২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
দেশ জাতি রাষ্ট্র

উপজেলা নির্বাচন : আওয়ামী সুবিধার ব্যাসার্ধ

উপজেলা নির্বাচন : আওয়ামী সুবিধার ব্যাসার্ধ - নয়া দিগন্ত

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আলেক্সি ডি টকভিলের কথাটি এরকম, ‘একটি জাতি একটি স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে। কিন্তু স্বাধীনতার স্বাদ উপলব্ধি করার জন্য অবশ্যই তাকে স্থানীয় সরকারে একীভূত হতে হবে।’ স্থানীয় সরকার মানে সরকারের মধ্যে সরকার। কেউ কেউ বলেছেন, উপসরকার। কেউ বা বলেছেন, তৃণমূল সরকার। আসলে সরকার বা শাসনব্যবস্থার সুখ অনুভব করতে হলে স্থানীয় পর্যায় ছাড়া উপায় নেই। তাই উন্নত বিশ্বে যাবতীয় ব্যবস্থাপনা স্থানীয় সরকারনির্ভর। পৃথিবীর আদিমতম সরকারব্যবস্থা শুরু হয়েছিল স্থানীয়ভাবে। হাজার হাজার বছর আগে যখন মানবসভ্যতার সূচনা তখন ছোট ছিল মানুষের বসতি। সেখানকার নেতা ছিল গোত্রপ্রধান। ঠিক আমাদের ইউনিয়ন কাউন্সিলের ছোট কাঠামোর সাথে সেই স্থানীয় সরকারের বেশ মিল আছে। পৃথিবীর মানুষ যতই এগিয়েছে, ততই সমৃদ্ধ হয়েছে এর ব্যবস্থাপনা। রাষ্ট্র থেকে রাজ্য, রাজ্য থেকে জেলা, জেলা থেকে উপজেলা, উপজেলা থেকে ইউনিয়ন পরিষদ- এভাবে বিস্তৃত হয়েছে শাসনকাঠামো। আমাদের মতো দেশে অনেক ইতিহাস ভূগোল পেরিয়ে স্থানীয় সরকার নানাভাবে আবর্তিত বিবর্তিত হয়েছে।

স্বাধীনতার পরেও এর পরিবর্তন হয়েছে বারবার। এই পরিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় ১৯৮২ সালের ২৩ ডিসেম্বর ‘স্থানীয় সরকার অধ্যাদেশ-১৯৮২’ জারি হয়। এই অধ্যাদেশটি থানা পরিষদ ও থানা প্রশাসন পুনর্গঠনের নিমিত্তে জারি করা হয়। একই বছরের ৭ নভেম্বর থেকে এটি কার্যকর হয়। পরবর্তী পর্যায়ে এটি উপজেলা পরিষদ নামে অভিহিত হতে থাকে। উপজেলা পরিষদ ছিল সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের কীর্তি। পৃথিবীর সব দেশেই সামরিক শাসকরা কিছু কিছু ভালো কাজ করেন। তবে সাধারণ মানুষ তাদের স্বাভাবিক শাসক মনে করে না। এরশাদের প্রতি বিরূপ মনোভাবের কারণে ১৯৯২ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত এই পরিষদ বিলুপ্ত ছিল। আওয়ামী লীগ সরকার এরশাদের সাথে সখ্যে বা শর্তের কারণে ১৯৯৮ সালে নতুন আইন করে ২০০৯ সালে উপজেলা পরিষদ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। লোকে বলে এরশাদের সাথে জোট করার দুটো শর্ত ছিল। একটি হলো রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাতিল না করা। অন্যটি উপজেলা ব্যবস্থার পুনর্বহাল। উপজেলা ব্যবস্থাটি এর নিজগুণেই টিকে গেল। রাজধানী থেকে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত বিস্তৃত স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় জেলা পরিষদ রয়েছে বটে তবে এর কার্যকারিতা নগণ্য। সে অর্থে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়েও উপজেলা পরিষদ মাঝামাঝি হবার কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

আগে এটি ছিল প্রশাসননির্ভর। পরবর্তীকালে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার বিধান হওয়ায় জনপ্রতিনিধিত্বের সুযোগ সৃষ্টি হয়। স্থানীয় সরকারব্যবস্থা হিসেবে একক ও স্বকীয় থাকলে এটি আরো ভালো করতে পারত। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের দলীয়করণের সর্বাত্মক ব্যবস্থার কবলে এটিও দলীয় প্রভাবাধীনে চলে যায়। উপজেলা পরিষদ আইন ১৯৯৮ এর ধারা ২৫(১) বলে প্রতিজন জাতীয় সংসদ সদস্য তাঁর নির্বাচনী এলাকার উপজেলা পরিষদের উপদেষ্টা। পৃথিবীর কোথাও কোনো আইন বা বিধিতে উপদেষ্টার পরামর্শ গ্রহণ বাধ্যতামূলক হওয়ার কোনো নজির নেই। কিন্তু বাংলাদেশের উপজেলা পরিষদের তা বাধ্যতামূলক। এ নিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান ও স্থানীয় এমপির ঝগড়া বিবাদ লেগেই আছে। অন্যদিকে উপজেলা আইন অনুযায়ী চেয়ারম্যান এর সার্বিক প্রধান হলেও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কার্যত সব ক্ষমতা প্রয়োগ করে। উপজেলা চেয়ারম্যান সমিতির পক্ষ থেকে এ নিয়ে হাইকোর্টে মামলা হয়েছিল। রায় এসেছিল তাদের পক্ষে। কিন্তু সদাশয় আওয়ামী সরকারের ইশারায় এর কার্যকারিতা চেম্বার জজের আদেশে স্থগিত হয়ে যায় বলে অভিযোগ আছে। যা হোক এই সীমিত ক্ষমতা ও দায়িত্ব সত্ত্বেও উপজেলা নির্বাচন নিয়ে সারাদেশে প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও দলীয়করণের শেষ নেই। ৭ জানুয়ারির তথাকথিত জাতীয় নির্বাচনের পরে উপজেলা নির্বাচনের তোড়জোড় শুরু হয়েছে।

এদেশে অনেককাল আগে থেকে উপজেলা নির্বাচনের মতো স্থানীয় নির্বাচন ছিল দলনিরপেক্ষ। যেকোনো ব্যক্তি নিঃসঙ্কোচে এ ধরনের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারত। জাতীয় রাজনীতির ডামাডোল সেখানে ছিল অনুপস্থিত। কিন্তু ২০০৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগ যেমন সব কিছুকে দলীয়করণ করেছে, সেভাবেই স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে দখল করেছে। ২০১৫ সালে প্রণীত আইনবলে তারা স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও দলীয় প্রতীক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে দেয়। দেশের এ বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা এর বিরোধিতা করেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের কাছে প্রথা, ঐতিহ্য ও রীতি-রেওয়াজ গুরুত্বপূর্ণ নয়। ক্ষমতা এবং শুধু ক্ষমতাই তাদের বিবেচ্য। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সিটি করপোরেশন পর্যন্ত তারা ক্ষমতা সংহতকরণের উপায় হিসেবে স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে আওয়ামী লীগের অঙ্গ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে। তার ফলে কবিগুরুর ‘ছায়া সুনিবিড়, শান্তির নীড়, ছোট ছোট গ্রামগুলো’ হয়ে উঠেছে বড় বড় ঝগড়াঝাঁটি ও মামলা মোকদ্দমার কেন্দ্রবিন্দু। কথিত ‘ভিলেজ পলিটিক্সে’ পরিণত হয়েছে ন্যাশনাল পলিটিক্স। যেখানে উঁচু থেকে নিচের মানুষেরা শিখবে কিছু, সেখানে ভিলেজ পলিটিক্সের হামলা, মামলা ও কারসাজিতে জাতীয় রাজনীতি হয়েছে কলুষিত। যা হোক, একতরফা নির্বাচনের পরে উপজেলা নির্বাচনের আগাম ঘোষণা দিচ্ছে নির্বাচন কমিশন। বলা হচ্ছে, রমজান মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পর এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

আগের মতোই উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ তার রণকৌশল নির্ণয় করছে। জাতীয় নির্বাচনে যেহেতু ডামি প্রার্থী দিয়ে তারা নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক দেখিয়েছে খানিকটা, উপজেলা নির্বাচনেও তারা একই কৌশল অবলম্বনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ উপজেলা পর্যায়ে দলীয়ভাবে প্রার্থী না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নির্বাচন কমিশনের বশংবদ কর্মকর্তারা এবং আওয়ামী কুশলী বুদ্ধিজীবীরা তাদেরকে এমন পরামর্শ দিয়েছে বলে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে। তাদের মতে, মেয়র বা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও সংরক্ষিত নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী উন্মুক্ত রাখা হলে একই দলের অনেকেই প্রার্থী হতে উৎসাহিত হবে। তারা আরও মনে করেন, বিএনপিসহ যেসব দল নির্বাচন বর্জন করছে সেসব দলের অনেকেই নির্বাচনে অংশ নেয়ার সম্ভাবনা দেখা দেবে। শুধু তাই নয়, সিভিল সোসাইটির যোগ্য, দলনিরপেক্ষ ব্যক্তিবর্গেরও নির্বাচনে অংশ নেয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। বেশি সংখ্যক প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে ভোটার উপস্থিতি বাড়বে। বিগত ১৭ বছরে এসব নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হওয়ার কারণে ভোটার উপস্থিতি ছিল নিতান্তই কম। আওয়ামী নির্বাচন কৌশল অনুযায়ী নৌকা প্রার্থী মানেই নিশ্চিত বিজয়। জনগণ বিশ্বাস করেছে যে, ছলে বলে কলে কৌশলে যেভাবেই হোক তারা নৌকার প্রার্থীকে জয় করাবে। এজন্য তাদের অংশগ্রহণের বা ভোট দেয়ার কোনো আগ্রহ ছিল না। এখন যখন নৌকা প্রতীক ব্যতীত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে, তখন আশা করা যায় যে, আগের নির্বাচনগুলোর চেয়ে এই নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে। তবে ২০১৫ সালে প্রণীত আইন অনুযায়ী স্থানীয় প্রার্থীদের অবশ্যই দলীয় প্রতীক ব্যবহার করতে হবে। সেখানে কতিপয় বিধিনিষেধ সাপেক্ষে স্বতন্ত্র প্রতিযোগিতার সুযোগও ছিল। এখন সেই আইন আর আওয়ামী ঘোষণার মধ্যে বৈপরীত্য দেখছেন বিশেষজ্ঞগণ। তারা বলছেন, বিদ্যমান আইন সংশোধন না করে বা বাতিল না করে নির্বাচন আইনগতভাবে বৈধ হতে পারে না। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রতীক না দেওয়া হলেও আইনের ব্যত্যয় হবে না বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো: তাজুল ইসলাম। তিনি আরো বলেন, আইন সংশোধনের কোনো প্রয়োজন নেই। দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করা যাবে, দলীয় প্রতীক ছাড়াও নির্বাচন করা যাবে। আওয়ামী লীগ যদি মনে করে সেখানে দলীয়ভাবে মনোনয়ন দেবে, তাহলে সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আবার দল মনে করে, না আমরা এভাবে দলীয় মনোনয়ন কাউকে দেবো না, আবার কোথাও কোথাও দেবো, আবার কোথাও দেবো না- দল থেকে সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ আছে। তার মানে হচ্ছে, এই আইন বা আইনের শাসন বলতে কিছু নেই। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকগণ আওয়ামী লীগের এই ব্যাখ্যাকে অনৈতিক, বিভ্রান্তিকর ও অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেছেন। তারা চাইলেই সব সুবিধার মালিক হতে পারেন না। দেশে যদি আইনের শাসনের ন্যূনতম মর্যাদাও থাকে, তাহলে মন্ত্রী এ কথা বলতে পারেন না।

আওয়ামী লীগের নেতারা এখন বলছেন, আইন সংশোধন না করেও আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া যাবে। সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মনোনয়ন না দিলে তাদের নেতাকর্মীরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নিতে পারবেন। নিবন্ধিত অন্য রাজনৈতিক দল মনোনয়ন দিলে সে ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক বাধাগ্রস্ত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে আওয়ামী সর্বাত্মক দলীয়করণের কারণে অন্য দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে এরকম মনে হয় না। আর প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ভোটে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল রয়েছে। তাই আসন্ন উপজেলা নির্বাচন বা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কোনো সুযোগ নেই। দলটি এখন সরকার পদত্যাগের একদফা আন্দোলনে রয়েছে। গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য বিএনপি ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো মুখিয়ে আছে। সেক্ষেত্রে সরকারের পরিবর্তন ঘটাবে না, এমন কোনো নির্বাচনে দলীয়ভাবে বিরোধীরা অংশগ্রহণ করবে না। বিরোধীদের অনেকেই উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চাইবে। স্বতন্ত্রভাবে যদি কেউ তখন নির্বাচন করে তাদের প্রতি রাজনৈতিক দলগুলো কী দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করবে তা স্পষ্ট নয়।

জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধিত নয়। তাই তাদের প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করার কোনো সুযোগ নেই। চরমোনাই সাহেবের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন এর আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। জামায়াত এবং ইসলামী আন্দোলন আদর্শিক দল হওয়ার কারণে আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণের সম্ভাবনা থাকবে। তবে সময় ও সুযোগ বাস্তব কথা বলবে। সবকিছু বিবেচনায় অবশেষে বলা যায়, উপজেলা নির্বাচন ও অন্যান্য স্থানীয় নির্বাচনগুলো যদি নৌকা প্রতীকে না হয়ে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতায় হয় তা ভবিষ্যতের মঙ্গলবাহী বা মন্দের ভালো হবে।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে বিকৃত ও বিকলাঙ্গ বলে উপহাস করেছেন। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সিটি করপোরেশন পর্যন্ত প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন করতে পারলে ব্যবস্থাটি তৃণমূল জনগণের উপকারে আসবে। তার আগে অতি অবশ্যই এমন একটি জাতীয় সরকার ক্ষমতাপ্রাপ্ত হতে হবে যারা শুধু ক্ষমতাকে নয়, দেশ ও জনগণকে ভালোবাসবে। বর্তমান আওয়ামী সরকারের মতো যখন যেমন তখন তেমন অর্থাৎ ক্ষমতার জন্য সুবিধাজনক ব্যাসার্ধ নেবে না।

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement