২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

গন্তব্য কোথায়?

গন্তব্য কোথায়? - নয়া দিগন্ত

সারা দেশের অভিভাবকরা বুকভরা আশা নিয়ে তাদের সন্তান-সন্ততিদের স্কুল কলেজ বিশ^বিদ্যালয়ে পাঠান- বৈশি^ক শিক্ষার সাথে সাথে নৈতিকতা শেখার জন্য? উন্নত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত মানুষ হওয়ার লক্ষ্যে। কিন্তু আজ নৈতিকতা শেখার জায়গায় অনৈতিকতা ও ব্যভিচারের জোয়ার দেখে সবাই আতঙ্কিত। কিছু দিন আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক তার স্নাতকোত্তর থিসিস ছাত্রীর শ্লীলতাহানির অভিযোগে বরখাস্ত হয়েছেন এবং অভিযোগ তদন্তে একটি কমিটি কাজ শুরু করেছেন। ৩ ফেব্রুয়ারি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র ক্যাম্পাসে বেড়াতে আসা দম্পতির স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে গণধর্ষণ করে। ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে একই ধরনের অভিযোগ উত্থাপিত হলে তাকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়। এক্ষেত্রেও তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ১৩ মার্চ একই কারণে কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন উত্তপ্ত হওয়ার খবর ছেপেছে দৈনিক যুগান্তর। ১৬ মার্চ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় উত্তাল হয়েছে অবন্তিকা নামের ছাত্রীর যৌন নিগ্রহজনিত আত্মহত্যায়। কদিন আগে ঘরে সিঁদ কেটে দুর্বৃত্তরা মা ও মেয়েকে ধর্ষণ করার ঘটনা পাঠক সমাজ নিশ্চয়ই ভুলে যাননি। ছাত্রী নিগ্রহের ঘটনায় ভিকারুনিসা নূন স্কুলের একজন শিক্ষক চাকরিচ্যুত হয়েছেন। যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ, গণধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলেছে। ২০২১ সালে ৩ হাজার ৭০৩ জন নারী ও শিশুকন্যা যৌন নির্যাতনের শিকার, ১২৩৫ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৬২৯ জন কন্যাশিশুসহ ১০১৮ জন ধর্ষণের শিকার। ১৭৯ জন গণধর্ষণের শিকার। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩১ জনকে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় লিগ্যাল এইড উপপরিষদের বরাত দিয়ে দৈনিক যায়যায়দিন ৫ জানুয়ারি ২০২২ সালে এ সংবাদ প্রকাশ করেছে। ২০২৩ সালের চিত্রও খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২৯টি- একটি বেসরকারি সংস্থার বরাতে খবরটি ছেপেছে দৈনিক মানবজমিন ১৩ ফেব্রুয়ারি। একই দিন দৈনিকটির হেডলাইন, যৌন কেলেঙ্কারিতে উত্তপ্ত ৪ বিশ্ববিদ্যালয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যানুসারে ২০১৯ সালে সারা দেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১৪১৩টি। ধর্ষণ চেষ্টা করা হয়েছে ১২৪ জনকে। থানায় মামলা হয়েছে ৯৯৯টি। ২০২০ সালে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১৬২৭টি। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৫৩ জনকে। ১১৪০টি মামলা হয়েছে থানায়। ২০২১ সালে ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা এবং ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা বিষয়ে মামলা হয়েছে ৯১৬টি। ২০২২ সালে মামলা হয়েছে ৬৫৯টি। ২০২৩ সালে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৫৪৭টি। ৩৩ জন ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন। ৪৩৩টি মামলা হয়েছে।

একটি লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, শিক্ষিত, অশিক্ষিত কিশোর যুবক-বৃদ্ধ, উচ্চপদস্থ কর্মচারী থেকে শুরু করে শ্রমিক, মজুর-কমবেশী সবার মধ্যেই এই প্রবণতা ছড়িয়ে পড়ছে। বেসরকারি সংস্থা, নারী-কর্মী, মানবাধিকারকর্মী কাউকেই এ ব্যাপারে খুব একটা উচ্চবাচ্য করতে দেখা যাচ্ছে না। অথচ এসব নারীকর্মী, মানবাধিকারকর্মীদের যৌথ চেষ্টায় ১৯৯৫ সালে ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডে দেশ অচল হয়ে গিয়েছিল যার পরিণতি ক্ষমতাসীন দলের জন্য সুখকর হয়নি। অথচ এখন ঘরে, বাইরে, পথে ঘাটে অফিস আদালতে স্কুল কলেজ বিশ^বিদ্যালয়ে যখন এই প্রবণতা ছোঁয়াচে রোগের মতো ছড়িয়ে পড়ছে, তখন এসব নারীকর্মী ও মানবাধিকারের প্রবক্তারা একদম চুপটি করে বসে আছেন। ঘোষণা দিয়ে ধর্ষণের সেঞ্চুরির ঘটনাও তাদের বিচলিত করেনি। প্রতিবাদমুখর হতে দেখা যায়নি তাদের।

সমাজে এ প্রবণতা ছড়িয়ে পড়ার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক ছত্রছায়া। প্রবণতাকে উসকে দিয়েছে বিচারহীনতা বা অপরাধীর পার পেয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি। সামাজিক অস্থিরতা বিচারহীনতা এবং রাজনৈতিক ছত্রছায়ার কারণে ছড়িয়ে পড়ছে এই সমাজবিধ্বংসী প্রবণতা। বিচারের দীর্ঘসূত্রতা এতে গতি সঞ্চার করেছে। আগুনে ঘি ঢালার মতো অবস্থা তৈরি হয়েছে স্কুলের কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের হাতে স্মার্টফোনের কল্যাণে। স্মার্টফোনের পর্দায় আসা বিভিন্ন অনৈতিক অ্যাপস এর মাধ্যমে কোমলমতি শিশুরা আকৃষ্ট হচ্ছে এই চরিত্রবিধ্বংসী কর্মকাণ্ডে। পরিবার শিশুদের সবচেয়ে বড় এবং অনুকরণীয় শেখার জায়গা। আকাশ সংস্কৃতির কল্যাণে সেখানেও ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে। নামাজ রোজা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, মানবিকতা-সততার মতো-পরিবেশ এখন পরিবারগুলোতে খুঁজে পাওয়া ভার। বাবা-মায়ের পারস্পরিক বিবাদ শিশুমন ও মানসকে প্রভাবিত করে ফেলে অত্যন্ত দ্রুততার সাথে। ছাত্রছাত্রীরা নৈতিকতা শেখার জন্য বিদ্যালয়ে যায়। কিন্তু সেখানেও একই অবস্থা। শিক্ষক ছাত্রীর অনৈতিক সম্পর্ক এখন শিক্ষাঙ্গনগুলোতে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। নৈতিকতা শেখার, চরিত্রগঠনের আঙিনায় অনৈতিকতার ব্যাপক ছড়াছড়িতে শিশুরা কী শিখবে? শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিক শিক্ষার অনুপস্থিতি সব বিষয়কে আরো গভীরে নিয়ে গেছে।

ধর্ষণের প্রকৃত সংখ্যা সব সময়েই পারিবারিক এবং সামাজিক কারণে জানা সম্ভব হয় না। অপরদিকে এই ক’বছরে যতগুলো মামলা হয়েছে এর কতগুলোর নিষ্পত্তি হয়েছে, কতজনের শাস্তি হয়েছে তা জনসম্মুখে আসেনি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তদন্ত কমিটি গঠনেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। বিচারের এই দীর্ঘসূত্রের ফলে অনেকে আইনের দ্বারস্থ হতে অনীহা বোধ করেন। থানায় মামলা করা থেকে শুরু করে বিচারের শেষ দিন পর্যন্ত তাদের যে ধরনের হেনস্তার মুখোমুখি হতে হয় তাও আইনের দ্বারস্থ না হওয়ার একটি বড় কারণ। এই সামাজিক অবক্ষয় থেকে জাতিকে বাঁচাতে হলে প্রয়োজন শিক্ষাব্যবস্থায় নীতি নৈতিকতা চরিত্রগঠন সম্পর্কিত বিষয়গুলোর অন্তর্ভুক্তি। শুধুমাত্র বৈষয়িক বিষয়ে দক্ষতা অর্জন এ প্রবণতাকে ঠেকাতে যথেষ্ট নয় তার প্রমাণ দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যৌন নিগ্রহের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো। বর্তমান এবং প্রস্তাবিত শিক্ষাব্যবস্থায় যে এটা সম্ভব নয়-তা একটি বাস্তবতা। অপরদিকে আইনের শাসনের নিশ্চয়তার সাথে সাথে সামাজিক পরিবেশেরও সংস্কার এবং শুদ্ধি প্রয়োজন। এক্ষেত্রে একটি সমন্বিত কর্মকৌশল দরকার। যে কর্মকৌশলে প্রথমেই থাকবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কার্যকর ব্যবস্থা। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন সর্বাগ্রে। দলমত ধর্ম-বর্ণ পেশা নির্বিশেষে দ্রুত কার্যকর বিচারের নিশ্চয়তা ছাড়া ধর্ষণের প্রবণতা রোধ করা সম্ভব নয়।

প্রয়োজন শিক্ষাক্রমে নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে সূচনা থেকেই ছাত্রছাত্রীদের মনে ধর্ষণবিরোধী মনোভাব সৃষ্টির ব্যবস্থা, মোবাইল ফোনে চরিত্রবিধ্বংসী অ্যাপসগুলো বন্ধ করার ব্যাপারে মোবাইল ফোন কোম্পানি এবং বিটিআরসি কর্তৃপক্ষ ও সাইবার ক্রাইম বিভাগকে নিয়ে টাস্কফোর্স গঠন করা যেতে পারে। টেলিভিশনের বিভিন্ন চ্যানেলে নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত সিরিয়ালগুলোর প্রচার বন্ধে কার্যক্রম অবিলম্বে শুরু করা দরকার। মসজিদ মাদরাসা, স্কুল-কলেজে নিয়মিত বিরতিতে ধর্ষণবিরোধী আলোচনা একটি কার্যকর ব্যবস্থা? বিভিন্ন এনজিও ও নারীবাদী সংগঠনগুলোকে এ ব্যাপারে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করা দরকার- যা এখন নেই বললেই চলে- শুধুমাত্র দু’ একটি বিবৃতি ছাড়া। মিডিয়াগুলোতে এ ব্যাপারে নিয়মিত আলোচনার ব্যবস্থা থাকা দরকার। মোট কথা ধর্ষণবিরোধী মনোভাবকে একটি সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করা গেলেই কেবল এ প্রবণতা কমার সম্ভাবনা। অবশ্য এ ব্যাপারে সর্বাগ্রে প্রয়োজন সরকারের সদিচ্ছা এবং ধর্ষণবিরোধী কঠোর অবস্থান।

লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
Email-shah.b.islam@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement