২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

শিনজো অ্যাবের অ্যাবেতত্ত্ব

শিনজো অ্যাবের অ্যাবেতত্ত্ব - নয়া দিগন্ত

জাপানে সবচেয়ে বেশি দিন প্রধানমন্ত্রী পদে থাকা শিনজো অ্যাবের (১৯৫৪-২০২২) মর্মান্তিক মৃত্যু আধুনিক জাপানের আর্থসামাজিক রাজনৈতিক মূল্যবোধের মধ্যে ক্ষরণ, অন্তসারশূন্যতা ও গভীর হতাশার সুর প্রতিধ্বনিত হয়েছে। তার আততায়ী ৪১ বছর বয়সী অবসরপ্রাপ্ত নৌ-সেনাসদস্য তেতসুইয়া ইয়ামাগামি যে দূরত্বে থেকে তাকে লক্ষ্যভেদী গুলি চালাতে সক্ষম হয়েছিলেন, পরবর্তীকালে জেরার সময় সে যতই বেসামাল কথা বলুক না কেন; অ্যাবে হত্যাকাণ্ডের সূত্র অনেক গভীরে প্রোথিত এবং একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা প্রদানে নাজুক পরিস্থিতির পরিচায়ক। তার মৃত্যুর কারণ উদ্ধারে এটি অবশ্যই বিশ্লেষণের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে টোকিওর সম্পর্ককে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া শিনজো অ্যাবে ক্ষমতায় থাকাকালে দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী করার পাশাপাশি জাপানকে আবারো বিশ্ব শক্তিতে পরিণত করার পথে অনেকটা অগ্রসর হয়েছিলেন।

সাকুরা ও সামুরাইয়ের দেশ জাপানে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ও অস্থিরতা, অসহিষ্ণুতা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে যে মাত্রায় ছিল তার অনির্বচনীয় পরিসমাপ্তি ঘটে দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধে পরাজয়-উত্তর পরিবেশে। যুদ্ধংদেহী মনোভাব, রাজনৈতিক অর্থনীতিতে সিন্ডিকেটেড সংস্কৃতি সবই বড় ধরনের পরিবর্তনের মধ্যে পড়ে বিগত সাত দশকের জাপানে। ১৯৭৭ সালে আন্ডার গ্রাউন্ডেড জাপানি রেড আর্মিদের দ্বারা যাত্রীবাহী বিমান ছিনতাই, যার সমাধান-সমাপ্তি ঘটেছিল ঢাকায়, তার প্রায় দুই দশক পর ১৯৯৫ সালের ২০ মার্চ পাতাল রেলে সোকোহারার সারিন গ্যাস আক্রমণ এবং তারও প্রায় তিন দশকের মাথায় একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যার ঘটনা শান্ত সমাহিত জাপানের রাজনৈতিক ইতিহাসে ‘অব্যক্ত বেদনার’ বহিঃপ্রকাশ। সব কিছু ছাপিয়ে এর বড় কারণ গণঅসন্তোষ, ইন্ধন ইতিহাস বিকৃতির এবং আত্মম্ভরিতার বিকৃত বিকাশ। ১৯৬৮ সালে সাহিত্যে প্রথম জাপানি নোবেল বিজয়ী ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা (১৮৯৯-১৯৭২) তার নোবেল বক্তৃতার শিরোনাম দিয়েছিলেন ‘জাপান দ্য বিউটিফুল অ্যান্ড মাইসেলফ’, ১৯৯৪ সালে সাহিত্যে দ্বিতীয় জাপানি নোবেলবিজয়ী কেনজাবুরে ওয়ে (১৯৩৫-) তার নোবেল বক্তৃতার শিরোনাম দিয়েছিলেন ‘জাপান দ্য এমবিগুয়াজ অ্যান্ড মাইসেলফ’। এখানে নিহিত সাকুরা আর সামুরাইয়ের জাপানের আত্মশক্তির স্বরূপ এবং শিনজো অ্যাবের মর্মান্তিক মৃত্যুর অন্তর্নিহিত রহস্য।
জাপানে বন্দুক সহিংসতা বিরল হলেও অ্যাবের ওপর এই গুলির ঘটনা দেশটিকে আবার বদলে দেবে বলে নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের অনুমান অমূলক মনে হয় না। রবীন্দ্রনাথ ১৯১৬ সালে তার প্রথম জাপান যাত্রাকালে টোকিওতে যে নাগরিক সংবর্ধনা পেয়েছিলেন যেখানে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলররা অংশ নিয়েছিলেন, সেই যাত্রার তিন মাসের মাথায় ফিরে আসার দিন নৌবন্দরের ঘাটে তাকে আতিথেয়তা দানকারী হারা সান ছাড়া আর কেউ হাজির হননি। কারণ এশীয় দেশ চীনাদের ওপর অপর এশীয় জাতি জাপানিদের অসদাচরণের বাড়াবাড়ির সমালোচনা করে জাপানে বসে বক্তব্য দিয়েছিলেন সাহিত্যে এশিয়ায় প্রথম নোবেলবিজয়ী রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১-১৯৪১)।

কোবে স্টিল কোম্পানির একসময়ের কর্মকর্তা অ্যাবে বাবার মৃত্যুর পর ১৯৯৩ সালে প্রথমবারের মতো এলডিপির টিকিটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৫ সালে মন্ত্রিসভার সদস্য হন যখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুনিচিরো কোইজুমি তাকে প্রধান কেবিনেট সচিব পদে নিয়োগ দেন। পরের বছর অর্থাৎ ২০০৬ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানের সবচেয়ে কম বয়সী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে চমকে দিয়েছিলেন অ্যাবে। কিন্তু ক্ষমতা নেয়ার পরপর বিপুল সংখ্যায় পেনশন রেকর্ড নষ্ট হয়ে যাওয়ার মতো বেশ কিছু স্পর্শকাতর কেলেঙ্কারির মধ্যে পড়ে যায় তার সরকার। এর জেরে ২০০৭ সালের জুলাইয়ে পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষের নির্বাচনে বড় ধরনের পরাজয় হয় ক্ষমতাসীন এলডিপির। সেপ্টেম্বরে ‘আলসারেটিভ কলিটিস’ রোগে আক্রান্ত হওয়ার কথা জানিয়ে পদত্যাগ করেন তিনি।
২০১১ সালের সুনামি ও ভূমিকম্পের ধ্বংসযজ্ঞে জাপানে প্রায় ২০ হাজার মানুষ মারা যায়। সে সময় ফুকুশিমা পারমাণবিক কেন্দ্রে দুর্ঘটনায় দেশটি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ধাক্কা গিয়ে পড়ে অর্থনীতিতে। কিছু দিন পর ক্ষমতায় এসে সেই সঙ্কট সামলে ছিলেন শিনজো অ্যাবে।

২০১২ সালের ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে অ্যাবের দল জয়ী হওয়ার পর আবারো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পান তিনি। দুই বছরের মাথায় ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে ‘অ্যাবেনোমিক্স’ বা ‘অ্যাবেতত্ত্ব’ দেশটির অর্থনীতিকে আরো বেশি চাঙ্গা করবে বলে ফের দ্বিতীয় মেয়াদে তিনি ক্ষমতায় আসেন। সুদের হার কমিয়ে দিয়ে সাধারণ ভোক্তাদের এবং কোম্পানিগুলোকে সস্তায় ঋণ নেয়ার সুবিধা করে দেয়া হয়। সরকার নিজে বিভিন্ন অবকাঠামো তৈরিতে ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছিল। ব্যবসায় কর ছাড় দেয়া হয়। শ্রমবাজারে বিভিন্ন সংস্কার এনে অ্যাবে নারীদের চাকরির সুবিধা বাড়িয়ে দেন। সেই সাথে, বিদেশী শ্রমিক নিয়োগপ্রক্রিয়া সহজ করে দেন। এসবের লক্ষ্য ছিল- উৎপাদন এবং ক্রয়ক্ষমতা বেড়ে অর্থনীতিতে যেন প্রবৃদ্ধি ফিরে আসে। কিন্তু ২০২০ সালে জাপান আবারো মন্দার কবলে পড়ে। ফলে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে অ্যাবের অর্থনৈতিক নীতি আসলে কতটা টেকসই। কোভিড মহামারী সামলানোর ক্ষেত্রেও সরকারের ভূমিকা নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন ওঠে এবং তার জনপ্রিয়তা বেশ কমে যায়। সমালোচনা শুরু হয়, অভ্যন্তরীণ পর্যটন বাড়াতে গিয়ে সংক্রমণ ছড়িয়ে দেয়ার। নারীদের শ্রমবাজারে নিয়ে আসা বা স্বজনপ্রীতি কমাতে যেসব ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল তাতে তেমন কাজ হয়নি।

উত্তর কোরিয়ার ক্রমাগত আগ্রাসী ভাব, দেশের অর্থনীতিতে ধস, মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট নিয়ে জনগণের অসন্তোষে অ্যাবের জনপ্রিয়তা নিম্নমুখী হয়ে পড়লে ২০১৭ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর তিনি নতুন নির্বাচনের ঘোষণা দেন এবং আবারো বিপুল ভোটে জয়লাভ করে ক্ষমতায় ফেরেন।

শিনজো অ্যাবে তার স্বাক্ষরিত অর্থনৈতিক কৌশলের মাধ্যমে জাপানের অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে চেয়েছিলেন যার নাম ‘অ্যাবেনোমিক্স’। অ্যাবের অর্থনৈতিক উত্তরাধিকার এই নামকরণ কৌশল দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা হয়। প্রখর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও স্বচ্ছ ভাবমর্যাদা, বিশ্বকে জাপানের ‘জাত’ চিনিয়েছিলেন অ্যাবে।

‘অ্যাবেনোমিক্স’-এর অধীনে, ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে সম্পদের বুদবুদ ভেঙে যাওয়ার পরে দুই দশকেরও বেশি স্থবিরতার পরে জাপানের অর্থনীতিকে শিনজো অ্যাবে আবার প্রাণে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। অ্যাবের কৌশলটির তিনটি ‘তীর’ ছিল যার লক্ষ্য ছিল ১. অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শুরু করা এবং উচ্চ মজুরি : ২. শিথিল আর্থিক নীতি, রাজস্ব উদ্দীপনা এবং ৩. কাঠামোগত অর্থনৈতিক সংস্কার। প্রথম দু’টি ‘তীরের’ অধীনে, অ্যাবে নতুন অবকাঠামো এবং নগদ হ্যান্ডআউটগুলোতে কয়েক বিলিয়ন ডলার ব্যয়ের পাশাপাশি অতি নিম্ন সুদের হার এবং পরিমাণগত সহজীকরণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
অ্যাবেনোমিক্সের সংস্কার পরিকল্পনার আরো লক্ষ্য ছিল লাল ফিতা এবং করপোরেট কর কমিয়ে উৎপাদনশীলতা বাড়ানো, সেই সাথে আরো বেশি নারী, প্রবীণ এবং অভিবাসীদের অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করার মাধ্যমে দেশের দ্রুত বার্ধক্যজনিত কর্মশক্তিকে প্রসারিত করা। ‘আমাদের বর্তমান নিয়ে চিন্তা না করে ভবিষ্যতের দিকে তাকানো উচিত,’ অ্যাবে তার অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির রূপরেখা দিতে গিয়ে ২০১৬ সালের বক্তৃতায় বলেছিলেন। ‘জাপান হয়তো বার্ধক্যে উপনীত হচ্ছে। জাপান হয়তো তার জনসংখ্যা হারাচ্ছে। কিন্তু, এগুলো আমাদের জন্য প্রণোদনা।’

কয়েক দশক ধরে সামরিক খাতে ব্যয়ের ক্ষেত্রে জাপানের মুখচোরা ভাবেরও অবসান ঘটেছিল আবের হাত ধরে। তিনি ওই খাতে ব্যয় বাড়িয়ে সামরিক সক্ষমতার বিকাশে পদক্ষেপ নেন। তার আমলে জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথম দেশের বাইরে যুদ্ধ করার এবং মিত্র কোনো দেশ আক্রমণের শিকার হলে তাদের সুরক্ষায় সেনা পাঠানোর বিষয়টি অনুমোদন করে।

অ্যাবে অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের লেখা জাপানের সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ নয় নম্বর অনুচ্ছেদ (আর্টিকেল নাইন-রিনানসিয়েশন অব ওয়ার) বদলে জাপানের সেলফ ডিফেন্স ফোর্সকে আক্রমণাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত একটি পরিপূর্ণ সেনাবাহিনীতে রূপান্তরে তার দীর্ঘদিনের লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হন। ২০১৫ সালে, তিনি জাপানের ‘যৌথ আত্মরক্ষার অধিকারের’ নীতি নেয়ার জন্য চেষ্টা শুরু করেন যাতে জাপান তার নিজের এবং মিত্রদের প্রতিরক্ষায় দেশের বাইরে সেনা পাঠাতে পারে। প্রতিবেশী দেশগুলোর আপত্তি এবং দেশের মধ্যে বহু মানুষের আপত্তি সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবিত নতুন ওই বিতর্কিত প্রতিরক্ষা নীতি পার্লামেন্টে পাস হয়ে যায়। টোকিওতে অলিম্পিক গেমস নিয়ে আসার মূল কারিগরও ছিলেন তিনি। কোভিডের কারণে ওই গেমস ২০২০ সালের বদলে ২০২১ সালে হয়।

১৯৫৪ সালের সেপ্টেম্বরে টোকিওতে জন্ম নেয়া অ্যাবের পরিবার আগে থেকে জাপানের রাজনীতিতে বেশ প্রভাবশালী। তার বাবা শিনতারো অ্যাবে একসময় দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। নানা নবোসুকে কিশি ১৯৫৭ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত ছিলেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী।

কয়েক দশক আগে পিয়ংইয়ংয়ের হাতে জাপানি নাগরিক অপহরণের ঘটনা নিয়ে প্রতিবেশী উত্তর কোরিয়ার বিষয়ে শক্ত অবস্থান শিনজো অ্যাবেকে দেশজুড়ে পরিচিতি এনে দেয়। অ্যাবে সবসময় প্রতিবেশী চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাতে চাইলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস তাতে নিয়মিত সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। ২০১৩ সালে অ্যাবে টোকিওর বিতর্কিত ইয়াসুকুনি মঠ পরিদর্শনে গিয়ে বেইজিং ও সিউলকে ক্ষেপিয়ে দিয়েছিলেন। ইয়াসুকুনি মঠকে জাপানের অতীত সামরিক শক্তির প্রতীক হিসেবে দেখা হয়।
চীনকে ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ভারতকে নিয়ে কোয়াড ও এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরে কম্প্রিহেনসিভ অ্যান্ড প্রোগ্রেসিভ অ্যাগ্রিমেন্ট ফর ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (সিপিটিপিপি) গঠন ও বিকাশেও অ্যাবের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।

লেখক : সাবেক সচিব এবং
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান


আরো সংবাদ



premium cement