রমজানে আল-আকসায় কী হচ্ছে
- মো: বজলুর রশীদ
- ১৫ মার্চ ২০২৪, ০৪:৫৯
বিগত কয়েক বছর রমজানে মাসে আল-আকসা মসজিদকে কেন্দ্র করে নামাজরত ও কুরআন তেলাওয়াতরত ফিলিস্তিনিদের উপর ইসরাইলি সেনারা চড়াও হয়েছে এবং নির্যাতন করেছে। মসজিদে অগ্নিসংযোগ করেছে এবং মহিলা ও বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের বেধড়ক মারধর করেছে। এসব সংবাদ ও ভিডিও বিশ্বব্যাপী ক্ষোভ ও দখলদারদের প্রতি ঘৃণার সঞ্চার হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় বিশ্বব্যাপী মুসলমানরা যেন অপেক্ষায় আছে এই রমজানেও নির্যাতন নেমে আসতে পারে। বিভিন্ন মহল এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন আল-আকসায় যেন মুসলমানরা যাতে নামাজ রোজা পালনে বাধার মুখে না পড়ে সেই ব্যবস্থা নিতে বলেছেন নেতানিয়াহুকে।
আল-আকসা ফিলিস্তিনি এবং বিশ্ব মুসলিমের জন্য অত্যন্ত সংবেদনশীল ধর্মীয় ও জাতীয়তাবাদী প্রতীক। ১৯৬৭ সালে ইসরাইল পূর্ব জেরুসালেম এবং পশ্চিম তীর দখল করার পরে এটি ইসরাইল নিয়ন্ত্রণ করছে, যদিও জর্দানের নিযুক্ত ওয়াকফ সংস্থা বিশাল আল-আকসা প্রাঙ্গণটি পরিচালনা করে। ১৯৮০ সালে পূর্ব জেরুসালেমকে ইসরাইল সংযুক্ত করে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় স্বীকৃতি দেয়নি। আল-আকসায় জরুরি সেবা প্রদানকারী সার্জন ও স্বেচ্ছাসেবী চিকিৎসক মোহাম্মদ জাদাল্লাহ বলেছেন, ‘পশ্চিম তীর, গাজা বা ৪৮ অঞ্চল থেকে ফিলিস্তিনি উপাসনাকারীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ বা সীমাবদ্ধ করার ক্ষমতা প্রয়োগের কোনো অধিকার ইসরাইলের নেই। রমজানে চলাচল নিয়ন্ত্রণ করলে মুসলমানদের পবিত্র মাসটি সাধারণত এই মসজিদ কমপ্লেক্স ঘিরে তীব্র উত্তেজনার সৃষ্টি হয়।’
গত তিন বছর রমজান মাসে আল-আকসায় ফিলিস্তিনি ও ইসরাইলি বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে, চরমপন্থী ইহুদি ও ইসরাইলি পুলিশ ঘন ঘন ঘটনাস্থলে অভিযান চালিয়েছে। ২০২১ সালে মসজিদে ইসরাইলি পুলিশের হামলার ফলে দেশজুড়ে ইহুদি-ফিলিস্তিনি সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে এবং গাজায় ১১ দিনের যুদ্ধে রূপ নেয়।
গাজা ও পশ্চিম তীরের যুদ্ধ আরো উত্তপ্ত হয়ে ওঠার এই মোক্ষম সময়ে নেতানিয়াহু যদি ফিলিস্তিনি যুবকদের জন্য আল-আকসা বন্ধ করে দেয় তবে বিশৃঙ্খলা অবশ্যম্ভাবী। তৃণমূল পর্যায়ের জেরুসালেমের পরিচালক বলেন, অধিকৃত পূর্ব জেরুসালেমে বৈষম্যমূলক ও নিপীড়নমূলক নীতির মাধ্যমে ইসরাইল দীর্ঘদিন ধরে জেরুসালেমকে ইহুদিকরণ এবং তার নিরাপত্তা দৃঢ় করার চেষ্টা চালাচ্ছে। এসব বহুমুখী নির্যাতনে ফিলিস্তিনিরা অতিষ্ঠ। তাই ফিলিস্তিনিরা তাদের জাতিগত নিধন নীতিকে এবার চ্যালেঞ্জ করল- আর ছাড় নয়।
রমজান মাসে আল-আকসা মসজিদে নামাজ আদায় করেন লাখ লাখ মুসল্লি। তবে গত পাঁচ মাস ধরে ইসরাইলি বাহিনীর অভিযান এবং ইসরাইলি নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে হামাসসহ সাধারণ ফিলিস্তিনিদের সঙ্ঘাতের কারণে এ বছরের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন।
আল-আকসায় সমস্যাগুলো দুই স্তরে দানা বাঁধে। তরুণ ফিলিস্তিনি যারা ইসরাইলের ভেতর বাস করে এবং যাদের ইসরাইলি পরিচয়পত্র আছে তারা রমজানে পবিত্র আল-আকসায় এবাদত করতে আসে। ইসরাইলি নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে এরা বড় নিরাপত্তার বোঝা হয়ে দাঁড়ায়, তারা কোনো প্রতিরোধের সম্মুখীন হলে ইসরাইলি দখলদার বাহিনীর সাথে ক্রমাগত সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। ইসরাইলের ধারণা, আগে ইট-পাটকেল ছুঁড়লেও গাজা যুদ্ধের পর কোনো বিরোধে আধুনিক অস্ত্র ব্যবহার হবে। দ্বিতীয় স্তরটি পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনি বাসিন্দাদের সাথে, তারা রমজানে দলে দলে আল আকসায় ধাবিত হয়, কোনো বাধা মানে না। ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ সাধারণত শুক্রবার নামাজের জন্য ‘পাস’ দেয়। কিন্তু রমজানে মুসল্লিরা শুক্রবার শনিবার না মেনে সবসময় নারী-পুরুষ সমবেত হবে আল-আকসায়। নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য আল-আকসা নিয়ন্ত্রণ করা সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। নিরাপত্তারক্ষীরা দেখে যাতে কোনো ভিড় না হয়। এবার সেটি নিয়ন্ত্রণ বা উপেক্ষা করা দু’টিই তাদের জন্য কষ্টকর। ইসরাইল রমজান মাসকে ভয় পায়, তাই তারা এই সময় পবিত্র অঙ্গনে গুলি করে মানুষ হত্যা করে এসেছে এতদিন। এখন কি সেই অবস্থায় আছে দেশটি?
ইসরাইলের চরমপন্থী নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেনগভির পবিত্র রমজান মাসে ফিলিস্তিনিদের আল-আকসা মসজিদে প্রবেশে নিয়ন্ত্রণ চান, তার মতে ৭০ বছরের কম বয়সী যেকোনো ফিলিস্তিনিকে নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে আল-আকসা মসজিদে অনুমতি দেয়া উচিত নয়। যদিও মাঠে কর্মরত ইসরাইলি পুলিশ তা প্রত্যাখ্যান করে ৪৫ বছরের কম বয়সীদের কথা বলেছেন। অথচ গত রমজানে সব বয়সের নারী, ১২ বছর পর্যন্ত পুরুষ শিশু এবং ৫৫ বছরের বেশি বয়সী পুরুষদের রমজানের সময় অনুমতি ছাড়াই আল-আকসা মসজিদে প্রবেশের সুযোগ দেয়া হয়েছিল। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, গাজা যুদ্ধের মতো গায়ে পড়ে আরেকটি ফ্রন্ট খুলতে চায় ইসরাইল। এই সিদ্ধান্তে মার্কিন প্রশাসনও বিব্রত। পররাষ্ট্র দফতরের ম্যাথু মিলার বলেন, এবারো রমজানে মুসল্লিদের আল-আকসায় নামাজ পড়তে দেয়া উচিত এটি ইসরাইলের নিরাপত্তার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।
যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তের পর ইসরাইলের ঐতিহ্যবাহী মন্ত্রী আমিচাই এলিয়াহু রমজান মাস নিয়ে আলাদা চিন্তাভাবনা না করার আহ্বান জানান। চরমপন্থী এলিয়াহু বলেছেন, গাজা উপত্যকায় ‘পরমাণু বোমা’ ফেলা একটি ‘বিকল্প’ রয়েছে। নেতানিয়াহুও জানুয়ারি-২৩ সালে তেলআবিবের জনসভায় গাজায় পরমাণু বোমা ফেলার কথা তুলেছিলেন। বর্তমানে নেতানিয়াহু প্রশাসন যেভাবে কথাবার্তা বলছেন তাতে মনে হয় গাজা যুদ্ধের পরিণতি বা ফিলিস্তিনিদের নিশ্চিহ্নকরণে পরমাণু অস্ত্র একটি ‘অপশন’।
ইসরাইলি গণমাধ্যম বলছে, রমজানের আগে গাজায় জিম্মি বিনিময় ও যুদ্ধবিরতির বিষয়ে হামাসের সাথে একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর জন্য তেলআবিবকে চাপ দিচ্ছে মার্কিন প্রশাসন।
এর মধ্যে আবার যোগ হয়েছে আর্জেন্টিনার উৎপাত। ল্যাটিন আমেরিকার বেশির ভাগ দেশ যখন ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন প্রদর্শন করেছে তখন আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রপতি জাভিয়ের মাইলি ইসলামের পবিত্রতম স্থান আল-আকসা মসজিদ ধ্বংস করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘মশিহকে (দাজ্জাল) নিয়ে আসার জন্য, তৃতীয় মন্দির নির্মাণ তাড়াতাড়ি সম্পন্ন করতে হবে। তিনি দীর্ঘদিন ধরে তাওরাত, তালমুদ ও অন্যান্য ইহুদি ধর্মগ্রন্থ অধ্যয়ন করতে জেরুসালেম সফরের স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেটি পূর্ণ হয়েছে। সাংবাদিকদের মাইলি বলেন, ‘আমি ইহুদি নই, তবে আমি ইসরাইলের ভক্ত।’ নির্বাচনী শেষ জনসভায় বলেন, ‘আমি ইহুদি ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার কথা ভাবছি এবং আমি আর্জেন্টিনার ইতিহাসে প্রথম ইহুদি প্রেসিডেন্ট হওয়ার আকাঙ্ক্ষা করছি।’
জেরুসালেম ও আল-আকসা নিয়ে বিগত কয়েক বছর ধরে ‘ধর্মীয় উগ্রবাদ’ চিহ্নিত করে বেশ কিছু আইন ও সংশোধনী প্রণয়ন করা হয়েছে যার ফলে জেরুসালেমের ফিলিস্তিনি অধিবাসীদের, তাদের বাড়িঘর, বসতভিটা, মসজিদ, কবরস্থান এবং তাদের পবিত্র স্থানগুলোর মর্যাদাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। তারা ২০১৫ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে সংঘটিত আক্রমণের উপর ভিত্তি করে ফর্মুলা তৈরি করেছে; ফিলিস্তিনিরাও প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে ২০১৫ সালে নাইফ ইন্তিফাদা ২০১৭ সালে বাব আল-আসবাত বিদ্রোহ, ২০১৯ সালে বাব আল-রাহমা অস্থিরতা এবং ২০২৩ সালে দামেস্ক গেটে প্রতিরোধের ঘটনায়। গাজার নাজুক অবস্থা। ইসরাইলি অভিযানে এ পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ৩০ হাজার ৫৩৪ জন, আহত হয়েছেন আরো ৭১ হাজার ৯৮০ জন ফিলিস্তিনি। যুদ্ধ এখনো তীব্রতর। রমজান শুরুর আগেই ক্ষুধার্থ মানুষগুলো খাবারের অভাবে মরতে বসেছে। অবরোধ ভেঙে জর্দান ও তুরস্ক যে খাবার দিচ্ছে তা অপ্রতুল।
হামাস প্রধান ইসমাইল হানিয়া এক বিবৃতিতে রমজানে আল-আকসায় ঝড় তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি আরব নেতাদের প্রতি এই আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, দখলদার শক্তি আল-আকসা মসজিদে অবরোধ দিয়ে রেখেছে, জেরুসালেম ও পশ্চিম তীরের বাসিন্দাদের ওই অবরোধ ভাঙতে হবে।
নেতানিয়াহু চারিদিক থেকে চাপের কারণে নমনীয় হয়েছেন দেখা যায়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আগের অবস্থান থেকে সরে গিয়ে এবারের রমজানে আল-আকসায় নামাজ আদায়ের অনুমতি দিয়েছে ইসরাইল। বলা হয়েছে, ‘বিগত বছরগুলোতে রমজানের প্রথম সপ্তাহে যত সংখ্যক আল-আকসায় আসতেন, এ বছরও তার কোনো ব্যতিক্রম হবে না।
কিন্তু রমজান মাস শুরু হওয়ার সাথে সাথে রোববার সন্ধ্যায় আল-আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে শত শত মুসল্লিকে প্রবেশে বাধা দিয়েছে ইসরাইলি পুলিশ। কিছু ফিলিস্তিনিকে মারধর করা হয়। কেবল ৪০ বছরের বেশি বয়সী নারী ও পুরুষদের প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়। অন্যদের আল-আকসা প্রাঙ্গণের বাইরে তারাবিহ নামাজের জন্য দাঁড়াতে বলে। এ নিয়ে বিতর্ক হয়। জর্দানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আয়মান সাফাদি সোমবার, ১১ মার্চ, রমজানে প্রথম দিন সতর্ক করে বলেছেন, এমনিতেই গাজা যুদ্ধ চলছে তার উপর এই বিধি-নিষেধ পরিস্থিতিকে ‘বিস্ফোরণের’ দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অবস্থা যেকোনো সময় বিগত রমজানের মতো হতে পারে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব ও গ্রন্থকার
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা