জনগণ বাজেটের জন্য?
- রিন্টু আনোয়ার
- ০৮ জুন ২০২৪, ০৫:৪০, আপডেট: ০৮ জুন ২০২৪, ০৫:৪২
দেশের ইতিহাসে এ যাবতকালের সবচেয়ে বড় সাত লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা বাজেটে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পাঁচ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। ঘাটতি ধরা হয়েছে দুই লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। ‘সুখী সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের অঙ্গীকার’ শিরোনামে বাজেটে আগামী বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি-এডিপি বরাদ্দ দুই লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা।
সরকারের আর পরিবারের বাজেট মোটেই এক স্বভাবের নয়। এ দুই বাজেট তৈরির তরিকা ও পন্থা ভিন্ন। পারিবারিক বাজেট দাঁড় করানো হয় সম্ভাব্য আয় দৃষ্টে। আর রাষ্ট্রের বাজেট তৈরি হয় সম্ভাব্য ব্যয় হিসাব করে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যয় হিসাব করে রাজস্ব আয়ের টার্গেট ঠিক করে সরকার। ঘোষিত বাজেটের টার্গেট করা আয় সরকার জোগাবে বা আনবে কোত্থেকে? তাই বরাবরের মতো এবারো টার্গেট জনগণ। তারাই জোগানদার। কাটবে কিন্তু, রক্ত বের না হওয়ার মতো অবস্থা। রাজস্ব প্রাপ্তি কর থেকে যে পাঁচ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়েছে এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআর নিয়ন্ত্রিত ও বহির্ভূত আয় ধরা হয়েছে চার লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকা। মোট আয়ের মধ্যে এনবিআরের মাধ্যমে আয় আসবে চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। আর এনবিআরবহির্ভূত কর থেকে আয় আসবে ১৫ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়াও কর ছাড়া প্রাপ্তি আসবে ৪৬ হাজার কোটি টাকা। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তা আসবে জনগণের পকেট থেকেই।
জনগণের কাছ থেকে টাকা হাতানোর বহু ব্যবস্থা আছে সরকারের এবারের বাজেটে। ৩০ জুনের পর একটু ঘটা করে বিয়ে করতে গেলেও সরকারকে টাকা দিতে হবে। ট্যাক্স রিটার্ন ছাড়া কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ে, জন্মদিন বা যেকোনো সামাজিক অনুষ্ঠান করা যাবে না। এসব অনুষ্ঠানে কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া নিতে বাধ্যতামূলক ট্যাক্স রিটার্ন জমা দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে এ বাজেটে। বর্তমানে ৪৩ ধরনের সেবা পেতে রিটার্ন জমার রসিদ লাগে। এই তালিকায় মিলনায়তন ভাড়া, হোটেল, মোটেল, রেস্টুরেন্ট, হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্স নিবন্ধন ও নবায়নে রিটার্ন জমার বাধ্যবাধকতা যুক্ত হচ্ছে। এ ছাড়া প্রতি ১০০ টাকার টকটাইম পেতে হলে ১৩৩ টাকা ২৫ পয়সার জায়গায় এখন ১৩৯ টাকা রিচার্জ করতে হবে। ১০০ টাকা রিচার্জ করলে সরকার ২৮ টাকা শুল্ক-কর পাবে। ফলে সাধারণ গ্রাহক ৭২ টাকা ব্যবহার করতে পারবেন।
এর আগে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটে মোবাইল ফোনে কথা বলার ওপর প্রথমবার ৩ শতাংশ সম্পূরক শুল্কারোপ করা হয়। অতীতে কয়েক দফায় বাড়িয়ে শুল্ক ১৫ শতাংশ করা হয়েছিল। এবার তা ২০ শতাংশ করার প্রস্তাব রয়েছে। ইন্টারনেট সেবা ও মোবাইল ফোনের কলরেট বাড়তি সম্পূরক শুল্ক দিতে হবে জনগণকে। তা ফোনে রিচার্জ করার সময়ই কেটে রাখা হবে। যথারীতি কেটে রাখা শুরুও হয়েছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংসদে বাজেট পেশ মানে ‘সব কিছুই প্রস্তাব আকারে সংসদে উত্থাপন’, অতঃপর তার ওপর সংসদে আলোচনা করে চূড়ান্ত করার পর তা আনুষ্ঠানিক অনুমোদন। অর্থাৎ প্রস্তাব মানেই অনুমোদন নয়। অর্থাৎ চাকরির দরখাস্ত দেয়া মানেই চাকরি হয়ে যাওয়া নয়। কাউকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়া মানেই তার সাথে বিয়ে হয়ে যাওয়া নয়। অথচ মোবাইলের নয়া কলরেট নাকি সংসদে অর্থমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলীর কণ্ঠে প্রস্তাব আকারে উচ্চারিত হওয়া মাত্রই কার্যকর!
জনগণের টাকা হাতিয়ে নেয়ার আরো কত ছলাকলা আছে এই বাজেটে। ব্যাংকে টাকা রাখলে সেখান থেকেও কিছু টাকা হাতিয়ে নেয়ার নতুন ব্যবস্থা করা হয়েছে এবার। ব্যাংকে ১০ লাখ টাকার বেশি থাকলেই বাড়তি শুল্ক দিতে হবে। এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে ব্যাংকে থাকা টাকার ওপর আবগারি শুল্কের পরিমাণ বাড়ানো হয়েছিল। কোনো ব্যাংক হিসাবে আমানতের পরিমাণ বছরে এক লাখ টাকার বেশি হলেই আবগারি শুল্ক দিতে হয়। বর্তমানে শুল্কের স্তর ছয়টি থাকলেও ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে তা বাড়ানো হচ্ছে। বর্তমানে এক লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ১৫০ টাকা ও পাঁচ লাখ টাকা থেকে ১০ লাখ পর্যন্ত ৫০০ টাকা আবগারি শুল্ক রয়েছে। বর্তমানে এক লাখ পর্যন্ত ব্যাংক হিসাবের স্থিতিতে কোনো আবগারি শুল্ক দিতে হয় না। আবার এক লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ১৫০ টাকা এবং পাঁচ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ৫০০ টাকা আবগারি শুল্ক দিতে হয়। প্রস্তাবিত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে ১০ লাখ থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত আবগারি শুল্কের যে স্তরটি রয়েছে, সেটি ভেঙে দু’টি স্তর করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ১০ লাখ টাকা থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত গচ্ছিত টাকায় তিন হাজার টাকা আবগারি শুল্ক থাকবে। আর ৫০ লাখ টাকা থেকে এক কোটি পর্যন্ত তিন হাজার টাকার পরিবর্তে পাঁচ হাজার টাকা শুল্ক বসবে।
বাজেটে দুই লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকার ঘাটতির বোঝাও কোনো না কোনোভাবে টানতে হবে জনগণকেই। বাজেট নিয়ে মানুষ এখন আর আগের মতো ভয় পায় না। আগের সেই দিন বাঘে খেয়ে ফেলেছে। একটা সময় পর্যন্ত বাজেট ঘোষণার আগের সময়টা খুব তটস্থ থাকত বিভিন্ন মহল। ভয় হতো কোন জিনিসের দাম কত বাড়ে। এখন তারা সব আগেভাগেই জেনে যায়। দাম যা বাড়ানোর ব্যবসায়ীরা আগেভাগেই বাড়িয়ে ফেলে। এবার আগেই ফাঁস হয়েছে, সৎপথে আয়ের ওপর সর্বোচ্চ করহার ৩০ শতাংশ বাড়বে, আর অসৎপথে আয় করা কালো টাকা সাদা করতে মাত্র ১৫ শতাংশ। রাষ্ট্রীয় এ দর্শন ও ন্যায্যতা বুঝতে এখন আর বড় অর্থনীতিক হওয়া লাগে না। কাওরানবাজার-শ্যামবাজারের আড়তদার নয়, এ অর্থনীতি বোঝার ওস্তাদ হয়ে গেছে ফুটপাথের ফেরিওয়ালারাও। বাজেটে অর্থনীতির জটিল-কঠিন অনেক টার্ম ব্যবহার করা হয়। যথারীতি এবারো হয়েছে। সোজা করে স্বীকার করা হয় না, বাংলাদেশের অর্থনীতি টিকে আছে তিন গরিবের শ্রমের উপর। গ্রামের গরিব কৃষক, পোশাক কারখানায় কাজ করা তার কিশোরী কন্যা আর ঋণ করে জমি বেচে বিদেশে যাওয়া ছেলেটির পাঠানো অর্থের উপর। অথচ এই শ্রেণিগুলোই সবচেয়ে বেশি বঞ্চনার শিকার।
অর্থনীতির ব্যাখ্যা একটি জটিল সমীকরণ। মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, দ্রব্যের মূল্যও বৃদ্ধি পেয়েছে। বহুবার টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে। কৃষিনির্ভর এই দেশটিতে রয়েছে এক বিশাল জনসমষ্টি। রয়েছে খাদ্য ঘাটতি। দেশে নেই তেমন কোনো শিল্পায়ন, নেই কোনো খনিজ পদার্থ। আমদানি-নির্ভর দেশ থেকে কোনো রফতানির সুবিধা নেই। চা, পাট, চামড়া , চিংড়ি রফতানি তলানিতে চলে গেছে অনেক আগেই। বস্ত্রশিল্প শিকায় উঠে উঠে ভাব। রেমিট্যান্সযোদ্ধারা বিভিন্ন দেশে দাবড়ানিতে কাহিল। এত আলোচনা ও ক্ষোভের মধ্যেও টাকা পাচারকারী বা ঋণখেলাপিদের জন্যও সামনে দুর্দিনের আভাস নেই।
বাজেট ঘোষণার দিনটিতে বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রাপ্ত এ সংক্রান্ত তথ্যেও তা পরিষ্কার। এতে দেখা যায়, চলতি বছরের মার্চ প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি। গত ডিসেম্বর প্রান্তিকে ছিল এক লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৬ হাজার ৩৬২ কোটি টাকা, যা আগের তিন মাসের তুলনায় ২৫ দশমিক ১৭ শতাংশ বেশি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ শেষে ব্যাংক খাতের ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৪০ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে এক লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বর শেষে ঋণ স্থিতি ছিল ১৬ লাখ ১৭ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ছিল এক লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রথম তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৬ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা। যেখানে ঋণ বেড়েছে মাত্র ২৩ হাজার ১৬৬ কোটি টাকা। রাষ্ট্রীয় মালিকানার ব্যাংকগুলোর তিন লাখ ১২ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা ঋণের ২৭ শতাংশ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। গত ডিসেম্বরে ছিল ১৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর ১২ লাখ ২১ হাজার ১১৬ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। তিন মাস আগে যা ছিল ৫ দশমিক ৯৬ শতাংশ। এ অঙ্ক বা সংখ্যাগুলোতে চোখ বুলালে কী বার্তা মেলে?
অর্থমন্ত্রী বাজেটে যেসব পরিসংখ্যান ও বক্তব্য প্রকাশ করেছেন তার সাথে বর্তমান বাস্তবতার কোনো মিল নেই, দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক দুরবস্থা সমাধানের বাস্তব কোনো পরিকল্পনার পদক্ষেপও নেই। নেই ব্যাংক লুটপাট, বিদেশে অর্থপাচার, শেয়ারবাজারসহ অর্থনৈতিক খাতে দুর্নীতি রোধকল্পের কোনো দিকনির্দেশনা, বলছেন সংসদের ভেতরে-বাইরের বিরোধী রাজনীতিবিদরা। তারা আরো বলছেন, প্রস্তাবিত বাজেট জনগণের মাথার ওপর বাড়তি করারোপের বোঝা তৈরি করবে, তাই ঘাটতি মোকাবেলায় দেশী-বিদেশী বিভিন্ন উৎস থেকে নতুন নতুন ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে সচেতন হওয়া জরুরি। তা না হলে ব্যাপক করারোপে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় আরো অনেক বেড়ে যাবে।
প্রস্তাবিত বাজেটে আগামী অর্থবছরে আয়ের একটি উচ্চাভিলাষী টার্গেট দেয়া হয়েছে। বছর শেষে এটি অর্জন করা কখনো সম্ভব নয় বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তা ছাড়া গত ২৩-২৪ অর্থবছরে পেশ করা বাজেটের অনেকাংশ এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।
চলতি বছরের মে মাসের শেষে দেশের গ্রস রিজার্ভ ২৪.২২ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু এ হিসাব নিয়ে সংশয় রয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে বর্তমানে গ্রস রিজার্ভ ১৮ বিলিয়ন ডলারের নিচে। আর নিট তো ১৩ বিলিয়ন ডলারেরও নিচে নেমে গেছে। তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো ডলার রিজার্ভে নেই।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা