একীভূতকরণের নামে দুর্বল ব্যাংক পুনর্বাসন
- ড. মো: মিজানুর রহমান
- ০৯ মার্চ ২০২৪, ০৬:০৬
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে সংস্কার বা একীভূতকরণ এখন অনেকটাই নিশ্চিত। চলতি বছরের মধ্যেই মার্জিন শুরু হতে পারে। এ সময়ের মধ্যে দুর্বল ব্যাংকগুলো নিজেদের ইচ্ছায় একীভূত না হলে আগামী বছর থেকে চাপ দিয়ে সেটি করা হবে। একীভূতকরণ দোষের নয়; বরং আর্থিক বাজার এবং প্রতিষ্ঠান সংস্কারের একটি চলমান প্রক্রিয়া। সময়ের প্রয়োজনে অর্থাৎ চাহিদা ও জোগানের বিবেচনায় সংস্কারের প্রয়োজন হয়। যুগে যুগে অর্থনীতির অন্যান্য ভিত্তিমূলের মতো ব্যাংকিং খাত তো বটেই, অন্যান্য অ-ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানেও ছোট-বড় সংস্কার হয়েছে। তাই ব্যাংকিং খাতে সংস্কার তথা একীভূতকরণ অথবা অধিগ্রহণের যে বিষয়টি আলোচনা হচ্ছে, তা নতুন কিছু নয়।
বাংলাদেশে বর্তমানে ৬১টি বাণিজ্যিক ব্যাংক আছে। এর মধ্যে প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় প্রজন্মের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো নিয়মমাফিক লাইসেন্স পেয়েছে। চতুর্থ প্রজন্মের ১৩টি ব্যাংক রাজনৈতিক বিবেচনায় লাইসেন্স পেয়েছে বলে তখনকার অর্থমন্ত্রীর ভাষ্য ছিল। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বাণিজ্যিক ব্যাংক নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান। তবে, বিশ্বে ব্যাংকিং খাতের মন্দঋণ বা কুঋণের হার ১০ শতাংশের কম হলেও বাংলাদেশে তা ১১ শতাংশের মতো। উল্লেখ্য, সারা বিশ্বে মন্দঋণের স্ট্যান্ডার্ড হার ২ শতাংশ।
ব্যাংক একীভূতকরণের প্রসঙ্গ কেন এলো
বাংলাদেশে বড় অঙ্কের মন্দঋণ ব্যাংকিং সেক্টরের সবচেয়ে বড় অদক্ষতা হিসেবে সামনে আসে। মন্দঋণের অনেক কারণ। তবে বাংলাদেশে অদক্ষ ব্যবস্থাপনা বা নৈতিক বিপর্যয়ই প্রধান কারণ। হলমার্ক কেলেঙ্কারি, বেসিক ব্যাংকের দুর্নীতি, জনতা ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতি এবং হালের ইসলামী ব্যাংকের মন্দঋণ ইস্যু এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এসব ক্ষেত্রেই ঋণ জালিয়াতির সাথে ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারী, মালিকপক্ষ এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব কেলেঙ্কারির তেমন বিচার তো হয়ইনি; বরং সরকারি ব্যাংকগুলো রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে নতুন মূলধন সহায়তা পেয়েছিল। এই সহায়তা না পেলে জনগণের আমানতের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়ে ওই সব ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যেতে পারত। যেহেতু রাষ্ট্রীয় মালিকানার ব্যাংক, তাই রাষ্ট্র ওই ব্যর্থতার দায় এড়াতে পারত না। তবে মূলধন জোগানের পাশাপাশি সরকারের উচিত ছিল দক্ষ ব্যবস্থাপনা, রাজনীতি ও পেশিশক্তির অপব্যবহার রোধ ও আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করা। বেসরকারি মালিকানার ব্যাংকগুলোর ব্যর্থতার দায় কে নেবে, সেটি একটি মৌলিক প্রশ্ন। বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে বিদেশী ব্যাংকগুলো তুলনামূলকভাবে ভালো ব্যবসায় করছে। তাহলে দেশীয় মালিকানার বেসরকারি ব্যাংকগুলো ঠিক কী কারণে উচ্চ কুঋণ ঝুঁকিতে পড়ল?
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বেসেল চুক্তির অন্যতম স্বাক্ষরকারী। অথচ বেসেল-৩ মান অনুযায়ী, বাংলাদেশের অনেক বাণিজ্যিক ব্যাংকই তাদের পর্যাপ্ত মূলধন ১২ দশমিক ৫ শতাংশ রাখতে সক্ষম হয়নি। করোনা মহামারীকালে ব্যাংকিং খাতে প্রণোদনা, মহামারী শেষে ঋণ অবলোপনের হিসাবের মারপ্যাঁচে এসব ব্যাংকের কুঋণের হার কম দেখানো হয়েছে। সাথে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে মালিকপক্ষের নামে-বেনামে ঋণ এবং তা ফেরত না দেয়ার বিষয়টি ব্যাংকের প্রতি জন-অনাস্থার কারণ হিসেবে দেখা যায়।
ব্যাংক একীভূতকরণ অনেক দেশেই হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রেও ব্যাংকের সংখ্যা ক্রমহ্রাসমান। ভারতে ২০১৭ সালের আগে রাষ্ট্রীয় ব্যাংক ছিল ১৭টি। এগুলো পরে ১০টি ব্যাংকে একীভূত হয়। মূলত ব্যাংকিং খাতে একীভূতকরণের কারণ হতে পারে অসম প্রতিযোগিতা। বৃহৎ ব্যাংকের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারলে অপেক্ষাকৃত ছোট ব্যাংক বড় ব্যাংকের সাথে একীভূত হয়ে থাকে। অর্থনীতির অভিধায় অসম প্রতিযোগিতা নিরূপণের সূত্রও রয়েছে।
ব্যাংক একীভূতকরণের লাভ-ক্ষতি
একীভূত অথবা অধিগ্রহণের নির্দেশনা ও এর বাস্তবায়নে আমানতকারী এবং দ্বিতীয়ত একীভূত করা ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আতঙ্কিত হতে পারে। আমানতকারীদের ভয় থাকবে জমাকৃত আমানতের সুরক্ষা। তবে সে দায় একীভূত নীতিমালায় সুস্পষ্ট উল্লেখ থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে অনৈতিক চাপ এবং রাজনৈতিক হিংসা-প্রতিহিংসা অবশ্যই পরিত্যাগ করতে হবে। একীভূতকরণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে মালিকপক্ষের দাবি-দাওয়া, কারণ এর মাধ্যমে মালিকপক্ষ দায়মুক্তি চাইতে পারে। আবার তাদের মূলধন শেয়ারের বিপরীতে বাজারমূল্যের চেয়ে উচ্চমূল্যও দাবি করতে পারে। শেয়ারমূল্য মূল্যায়নের যথার্থ পদ্ধতি অনুসরণ না করলে মালিকপক্ষ লাভবান হতে পারে। সে ক্ষেত্রে প্রভাবশালীদের অনেকেই মালিকপক্ষের সহযোগীর ভূমিকা পালন করতে পারে। শুধু ব্যাংক একীভূতকরণই তাই সমস্যার সমাধান নয়, কার স্বার্থে এবং কোন শর্তে করা হচ্ছে, সেটি বিবেচনায় রাখতে হবে।
একীভূতকরণে এখন পর্যন্ত পরিষ্কার কোনো সিদ্ধান্ত না এলেও সবলের সাথে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত করা হবে বলে নীতিগত সিদ্ধান্তের কথা শোনা যায়। প্রাথমিকভাবে ১৫ থেকে ১৬টি সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক একীভূত করা হতে পারে বলে। ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সূত্রমতে, দেশের কয়েকটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক একে অন্যের সাথে একীভূত হওয়ার বিষয়ে উচ্চপর্যায়ে আলোচনা হয়েছে। বর্তমানে দেশে শরিয়াহভিত্তিক পূর্ণাঙ্গ ধারার ব্যাংকের সংখ্যা ১০টি থেকে আগামী এক-দুই বছরে পাঁচ-ছয়টিতে নেমে আসতে পারে। এর মানদণ্ড নির্ধারণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ইতোমধ্যে ‘প্রম্পট কারেক্টিভ অ্যাকশন (পিসিএ)’ নামে একটি ফ্রেমওয়ার্ক দেয়া হয়েছে। খেলাপি ঋণ, তারল্য, মূলধন ও সুশাসন এ চার মানদণ্ডের ভিত্তিতে আগামী বছর মার্চের মধ্যে র্যাংকিং হবে। এরপর থেকেই একীভূতকরণ শুরু হবে। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ইতোমধ্যে সব ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীকে পিসিএ বাস্তবায়ন কমিটি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের মতে, একীভূতকরণ প্রক্রিয়াটি পর্ষদের সাথে নয়; বরং ব্যালান্সশিটের সাথে ব্যালান্সশিট একীভূত হবে। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ইতোমধ্যে রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়েছে যার প্রধান লক্ষ্য- ২০২৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে খেলাপি ঋণের হার ৮ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা। খেলাপি ঋণ অবলোপন, অবলোপনকৃত ঋণ আদায় জোরদার, বেসরকারি খাতে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠন, ঋণখেলাপিদের আর ছাড় না দেয়ার পরিকল্পনা, খেলাপির মেয়াদ গণনায় আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের চর্চার কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার সর্বোচ্চ ১০ ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে। পাশাপাশি ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিতের মাধ্যমে সীমার বাইরে দেয়া ঋণ, বেনামী স্বার্থসংশ্লিষ্ট ঋণ এবং প্রতারণার মাধ্যমে দেয়া ঋণ বিতরণের পরিমাণ শূন্যে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে।
রোডম্যাপে বলা হয়, ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ, তাদের সম্মানী নির্ধারণ এবং দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কিত নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে। উপযুক্ত স্বতন্ত্র পরিচালক নিযুক্ত হলে আমানতকারী ও শেয়ারধারীদের স্বার্থ সংরক্ষণ হবে। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নিয়োগ ও পুনঃনিয়োগের বাছাইপ্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনা হয়েছে, যা আগামীতে কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হবে। কর্ম মূল্যায়নের মাধ্যমে দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী হিসেবে নিয়োগ পাবেন। করপোরেট সুশাসন নিশ্চিত করতে ব্যাংকের শেয়ারধারী পরিচালকদের যোগ্যতা ও দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কিত নীতিমালা সংশোধন করা হবে বলে কর্মপরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়।
একীভূতকরণের জন্য দুর্বল ব্যাংকের খারাপ সম্পদ (ঋণ) কিনে নেবে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি (এএমসি)। ফলে একীভূত হওয়ার কারণে ভালো ব্যাংকগুলোর খারাপ হয়ে পড়ার আশঙ্কা নেই। তবে দুর্বল ব্যাংকগুলোর পরিচালকরা ভালো ব্যাংকের পরিচালক হওয়ার যোগ্যতা হারাবেন। শুধু দুর্বল ব্যাংককে সবল ব্যাংকের সাথে নয়, দুই সবল ব্যাংক আরো শক্তিশালী হতে একীভূত হতে পারে।
ব্যাংকাররাও মনে করেন, একটি ভালো ব্যাংক খারাপ ব্যাংকের সাথে যুক্ত হলে সমস্যার সমাধান সম্ভব। ব্যাংক হলো ইকোনমির হার্ট সুতরাং সেটি রান না করলে দেশ চলবে না। খারাপ ব্যাংকের হয়তো ওভারঅল সিস্টেম ভালো নয়। সেখানে একটি ভালো ব্যাংক গিয়ে ওর দুর্বল জায়গাগুলোকে চিহ্নিত করে সার্বিক পারফরম্যান্স ইমপ্রুভ করতে পারে।
ব্যাংকিং খাতে দীর্ঘদিন ধরেই অব্যবস্থাপনা-অনিয়ম চলছে। ব্যাংকিং খাতের দুর্নীতির প্রভাব পুরো অর্থনীতিতে পড়েছে। এসব সংস্কারে ব্যাংকিং খাতের নিয়ন্ত্রক কেন্দ্রীয় ব্যাংককে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে।
রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করে ব্যাংক খাতে দ্রুত সুশাসন ফেরাতে চায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সুশাসন ফেরাতে গভর্নর কাউকে ছাড় না দেয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। ব্যাংকের সুশাসন ফেরাতে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি কমিটি গঠন করেছে। তারা একটি কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা বলেছে। খেলাপিদের ধরতে কোনো রাজনৈতিক পরিচয় বিবেচনা করা হবে না বলেছে। মামলায় আটকে থাকা অর্থ আদায়ে অভিজ্ঞ আইনজীবী নিয়োগের পরামর্শ দিয়েছে।
পরিশেষে বলতে হয়, দেশের অর্থনীতির সব সেক্টরে বেহাল দশা। এর কারণ দুর্নীতি ও রাজনীতিকরণ। এই সত্যটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বীকার করে বলেছে, ব্যাংকিং সেক্টর রক্ষায় ব্যাংক একীভূতকরণ করা হবে রাজনীতিমুক্তভাবেই। সত্যিই যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেটি করতে পারে তাহলে দেশের অর্থনীতি রক্ষা পাবে। তবে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সেটি কতটা সম্ভব হয় তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট
ইমেইল : [email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা