১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

হজে বিশেষভাবে লক্ষণীয় বিষয়সমূহ

হজে বিশেষভাবে লক্ষণীয় বিষয়সমূহ - ফাইল ছবি

পবিত্র কুরআনে হজ সম্পাদনের মূল বিষয়সমূহ বর্ণনার পাশাপাশি কিছু বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এসব বিষয়ে হাজী সাহেবগণের গভীরভাবে চিন্তা করে হজ সম্পাদন করা কর্তব্য।

সায়ী: সায়ী করার প্রতি আল্লাহ্পাক বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। বিশেষ করে সায়ী করার স্থানে সাফা ও মারওয়া পাহাড়কে আল্লাহ্পাক তারই নিদর্শনসমূহের অন্তর্ভুক্ত বলে উল্লেখ করেছেন (২) : ১৫৮। অর্থাৎ সেখানে আরো নিদর্শনসমূহ রয়েছে যেমন মাকামে ইব্রাহীম, যমযম, কাবা, হজরে আসওয়াদ ইত্যাদি। কাজেই ওমরাহ ও হজব্রত সম্পাদনের সময় ইতিহাসের সেই উদাহরণসমূহ গভীরভাবে উপলব্ধি করার মাধ্যমে হজরত ইব্রাহীম (আ:) এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও তা থেকে শিক্ষাগ্রহণের মন ও মনন তৈরি করা প্রয়োজন।

মীনায় অবস্থান : মীনা নামটি ইসলামের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ। এখানেই হজরত ইব্রাহীম (আ:) আল্লাহর ইশারায় প্রাণাধিক প্রিয় সন্তান হজরত ইসমাঈল (আ:) কে কোরবানি করতে নিয়ে এসেছিলেন মক্কা থেকে। মানুষের চিরশত্রু শয়তানকেও এখানেই কুমন্ত্রণা দেয়ার চেষ্টা করার অপরাধে পাথর নিক্ষেপ করে বিতাড়িত করেছিলেন তিনি। মীনা অবস্থানকালীন সময়ে আল্লাহ্তায়ালাকে খুব বেশি বেশি স্মরণ করতে বলা হয়েছে (২: ১৯৮-১৯৯)। এমনকি নিজের বাপ-দাদাকে যেমন স্মরণ করে থাকি তার চেয়েও বেশি করে আল্লাহকে স্মরণ করতে হবে (২:২০০)।

কাজেই এই সময় তাঁবুতে বসে শুধুই মহান রবের স্মরণে নিমগ্ন থাকতে হবে। অন্যথায় শয়তান আমাদের হজে মাবরুর অর্জনের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। মিনায় অবস্থানের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন :

‘আর স্মরণ করো আল্লাহকে নির্দিষ্টসংখ্যক কয়েকটি দিনে। অতঃপর যে লোক তাড়াহুড়া করে চলে যাবে শুধু দুই দিনের মধ্যে, তার কোনো পাপ নেই। আর যে লোক থেকে যাবে তার উপর কোনো পাপ নেই, অবশ্য যারা ভয় করে। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করতে থাক এবং নিশ্চিত জেনে রাখ, তোমরা সবাই তাঁর সামনে সমবেত হবে’ বাকারা (২:২০৩)।

অর্থাৎ ১২ জিলহজ শয়তানকে পাথর নিক্ষেপের পর্ব শেষ করে মীনা ত্যাগ করা যাবে। উল্লেখ্য যে, ওই রাতে মীনায় অবস্থানের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মোয়াল্লেম এবং এজেন্সির লোক সাধারণত নিরুৎসাহিত করে থাকেন তাদের অতিরিক্ত ঝামেলা এড়ানোর জন্য। তবে এ ব্যাপারে দৃঢ় থাকলে তা খুবই সম্ভব যা আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি। আমার তাঁবুর সবাই মীনা ত্যাগ করে চলে গেছেন। আমি একাই ১৩ জিলহজ রাত যাপনের জন্য রইলাম ও আল্লাহর সাহায্য ভিক্ষা চাইলাম। এমন কি একজন সহ-হাজী ভয় দেখালেন এখানে খাবেন কি? আমি দৃঢ়ভাবে উত্তর দিলাম আল্লাহপাক খাওয়াবেন। ইতোমধ্যে রান্নঘর বন্ধ করে সবাই চলে গেছে। কিন্তু সন্ধ্যার পর সত্যিই দেখলাম একজন আল্লাহর বান্দা আমার জন্য গরম ভাত আর মুরগির গোশত নিয়ে এসে হাজির। আমি মনে মনে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে উঠলাম।

হজের সময় দোয়া-মুনাজাত : হজের দিনগুলো অত্যন্ত বরকতময়। এ সময় কিভাবে মুনাজাত করতে হবে, কী চাইতে হবে সে ব্যাপারেও মহান পাক রাব্বুল আলামিন বলে দিয়েছেন:
‘... অতঃপর মানুষের ভেতর থেকে অনেকে বলে, হে আমাদের রব, সব ভালো জিনিস তুমি আমাদের এ দুনিয়াতেই দিয়ে দাও, বস্তত তাদের জন্য পরকালে আর কোনো পাওনাই বাকি থাকে না’ বাকারা (২:২০০)।

‘আবার তাদের অনেকেই বলে, হে আমাদের রব, এ দুনিয়ায়ও তুমি আমাদের কল্যাণ দান করো; (সর্বোপরি) তুমি আমাদের আগুনের আজাব থেকে রক্ষা করো’ বাকারা (২:২০১)।
‘এ ধরনের লোকদের তাদের নিজ নিজ উপার্জন মোতাবেক তাদের যথার্থ হিস্যা রয়েছে, আল্লাহ ্তায়ালা হচ্ছেন দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী’ বাকারা (২:২০২)।

কাজেই আমরা যেন এই দোয়া কবুলের দিনগুলোতে সুযোগ বুঝে শুধুই দুনিয়ার উন্নতির জন্য উঠে পড়ে আল্লাহর কাছে চাইতে না থাকি। বরং দুুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতের কল্যাণের জন্যই দোয়া করি। আখিরাতের কল্যাণ অর্জন করতে না পারলে বা আল্লাহর মাগফিরাত আদায় না করতে পারলে তো চিরদিনের আখিরাতের জীবন ধ্বংস হয়ে যাবে। এখানে বান্দাকে আল্লাহপাক একটি জীবন-দর্শনের শিক্ষা দিয়েছেন। দুনিয়ার জীবনে কল্যাণ চাওয়ার সময় অবশ্যই আখিরাতের কল্যাণকে চিন্তা-চেতনায় রাখতে হবে।

বাস্তব কিছু পর্যবেক্ষণ
আত্মোপলব্ধি : হজের যাত্রাকালে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সাথে সাথেই নিজের আভিজাত্য, পদমর্যাদাবোধ, সম্পদের প্রতি অতি আস্থাশীলতা, জ্ঞানের ও লব্ধ অভিজ্ঞতার গরিমা ইত্যাদি সব ভুলে গিয়ে শুধু আল্লাহ পাকের দয়ায় বেঁচে থাকা একজন মুসলমান বান্দা হিসাবে নিজেকে আবিষ্কার করতে হবে। দুই প্রস্থ সাদা কাপড়ে জড়ানো দেহ আর খোলা মাথায় নিতান্ত সাধারণ ও সাদা মনের মানুষ হয়ে যেতে হবে। এরকম মানসিক অবস্থায় পৌঁছতে না পারলে বিমানবন্দর থেকে শুরু করে হজ শেষে ফিরে আসা পর্যন্ত শুধু মানসিক কষ্টেই ভুগতে হবে। ব্যক্তির পদমর্যাদা বা বংশমর্যাদার প্রতি খেয়াল করে কেউ সেখানে বিশেষ মর্যাদা পায় না (২২: ২৫)।

ধৈর্য: হজের বিষয়ে আলোচনার মাঝে আল্লাহ পাক ধৈর্যের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন (বাকারা :১৫৩ এবং হজ ৩৫)। বিমানবন্দরে হাজির হওয়ার পর থেকেই প্রতি পদে পদে ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয়। বিশেষ করে জেদ্দা বিমানবন্দরে পৌঁছে সেখান থেকে মক্কায় হোটেলে বা বাসস্থানে পৌঁছতে অনেককেই রীতিমতো যুদ্ধের সম্মুখীন হতে হয়। ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া, লাগেজ সংগ্রহ, মোয়াল্লেমের প্রতিনিধি খুঁজে পাওয়া, অসম্ভব গরমের মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে অপেক্ষায় থাকা ইত্যাদি সাঙ্ঘাতিক রকম বিড়ম্বনার সম্মুখীন অনেককেই হতে হয়। এসব ব্যাপারে ধৈর্য অবলম্বন করতে হবে। মনে রাখতে হবে প্রাচীনকালের হাজীসাহেবগণের জাহাজে করে ৫-৬ মাস ভ্রমণের কষ্ট আপনি জেদ্দা বিমানবন্দরে পৌঁছে মাত্র ৪-৫ ঘণ্টায় অনুভব করেছেন। কিন্তু ভুলে যাবেন না যে, পূর্বেকার ৬-৭ মাসের পথ আপনি মাত্র ৬-৭ ঘণ্টায় পাড়ি দিয়ে এসেছেন। হেরেম শরিফে ঢোকা ও বের হওয়া, তাওয়াফ, সায়ী, মীনা, আরাফাত, মুজদালিফাহ, জামারায় কঙ্কর নিক্ষেপ ইত্যাদি সব স্থানেই অসীম ধৈর্যের প্রয়োজন হবে। এমনকি খাবার হোটেল, টয়লেট, লিফটে যে লম্বা লাইন হয় তাতে ধৈর্যচ্যুতি ঘটার আশঙ্কা থাকে। টয়লেটের সমস্যা সবচেয়ে বেশি হতে পারে মীনায়। এখানে এক একটি টয়লেটের দরজায় প্রায় ১০-১২ জনের লাইন লেগে থাকে। যদিও তা অল্প কয়েক দিনের জন্য মাত্র। তার উপর আবার কঠিন গরম আবহাওয়ায় মেজাজও সবার চড়া হয়ে থাকে। কিন্তু সর্বাবস্থায় চরম ধৈর্যেয় সাথে অন্যের প্রতি দয়ালু ও সম্মানজনক আচরণ করতে হবে। আল্লাহ পাক ঘোষণা করেছেন হজ করতে আসা ব্যক্তি সম্মানযোগ্য (৫) : ২।

আরো একটা বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে যে, অনেক এজেন্সি তাদের ওয়াদা মোতাবেক সুযোগ-সুবিধা বা সেবা সরবরাহ করতে পারে না। প্রায় ২৫-৩০ লাখ মানুষ একত্র হয়ে সব কার্যকলাপ একত্রে সম্পন্ন করার কারণে অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তা ছাড়া সৌদি কর্তৃপক্ষ অনেক ব্যাপারেই নিরাপত্তা এবং শৃঙ্খলা রক্ষার তাগিদে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। কাজেই এজেন্সির অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে চরম ধৈর্যের সাথে হজ সম্পন্ন করতে হবে।

তাওয়াফ : আল্লাহর ঘরের এই তাওয়াফকে ভাবগাম্বীর্যের সাথে সুসম্পন্ন করতে হবে। হৃদয়কে আল্লাহর প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর ভয়ে সিক্ত করে তাওয়াফ করতে হবে। আল্লাহর ঘরকে কেন্দ্র করে চারদিকে ঘুরতে থাকা মানে সারা জীবনের প্রতিজ্ঞা নেয়া যেন বাকি জীবনটা এভাবেই আল্লাহ পাককে কেন্দ্র করে জীবনের চাকা ঘুরতে থাকে। প্রতিটি কাজে তাই সিদ্ধান্ত নেবো; এই কাজটি আল্লাহ পাকের পছন্দনীয়, না কি অপছন্দনীয়। অপছন্দনীয় হলে তাৎক্ষণিকভাবে পরিত্যাগ করবো আর পছন্দনীয় হলে ভালো করে সুসম্পন্ন করবো এবং আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করবো যেন তিনি আমাদের এই কাজটুকু কবুল করেন।

তাওয়াফ করার সময় কিছু বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে। দল বেঁধে সমস্বরে দোয়া পড়ে তাওয়াফ করলে অন্যদের মনোযোগে বিঘ্ন ঘটে। কারণ, তাওয়াফটি নামাজের মতোই আন্তরিকতা ও আল্লাহর প্রতি পূর্ণ মনোযোগসহকারে করা উচিত। এ জন্য বই বা অন্য কোনো কিতাব দেখে দেখে দোয়া না পড়ে নিজের জানা দোয়া বা তিলাওয়াত করাই উচিত। কারণ তাওয়াফের সুনির্দিষ্ট কোনো দোয়া নেই। শুধু রোকনে ইয়ামিন থেকে হজরে আসওয়াদ পর্যন্ত স্থানে ‘রাব্বানা আতিনা’ দোয়াটি (বাকারা :২০১) পড়ার বিধান রয়েছে। আরো একটি অত্যন্ত আপত্তিকর বিষয় পরিলক্ষিত হয় যে, অনেকে তাওয়াফ করার সময় মোবাইল ফোন দিয়ে সেলফি ছবি তোলা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন বা ভিডিও করেন বা দূরের আত্মীয়স্বজনকে নিজের তাওয়াফের দৃশ্য দেখাতে থাকেন। এগুলো করে কতটুকু মনোযোগসহকারে তাওয়াফ করা যায় তা নিজেকে জিজ্ঞেস করতে হবে।

কালো পাথরে চুমু দেয়া সুন্নত ও সওয়াবের কাজ। কিন্তু এ জন্য প্রচণ্ড প্রতিযোগিতা করে এগোতে হবে, এমনটি হলে অন্যকে ধাক্কা দিয়ে কষ্ট দিলে অন্যায় হবে। অনেকে আবার আবেগাপ্লুত হয়ে কাবার দেয়াল ও দরজা স্পর্শ করার জন্য ভিড় মাড়িয়ে সামনে যেতে থাকেন। এতে অন্যদের কষ্ট হয়। কেউ তেমন বেপরোয়া আচরণ করলেও তাকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে তাওয়াফ শেষ করে ফিনিসিং পয়েন্ট থেকে সরাসরি উল্টো দিকে না গিয়ে সামনে এগিয়ে আস্তে আস্তে কাবা প্রাঙ্গণের বাইরের দিকে বের হলে অন্যের সাথে ধাক্কাধাক্কি হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। আবার তাওয়াফের পর মাকামে ইব্রাহীমের পিছনে দুই রাকাত নামাজ পড়ার জন্য হুড়োহুড়ি না করে কাবা প্রাঙ্গণের যে কোনো সুবিধাজনক স্থানে পড়লেও চলবে। কারণ সবাই একেবারে মাকামে ইব্রাহীমের সরাসরি পিছনে নামাজ পড়ার চেষ্টা করার কারণে সেই স্থানটিতে অত্যন্ত ভিড় জমে যায়। ফলে তাওয়াফ করতে থাকা মানুষজনের খুবই কষ্ট হয়। তাওয়াফকারীদের এই কষ্টের কারণ যেন আপনি না হন সেই দিকে খেয়াল রাখতে হবে।

লেখক: কলামিস্ট
e-mail: [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement