্দিষ্ট বলয়ের ভেতর জর্দানের মুদ্রা ঘোরাফেরা করছে। জর্দান পানি সমস্যা, তেল আমদানি, বেকারত্ব ও অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতার সাথে যুদ্ধ করছে। একটি রাজকীয় সাম্রাজ্য অনেকটা পরনির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। অনেকটা বাধ্য হয়েই সরকার মিডিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। এর মধ্যে যুক্ত হয়েছে গাজা যুদ্ধ ও ফিলিস্তিনিদের বাঁচা-মরার সংগ্রাম।

চলমান গাজা যুদ্ধের মধ্যে জর্দানে মার্কিন সেনার সংখ্যা দুই দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। আম্মানে প্রায় চার হাজার সেনা মোতায়েন করা হয়েছে, আগের চেয়ে ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র যখন যেরূপ প্রয়োজন সেরূপ সেনা বাড়ায়-কমায়। জর্দানের বাদশাহর (যেটি মুসলিম বিশ্বে হাশেমাইট কিংডম) নামে পরিচিত কিছু করার থাকে না।

গত জানুয়ারিতে জর্দানের একটি দূরবর্তী ঘাঁটিতে ইরাকি মিলিশিয়াদের ড্রোন হামলায় তিন মার্কিন সেনা নিহত ও ৪০ জন আহত হওয়ার প্রেক্ষাপটে তুরস্কের ইনসারলিং থেকে বিমান, বৈমানিক ও সরঞ্জাম জর্দানের আল-আজরাতে নিয়ে আসা হয়। জর্দান তার সামরিক বাহিনীকে অতিরিক্ত সম্পদ বরাদ্দ করতে বাধ্য হচ্ছে ও অর্থনীতি চাপে পড়ছে।

ইসরাইলকে ল্যান্ড করিডোর দেয়া-বিষয়ক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করায় জর্দানের সাংবাদিক হিবা আবু তাকে এক বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। ইসরাইল গোপনে ওই ভূমি ব্যবহার করে পণ্য পরিবহন করছে। প্রতিবেদনে আরো প্রকাশ পায়, জর্দানের কয়েকটি কোম্পানি এই করিডোর দিয়ে ইসরাইলে পণ্যসম্ভার পরিবহন করে। সরকার বিষয়টি অস্বীকার করলে ওই সাংবাদিক আরো প্রচার করেন যে, জর্দানে যাওয়া-আসার পরিবহন রুটগুলো গত ২৫ বছর ধরে কোনো পরিবর্তন হয়নি। তেলআবিবকে সহায়তা দিয়ে আসছে। তাছাড়া আম্মান ইসরাইলকে এমনকি গোয়েন্দা তথ্যও সরবরাহ করে!

বর্তমান গাজা যুদ্ধে জর্দান ভ্যালি, ভ্যালির ব্লক-সি ও মৃত সাগর ইসরাইলি রাষ্ট্রে সংযুক্ত করে সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগ করার ব্রত নিয়ে নেতানিয়াহু এগুচ্ছেন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী জেনারেল গান্টজও সংযুক্তকরণে নির্বাচনী ইশতেহার দিয়েছিলেন। অর্থাৎ যিনিই ক্ষমতায় আসুক না কেন, জর্দানের মূল্যবান ভূমি আরবরা হারাচ্ছেন। এসব ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর যুদ্ধের সময় ইসরাইল দখল করে নেয়। সুদীর্ঘ এই সময়ে এলাকা ফিরিয়ে নিতে জর্দান বা আরব রাষ্ট্রগুলো কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। তদুপরি ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের ১৪ বছর পর ১৯৮১ সালে ইসরাইল গোলান হাইট দখল করে। সিরিয়া, কাতার, হিজবুল্লাহ ও হামাস প্রতিরোধ সৃষ্টি করলেও এই ইস্যুতে একটি বুলেটও কেউ ছোড়েনি। এ দিকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গোলান হাইটস ইসরাইলের বলে সিল মেরেছেন। তিনি পশ্চিম তীর ও জর্দান ভ্যালি ইসরাইলের অংশ বলে থাকেন। পশ্চিম তীরের জায়গাজমিকে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ ‘সরকারি জায়গা’ বলে। ভ্যালির বড় সম্পদ অফুরন্ত পানির উৎস। এখানে ১৩৩টি গভীর কূপ আছে যেখান থেকে কৃষিজমি উপকৃত হয়। ইসরাইলিরা এসব কূপ নিয়ন্ত্রণ করে ফিলিস্তিনিদের কূপগুলো তারা বন্ধ করে দিয়েছে এবং ইসরাইল প্রতিদিন হাজার হাজার লিটার সুপেয় পানি তুলে কনভয় করে নিয়ে যায় আর আম্মান পানির সমস্যা নিয়ে দিন কাটায়।

এটি বিশ্লেষণ করতে কষ্ট হয় না যে, জর্দানের নিজের জায়গাজমির জন্য যুদ্ধ করা দূরে থাক প্রতিবাদ করারও সাহস নেই। বাদশাহর পক্ষে জনসমর্থন বেশি নেই। ব্রাদারহুড শক্তিশালী। কোনো দেশ বা সরকার ব্রাদারহুডকে সমর্থন দিলে বাদশাহর পতন হতে পারে। জর্দানের বাদশাহ এ ভয়ে অস্থির। ইসরাইল চায় ফিলিস্তিনিদের জর্দানে পাঠিয়ে দিতে। এমনিতেই জর্দানে ২০ লাখ ফিলিস্তিনি রয়েছে।

জর্দানের বাদশাহ আবদুল্লাহ শিয়া ক্রিসেন্ট সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র ও আরব মিত্রদের সতর্ক করেছিলেন। জর্দানে ৯৫ শতাংশ সুন্নি মুসলমান বাকিরা শিয়া। আবদুল্লাহর পিতা হোসেইনের একটি নিয়ম ছিল তর্জন গর্জন করা। তাকে সে জন্য জর্দানের সিংহ বলা হতো। তিনি বলতেন, নেতৃত্বের জন্য নাকি এমন করতে হয়। এখন আবদুল্লাহও সেটি অনুসরণ করছেন। মিডিয়ায় এরকম কিছু ভাইরাল তার পছন্দ।

আঞ্চলিক ক্ষমতার ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণে আমেরিকা-সৌদি আরব-ইসরাইল বলয় বর্তমানে এক বড় ফ্যাক্টর, তাই বলতে হয় জর্দান জ্বলন্ত কড়াইয়ের ওপর। বাদশাহ আবদুল্লাহ বছরে কয়েকবার ওয়াশিংটনে যান কর্তৃপক্ষকে পরিস্থিতি বোঝাতে যে, তিনি আমেরিকার পাশে রয়েছেন এবং জেরুসালেম পবিত্র নগরীর ওপর হাশেমীয়দের অভিভাকত্ব প্রাচীন আমল থেকে রয়েছে। এটি সমগ্র মুসলিম উম্মাহর সাথে সম্পর্কিত।
জর্দানে সংবিধান আছে, দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদ আছে, রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন আছে। সংবিধানে বাদশাকে বেশুমার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, তাই বাদশাহর কোনো কাজে বাগড়া দেয়া বা প্রশ্ন রাখা যাবে না।

বাদশাহই প্রধানমন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও বিচারকদের বাছাই করেন। তিনি সংসদ ভেঙে দিতে পারেন। তিনি আবার সেনাবাহিনীর প্রধান। সুতরাং গণতন্ত্রের কী রঙ তা জর্দানকে না দেখলে বোঝা যাবে না। আরব বসন্তের সময় বাদশাহ আবদুল্লাহর ভয় ছিল মিসর বা তিউনিসিয়ার মতো বিদায় হতে হবে কি না। তখন তিনি সংবিধান ও নির্বাচনী প্রক্রিয়া ঠিক করার ওয়াদা দিয়েছিলেন। কিন্তু নির্বাচনের সময় ব্রাদারহুড সমর্থিত অ্যাকশন ফ্রন্ট নির্বাচন বর্জন করে। ফলে বাদশাহর দল বিজয়ী হয়। যুক্তরাষ্ট্র জর্দানের রাজতন্ত্র রক্ষায় ২০০ সামরিক পরামর্শক বা কমান্ডো বাহিনী রাখে, পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে সংখ্যাটি দুই হাজার।

সম্প্রতি কাতারের সাথে যুক্তরাষ্ট্র ১০ বছরের সামরিক চুক্তি করেছে এবং কাতারের মার্কিন সামরিক ঘাঁটি অত্যাধুনিক ফাইটার ও বোম্বার দিয়ে বোঝাই করেছে, পাঠানো হয়েছে আরো অতিরিক্ত পাঁচ হাজার সেনা। তেহরান কর্তৃক ইসরাইলে মিসাইল আক্রমণের সময় ইরান থেকে নিক্ষেপ করা অনেক ড্রোন ইসরাইলে যাওয়ার আগেই জর্দানি বিমান সেগুলোকে ভূপাতিত করেছিল। ইরানের আধাসরকারি সংবাদ সংস্থা ফার্স জানিয়েছে, তেহরানের প্রতিশোধমূলক হামলার সময় ইসরাইলের প্রতি জর্দানের সমর্থনের বিষয়টি নজর রাখছে। এতে আরো বলা হয়, জর্দান হতে পারে ‘পরবর্তী টার্গেট’।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব ও গ্রন্থকার


আরো সংবাদ



premium cement