জাবালিয়া ও রাফায় কেন আক্রমণ
- মো: বজলুর রশীদ
- ০৯ জুন ২০২৪, ০৫:৩৬
হামাসের ইসরাইলি ভূখণ্ডে আক্রমণ ফিলিস্তিনিদের সাত দশকের প্রতিরোধের ইতিহাসে একটি বড় ঘটনা। প্রায় প্রতিদিন ফিলিস্তিনিদের হত্যা ও লুটপাটের প্রতিবাদে এতদিন ফিলিস্তিনি যুবকরা শুধু পাথর ছুড়ে প্রতিরোধ করেছে। তাদের কোনো অস্ত্র ছিল না। গত ৭ অক্টোবর নতুন অস্ত্র ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে জিম্মি ধরে নিয়ে আসায় ইসরাইল হতবাক হয়ে যায়। সাথে সাথে তারা গাজায় যুদ্ধ ঘোষণা করে। নেতানিয়াহুর ধারণা ছিল গাজায় আক্রমণ করে স্থলপথে ও বিমান পথে জার্মানির ব্লিৎসক্রিগ কৌশলে আক্রমণ চালিয়ে দুই-এক দিনের মধ্যে গাজা ও হামাসকে নিঃস্তব্ধ করে দেবে। আজ সাত মাস হয়ে গেলো ইসরাইল তেমন কোনো সুবিধা করতে পারেনি। কিছু ইসরাইলি জেনারেলও মনে করছেন ইসরাইলের পরাজয় হয়েছে।
হামাসকে শেষ করতে না পারলে এই যুদ্ধের কোনো তাৎপর্য থাকবে না। তাই তাদের নিঃশেষ করার জন্য নেতানিয়াহু উঠেপড়ে লেগেছেন। শান্তি বা যুদ্ধবিরতি আলোচনা যাই হোক না কেন হামাসের ঘাঁটিগুলোকে নিশ্চিহ্ন করতে হবে। তাদের মতে হামাস ও যোদ্ধাবাহিনী গাজার জাবালিয়া ও রাফায় এখন জড়ো হয়েছে। তাই এ দু’টি স্থানে তাদের যুদ্ধের বড় আয়োজন।
গত ৩০ দিন ধরে দখলদার বাহিনী জাবালিয়া ও শহরের শরণার্থী শিবিরে এমন হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে যা সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। সবাই জানতে চায় এই ছোট্ট স্পটটি কেন এত ক্রমাগত ধ্বংসের কারণ হচ্ছে। মাত্র ১.৪ বর্গকিলোমিটারের সঙ্কীর্ণ এলাকা বিশ্বের সর্বোচ্চ জনসংখ্যার ঘনত্ব ধারণ করছে। এখানে ১ লাখ ১৬ হাজার মানুষের বসবাস এবং এটি ফিলিস্তিনের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির। বর্তমান যুদ্ধের শুরুতে, দখলদার সেনাবাহিনী জাবালিয়া শিবিরের ওপর তার ক্ষোভ ঢেলে দেয়, এই যুদ্ধে এখন পর্যন্ত সহিংস ও নৃশংস চারটি গণহত্যা চলে এবং জাবালিয়ার বিরুদ্ধে বিজয় ঘোষণা করে দক্ষিণ দিকে যাত্রা শুরু করে। এখন আবার ফিরে এসে দখলদার সেনাবাহিনী আশপাশে বোমা ফেলছে। এতে উত্তরাঞ্চলের ফিলিস্তিনিরা অনাহারে মারা যাচ্ছে। আর এখন নেতানিয়াহুর সেনাবাহিনী দ্বিতীয় দফায় ঢুকে পড়ার চেষ্টা করছে, সম্ভবত শিবিরটি ধ্বংস করতে চাইছে।
১৯৬৭ সালে জাবালিয়া শিবির থেকে দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ শুরু হয়েছিল। একজন মুক্তিযোদ্ধা হেলিকপ্টারে গুলি করে। দখলদার সেনারা প্রায় পাগল হয়ে যায়। তারা ট্রাক বোঝাই সৈন্য পাঠিয়ে মাঠ পর্যায়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছিল এবং নাপাম বোমা ফেলেছিল। নাপাম বোমায় কতজন মারা গিয়েছিল তার হিসাব ফিলিস্তিনিদের কাছে নেই। তবে শিবিরে, পুরো পরিবারকে নাগরিক রেজিস্ট্রি থেকে মুছে ফেলা হয়েছিল। ১৯৮৭ সালে জাবালিয়া থেকে প্রথম ইন্তিফাদার স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠেছিল। তখন সবাই একে ‘বিপ্লব শিবির’ বলে ডাকতে শুরু করে। এর সাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ছিলেন হাতেম আল-সিসি, যিনি ইন্তিফাদার প্রথম শহীদ। তার রক্তপাত পশ্চিম তীর ও গাজায় ইন্তিফাদা বিস্তারে অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। ‘ইসরাইলের বুলডোজার’ নামে পরিচিত যুদ্ধাপরাধী এরিয়েল শ্যারনের যুগে ২০০৩ সালে দখলদারদের ট্যাংক ও বিমান জাবালিয়া শিবির ধ্বংস করে দেয়। একই অপরাধী ২০০৪ সালে হামলার পুনরাবৃত্তি করে। তা সত্ত্বেও, প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দিতে ব্যর্থ হয়। আর আজ ২০ বছর পর তার উত্তরসূরি নেতানিয়াহু জাবালিয়া শিবিরে হামলা চালাচ্ছেন।
দখলদার বাহিনীর নেতারা প্রকাশ্যে ও গোপনে আলোচনা করে, চিৎকার-চেঁচামেচি করে এবং সারাক্ষণ সম্মেলন করে; তাদের মনে একটাই প্রশ্ন: কিভাবে মানচিত্র থেকে জাবালিয়া শিবিরটি মুছে ফেলা যায়। সেখানে কি পারমাণবিক বোমা ফেলতে হবে? ৪০ হাজার টন বিস্ফোরক তাদের মৃত্যুর তৃষ্ণা মেটাতে পারেনি, তাদের শেষ করতে কত টন বোমা দরকার?
জাবালিয়া শিবির ঘিরে সাত মাসের দখলদারিত্বে উত্তর গাজার জনগণকে অনাহারে রেখে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। বোমার পরিবর্তে প্রাকৃতিক শক্তির ব্যবহার! তারা ভেবেছিল হানুন, বেইত লাহিয়া এবং খান ইউনিসের মতো এটিও সমতল হয়ে যাবে। কিন্তু জাবালিয়া শিবির অটুট রয়ে গেছে। ইসরাইলি দখলদার ট্যাংকগুলো জাবালিয়ায় ফিরে আসে। যেন নতুন করে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। আকাশ থেকে বোমা ফেলা হয়, যুদ্ধবিমান থেকে ১০০০ পাউন্ড, ২০০০ পাউন্ড বোমা ফেলা হয়, যার লক্ষ্য বাড়ির ভেতরে আরো নিরীহ বেসামরিক মানুষকে হত্যা করা। তাদের একমাত্র দোষ তারা বলেছে, ‘আমরা ঘর ছেড়ে যাব না, আমরা পালিয়ে যাব না।’
সেনাবাহিনী শিবিরের প্রায় ৭০ শতাংশ নিদর্শন ধ্বংস করে দিয়েছে। এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো অদৃশ্য হয়ে গেছে। যারা জাবালিয়ায় থেকে গেছে, তারা জানেন বাস্তুচ্যুতি কী ভয়াবহ, এর অর্থ চিরস্থায়ী নির্বাসন। তারা জানে আরেকটি বাস্তুচ্যুতির অর্থ হচ্ছে ফিলিস্তিন ছেড়ে সিনাইয়ে চলে যাওয়া, যার অর্থ হবে চিরতরে শেষ হয়ে যাওয়া। সবাই জানে যে জাবালিয়া শিবিরের দৃঢ়তা এবং এর জনগণ এবং গাজার জনগণের ধৈর্য না থাকলে নেতানিয়াহু সিনাইয়ে তাদের বাস্তুচ্যুত করার লক্ষ্য অর্জিত হতো। সম্ভবত এটাই জাবালিয়া ও এর বাসিন্দাদের প্রতি নেতানিয়াহু ও তার সেনাবাহিনীর ক্ষোভের কারণ।
১৯৬৭ সালে প্রথম গণহত্যা এবং ১৯৮৭ সালে প্রথম ইন্তিফাদা, ২০০৩ সালে দ্বিতীয় গণহত্যা এবং ২০০৪ সালে তৃতীয় গণহত্যার পর ফিলিস্তিনিরা জাবালিয়া ক্যাম্প পুনর্নির্মাণ করেছে। ফিলিস্তিনিরা বর্তমান গণহত্যার পর আবারো শিবিরটি পুনর্নির্মাণ করবে। এটাই বাস্তবতা। এত প্রতিরোধ সত্ত্বেও ইসরাইলি সেনারা গাজার ৩৫ শতাংশ দখল করে নিয়েছে। সম্পদশালী আরব দেশ ও এত মুসলিম দেশ কোনো কাজে এলো না।
হাদিসে আছে যে, একসময় ফিলিস্তিনি-ইহুদি যুদ্ধে পাথর ও গাছপালা ইহুদিদের অবস্থান জানিয়ে দেবে। হাদিসের ব্যাখ্যায় এক ফিলিস্তিনি বলেছেন, ‘আমাদের মরণে ও দুঃখে কোনো সাথী নেই। তাই চরম মুহূর্তে সৃষ্টিকর্তা পাথর ও গাছকে এই শক্তি দেবেন।’
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু মিসর সীমান্তের কাছে গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর রাফায় সামরিক অভিযান চালাচ্ছেন। অবরুদ্ধ অঞ্চলটির ছোট্ট শহরটিতে ১৪ লাখ বাস্তুচ্যুতের বাস। গাজার রাফা লাইফলাইন এখন যুদ্ধের ময়দান। সীমান্তের কাছে পতাকা ঝুলিয়ে ইসরাইলিরা দর্প দেখাচ্ছে। দফায় দফায় যুদ্ধবিরতির আলোচনা চললেও বোমাবর্ষণ বন্ধ নেই, বন্ধ নেই ট্যাংকের আক্রমণ। এবার রাফায় রিমোট কন্ট্রোল ট্যাংক ব্যবহার করছে ইসরাইল। ইসরাইল বলে বেড়াচ্ছে হামাস রাফায় শক্ত ঘাঁটি গড়েছে এবং এখান থেকেই আক্রমণ চালাচ্ছে। নেতানিয়াহু ঘোষণা দিয়েছেন যুদ্ধবিরতি চুক্তি হোক না হোক রাফা আক্রমণ চলবে। ইসরাইল মনে করে, রাফাহর নিয়ন্ত্রণ নেয়া ছাড়া গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে জয়লাভ অসম্ভব। একই সাথে এ অভিযান মানবিক বিপর্যয় তৈরি করবে- এমন সতর্কতাও প্রত্যাখ্যান করেছে তারা।
জাতিসঙ্ঘ বলেছে, প্রায় ১০ লাখ মানুষ রাফাহ থেকে পালিয়েছে, আরো কয়েক লাখ এখনো সেখানে আশ্রয় নিয়ে আছে। জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে রাফায় আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে ইসরাইল। এর আগেই প্রেসিডেন্ট জো-বাইডেন বলেছেন, ‘ইসরাইলি বাহিনী গণহত্যা করছে না এবং গাজা উপত্যকায় যা হচ্ছে সেটা গণহত্যা নয়।’
ইসরাইলের রাফা আক্রমণের পেছনে কয়েকটি মূল কারণ রয়েছে। যেমন মিসরের ওপর চাপ: রাফায় নেতানিয়াহুর পূর্ণ মাত্রায় সামরিক অভিযান মিসরকে চাপে ফেলার লক্ষ্যেও পরিচালিত। লক্ষ্যটি হলো সঙ্ঘাতের প্রেক্ষাপটে মিসরের কাছ থেকে প্রভাব বিস্তার এবং সম্ভাব্য ছাড় পাওয়ার জন্য পরিস্থিতি ব্যবহার করা। এর পর রয়েছে গাজাকে জনশূন্য করা; ক্রমবর্ধমান সামরিক অভিযানের উদ্দেশ্য সীমান্ত পেরিয়ে হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে স্থায়ীভাবে মিসরে বাস্তুচ্যুত করা।
এই বাস্তুচ্যুতি কৌশল শুধু হামাস নয়, ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে বিস্তৃত প্রচারণার এক অংশ। নেতানিয়াহুর রাফা আক্রমণ করার পরিকল্পনা এই উদ্দেশ্যেই কাজ করছে। নেতানিয়াহু রাজনৈতিকভাবে টিকে থাকাও বড় ফ্যাক্টর। অনেক বিশ্লেষক ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে যুদ্ধের পরে নেতানিয়াহুকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হবে। নেতানিয়াহু সঙ্ঘাত বাড়িয়ে এবং রাফার মনোনিবেশ করে তার রাজনৈতিক অস্তিত্ব প্রসারিত করতে চান। তবে বিশ্ব নেতারা মনে করেন, রাফার ওপর পূর্ণ মাত্রায় হামলা একটি ‘রেড লাইন’। রাফা আক্রমণে পরিস্থিতি আরো সংবেদনশীল হয়ে উঠেছে। বেসামরিক জীবন এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ওপরও প্রভাব বিস্তার করেছে।
গাজা ধ্বংসস্তূপে পরিণত করার পর কয়েক দিন ধরে উত্তর গাজার জাবালিয়া এবং দক্ষিণ রাফার নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা করছে ইসরাইল। এ নিয়ে হামাসের সাথে ইসরাইলি বাহিনীর তুমুল যুদ্ধ চলছে। যুদ্ধে হামাস ও ইসরাইলের সেনাবাহিনী উভয় পক্ষই তাদের শত্রুদের উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতির দাবি করেছে। হামাসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তাদের যোদ্ধারা জাবালিয়া ও রাফায় ইসরাইলি সেনাদের সাথে তুমুল লড়াই করেছে। ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের আন্তঃসীমান্ত আক্রমণের পর থেকে ইসরাইল গাজা উপত্যকায় টানা আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে এবং গাজা উপত্যকায় অবরোধ আরোপ করেছে। এখন দেখার বিষয় যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে গাজা যুদ্ধের আপাত সমাপ্তি হবে নাকি যুদ্ধ আরো প্রলম্বিত হবে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব ও গ্রন্থকার
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা