২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

সফল হজের প্রস্তুতি : কুরআনের আলোকে

সফল হজের প্রস্তুতি : কুরআনের আলোকে - ফাইল ছবি

আমাদের জীবনে হজের তেমন প্রভাব প্রায়শ দেখা যায় না। এটিকে গতানুগতিক একটি ইবাদত হিসেবে নেয়ার কারণেই এমনটি হয়ে থাকে। কারণ হজের জন্য আমরা শুধু মক্কা-মদিনা ভ্রমণ এবং হজের পাঁচ দিনের বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতার প্রস্তুতি গ্রহণ করি। কিছু দোয়া-কালাম মুখস্থ করি। কিন্তু পবিত্র কুরআন এই হজের প্রস্তুতির কথা কি বলে সেই বিষয়ে আমরা অনুধাবন করার বা জানার চেষ্টা করি না। ফলে হজের আধ্যাত্মিক বিয়ষগুলো মোটেও অবগত হতে পারি না। অথচ হজ সম্পর্কে কালামে পাকের বয়ান জানতে পারলে বোঝা যাবে এটি একজন মুসলমানের আত্মার খোরাক, যা তাকে নতুন জীবনের সন্ধান দেবে।

মানসিক প্রস্তুতি : হজের প্রস্তুতির জন্য শুধু নিবন্ধনযুক্ত হয়ে টাকা জমা দেয়া এবং ইহরামের কাপড়, ব্যাগ, কঙ্কর সংগ্রহ করার থলে ক্রয় করা এবং হজসংক্রান্ত কয়েকটি ক্লাস করাই যথেষ্ট নয়। হজ সফলভাবে (মাবরুর হজ) সম্পন্ন করার জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি প্রয়োজন। হজ শব্দের অর্থ হলো ‘সংকল্প’। আধুনিক আরবি অভিধানে হজ অর্থ হলো : নিজের ব্যক্তিজীবন সংশোধন করা, জীবনের ভুলভ্রান্তি মেনে নিয়ে আল্লাহ পাকের যুক্তি (কুরআনে বর্ণিত) ও নিদর্শনের কাছে শির নত করে আত্মসমর্পণ করা, পুরোপুরি খাঁটি মোমেন বান্দা হওয়ার জন্য মনোজগতে পরিবর্তনের তুফান সৃষ্টি করা ইত্যাদি। এই অর্থগুলো পবিত্র কালামে পাকের হজসংক্রান্ত আলোচনার পরতে পরতে রয়েছে। কাজেই পারিভাষিকভাবে হজের অর্থ জিলহজ মাসের ৮ থেকে ১৩ তারিখ পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ সা:-এর শেখানো বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা এবং প্রকৃত আত্মসমর্পণকারী বান্দা হয়ে আত্মবিপ্লবের মাধ্যমে একমাত্র রবের পথে চলার সংকল্প গ্রহণ করা। কামারের কারখানায় যেমন লোহাকে পুড়িয়ে নরম করে তারপর সেটিকে প্রয়োজনীয় আকৃতি দেয়া হয়; তেমনি হেরেম শরিফ, মিনা, আরাফাহ, মুজদালিফাহ, জামারাহ ইত্যাদি স্থানে বিভিন্ন ইবাদতের মাধ্যমে একজন মুসলমানের হৃদয়-মন আল্লাহর ভয় ও প্রেমে উত্তপ্ত হয়ে কাদামাটির মতো নরম হয়ে ওঠে। এ সময় একজন হাজীর জন্য দরকার পরবর্তী জীবনে একনিষ্ঠভাবে একমাত্র আল্লাহর পথে চলার কঠোর শপথ নিয়ে হদয়কে নতুন করে পুনর্গঠন করা। এটি করতে পারলেই হাজীর হজ হবে ‘হজে মাবরুর’। আর তা করতে হলে বস্তুগত প্রস্তুতির পাশাপাশি কুরআনে আল্লাহ পাক যেভাবে হজ করতে বলেছেন তা জেনে ও বুঝে হৃদয়-মনকে প্রস্তুত করে যেতে হবে।

বিশুদ্ধ নিয়ত : হজ প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলমানের জন্য ফরজ (৩ : ৯৭)। কাজেই এই হজ করা হলো মানুষের নিকট আল্লাহ তায়ালার অধিকার। যে ব্যক্তি এই অধিকার আদায় না করবে সে নিজেই নিজেকে বিশাল প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করবে। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কাবাঘরের নির্মাতা হজরত ইবরাহিম আ:-কে হজের ঘোষণা করার আদেশ দেন (২২ : ২৭)। হজরত ইবরাহিম আ:-এর সেই ঘোষণা মহান আল্লাহপাক সাথে সাথেই বর্তমান ও অনাগত সব মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করেন, যেন পৃথিবীর সব প্রান্ত থেকে মানুষ এই ঘরে হজ সম্পাদন করতে আসে (২২ : ২৭)। আল্লাহ পাক স্পষ্ট করে জানিয়েছেন- ‘আর তোমরা আল্লাহর (সন্তুষ্টির) জন্য হজ ও ওমরাহ পালন করো’ (২ : ১৯৬)। এর আগের আয়াতেই (২ : ১৯৫) আল্লাহ পাক তাঁরই পথে অর্থ-সম্পদ ব্যয় করার তাগাদা দিয়েছেন। কারণ হজের জন্য খরচকৃত অর্থ নিখাদ আল্লাহর পথেই ব্যয়। কাজেই সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কৃপণতা করে যদি কেউ হজ সম্পাদন না করে তবে তার ইহ-পরকালীন ধ্বংস অনিবার্য (২ : ১৯৫)।

আত্মিক প্রস্তুতি : হজের উদ্দেশ্যে শুদ্ধ নিয়ত করার পর প্রথমেই মৌলিক প্রস্তুতি হিসেবে নিজের মন-মগজ ও আত্মার প্রস্তুতি নিতে হবে। নিজের মনোজগতকে এমনভাবে প্রস্তুত করে তুলতে হবে যেন হজের কঠিন-কঠোর দৈহিক ও আত্মিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পূর্ণ নতুনভাবে জীবনযাপনের উপযোগী হওয়া যায়। একটি ‘মাবরুর হজ’ একজন হাজীকে নবজাতকের মতো নিষ্পাপ করে তোলে। হাজী যেন নবজীবন লাভ করেন। ফলে তার চাল-চলন, আচার-ব্যবহার, ইবাদত-বন্দেগি, আর চিন্তার পরিশুদ্ধতার মধ্যে দৃশ্যমান পরিবর্তন আসে। এভাবেই হজ নামক সংকল্পের মাধ্যমে তিনি বিশুদ্ধ জীবন লাভ করতে পারেন। এ ধরনের প্রস্তুতির কথাই আল্লাহ পাক বলেছেন- ‘হজের মাসগুলো সুবিদিত; অতএব, যে ব্যক্তি এ সময়ের মধ্যে হজ করার স্থির করে নেয়, তবে হজে (প্রস্তুতিতে) না আছে অশ্লীলতা, না পাপাচার, আর না আছে বিতণ্ডা; এ সময়ে যতটুকু উত্তম কাজ তোমরা করবে আল্লাহ তা (ভালোমতো) জানবেন এবং অবশ্যই ‘ঝাদ’ বা পাথেয় (পথের সম্বল) সাথে নেবে; তবে নিশ্চিত মনে রেখো, উত্তমতম পাথেয় হলো তাকওয়া এবং (এ ব্যাপারে) আমাকে ভয় করো, হে জ্ঞানবোধসম্পন্ন-উলুল আলবার’ (২ : ১৯৭)।

হজের মাসগুলো হলো- শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজ। কেউ হজ করার সিদ্ধান্ত নিলে বা নিয়ত করলে এই সময়ে কোনো ধরনের অশ্লীলতা, কোনো পাপকাজ ও ঝগড়াঝাটি বা বিতণ্ডায় লিপ্ত হওয়া যাবে না। আর ইহরাম থাকা অবস্থায় এগুলো করলে তো হজই শুদ্ধ হবে না। অর্থাৎ শাওয়াল মাসের শুরু থেকেই এভাবে নিজের চরিত্রের সংশোধনের অনুশীলন আরম্ভ করতে হবে। সেই সাথে বেশি বেশি করে ভালো কাজ ও নেক আমল করতে হবে। কেননা এখানে আল্লাহপাক ভালো কাজের পরিমাণ উল্লেখ না করে বরং বলেছেন, যতুটুকুই করবে ততটুকুই তিনি (আল্লাহ) স্পষ্টভাবে জানবেন। সেই সাথে প্রয়োজনীয় পাথেয় অবশ্যই নিয়ে যেতে বলেছেন, যেন কেউ ভুল বুঝে ‘আল্লাহর পথে যাচ্ছি আল্লাহই চালাবেন ও খাওয়াবেন’, এ ধরনের ভ্রান্তিতে পড়ে সম্বলহীনভাবে মক্কার উদ্দেশে যাত্রা না করে। এখানে জাগতিক পাথেয়র সাথে তাকাওয়া বা আল্লাহভীতি ও পরহেজগারিকেই সবচেয়ে উত্তম পাথেয় বলে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। আর এই আল্লাহভীতি অর্জন শুরু হয় মাহে রমজানে (২ : ১৮৩)। এই আয়াতের বিবেচনায় সত্যিকারার্থে হজের মৌলিক প্রস্তুতি শুরু হবে রমজান মাস থেকেই। এভাবে একজন হাজী তাকওয়া অর্জন এবং অশ্লীলতা, পাপাচার ও ঝগড়া বিবাদ বর্জন করে দীর্ঘ তিন মাসের অনুশীলনের মাধ্যমে নিজেকে ‘মাবরুর হজের’ জন্য যোগ্য করে গড়ে তোলেন। উপরিউক্ত ১৯৭নং আয়াতের শেষাংশে মহান রব এই তাকওয়া অর্জন বা ‘তাঁকেই’ ভয় করার কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। যারাই এভাবে তাকওয়া অর্জনে ব্রতী হবে তাদেরকে ‘উলুল আলবাব’ বা বুদ্ধিমান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

প্রস্তুতির পদক্ষেপগুলো : ওপরে আলোচিত কুরআনপাকের বিভিন্ন আয়াত থেকে বোঝা গেল, হজের প্রস্তুতির পদক্ষেপগুলো নিম্নরূপ :

ক. শুধু আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই হজের নিয়ত বা সংকল্প করা।
খ. নিয়ত করার সাথে সাথে তিনটি নিষিদ্ধ কাজ পরিহার করা- ১. অশ্লীলতা; ২. যেকোনো অন্যায় বা গুনাহের কাজ ও ৩. ঝগড়াঝাটি।
গ. হজের নিয়ত করার পর থেকে শুধুই উত্তম কাজ বা আমল করতে থাকা।
ঘ. দুনিয়াবি পাথেয়র (প্রয়োজনীয় টাকা-কড়ি) ব্যবস্থা করা।
ঙ. সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাথেয় ‘তাকওয়া’ অর্জন করা।
চ. তাকওয়া অর্জনের মাস রমজানকে পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে নিজেকে হজের জন্য তৈরি করা।

হজের মাধ্যমে কাক্সিক্ষত বৈশিষ্ট্য অর্জন : দীর্ঘ তিন মাস ধরে অনুশীলনের পর বান্দা দুই প্রস্থ সাদা কাপড় পরে খালি মাথায় দীনহীন অবস্থায় আল্লাহর ঘরে এসে হাজির হয়। সেখানে হজের যাবতীয় কার্যক্রম সুসম্পন্ন করে নতুনভাবে জীবন গঠনের শপথ নেয়ার প্রয়াস পায়। মহান রাব্বুল আলামিনের অপার রহমতে সিক্ত হয়ে এই বান্দা তার হৃদয় নিঙড়ানো ভালোবাসা প্রভুর কদমতলে ঢেলে দেয়। তারপর বাকি জীবনটা এই উজাড় করা ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা নিয়ে মহাপ্রভুর বন্দেগি করার বুদ্ধিদীপ্ত শপথ গ্রহণ করে। অর্থাৎ যারা আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টির জন্য নিজের জীবন বাজি রাখার মতো দৃঢ়তা অর্জন করতে পারল তাদেরকেই তিনি ভালোবেসে নিজের বান্দা বলে উল্লেখ করেছেন। তাই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সতর্ক করে দিয়ে সব ঈমানদারকে উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছেন- ‘হে ঈমানদারগণ তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চিতরূপে সে তোমাদের প্রকাশ্য দুশমন’ (২ : ২০৮)।

এই আয়াতের অন্তর্নিহিত অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে হবে। পরিপূর্ণভাবে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত হওয়া মানে আমি আমার জীবনের সব কর্মকাণ্ডে ইসলামের দিকনির্দেশনা মানছি কি না। আর আধাআধি বা আংশিক ইসলাম পালন করার মানে হলো শয়তানের পথ অনুসরণ করা। কাজেই যে ব্যক্তি হজ করার সুযোগ পেয়েছে, তার পুরোপুরি ইসলামে দাখিল হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। তাই আল্লাহপাক সিদ্ধান্ত দিয়ে দিয়েছেন- ‘অতঃপর আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এসব সুস্পষ্ট নিদর্শন তোমাদের কাছে এসে যাওয়ার পরও যদি তোমরা পদস্খলন ঘটাও, তাহলে নিশ্চিত জেনে রেখো, আল্লাহ তায়ালা মহাবিজ্ঞ ও পরাক্রমশালী’ (২ : ২০৯)।

আল্লাহর কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পণই হজের শিক্ষা : একজন হাজী তার জাগতিক সব সম্মান, মর্যাদা, অবস্থান পেছনে ফেলে রেখে দুই প্রস্থ সাদা কাপড় পরে খালি মাথায় আল্লাহর ঘরে হাজির হন। একজন অসহায়, নগণ্য, অপরাধী বান্দা হিসেবে আল্লাহর কাছে নিজেকে পুরোপুরি সমর্পণ করে দেন। আর এই কাবাঘরের নির্মাতা হজরত ইবরাহিম আ:-এর শেখানো দোয়া পাঠ করেন (২ : ১২৭-১২৮)। আল্লাহর কাছে বিনীত কণ্ঠে অশ্রু বিগলিত হৃদয়ে অনুনয় বিনয় করেন তার হজ, তার সব ভালো কাজ গ্রহণ করার জন্য এবং তার অতীতের সব ত্রুটিবিচ্যুতি ক্ষমা করার জন্য। আরজ করেন, যেন নিজে সারা জীবন আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পিত জীবনযাপন করতে পারেন এবং তার পরবর্তী বংশধররাও যেন আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণকারী হিসেবে গড়ে ওঠে। এই নিঃশর্ত, পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণই হলো হজরত ইবরাহিম আ:-এর ধর্ম (২ : ১৩০-১৩২)।

লেখক : কলামিস্ট, গবেষক
Email : [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement