১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

ইউনূস খালেদা ফখরুলের চরিত্র হনন কেন?

ইউনূস খালেদা ফখরুল - ফাইল ছবি

সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশের তিন সম্মানিত মানুষ। তারা বাংলাদেশের অহঙ্কার। দেশ তাদের নিয়ে গর্ব করে। কারণ তারা নিজেদের কাজের মাধ্যমে দেশের জন্য সম্মান বয়ে এনেছেন। কিন্তু বর্তমান ক্ষমতাসীনদের ভয়াবহ রোষানলের শিকার হয়েছেন তারা। কিভাবে তাদের সম্মানকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়া যায় সেই অপচেষ্টায় সর্বশক্তি নিয়োগ করছে ক্ষমতাসীনরা। তাদের চরিত্র হননের জন্য একের পর প্রোপাগান্ডা চালানো হচ্ছে।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যম দেশ স্বাধীন হওয়ার পর গত অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী হলেন গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। দারিদ্র্য বিমোচনে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য তাকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়। দেশের প্রতিটি মানুষ এ পুরস্কারে খুশি হলেও আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা ও দলটির নেতারা তা সহ্য করতে পারছেন না। আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা ব্যক্তিগতভাবে ড. ইউনূসের পুরস্কারে খুশি হলেও দলের নীতির কারণে প্রকাশ্যে তা তারা প্রকাশ করতে পারেন না। দলের বিরোধিতার সঙ্গেই তাদের সুর মেলাতে হয়। ড. ইউনূসকে হেয় ও নাজেহাল করার যত প্রক্রিয়া আছে তা করে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ ও তাদের শীর্ষ নেতারা। নোবেল পুরস্কার তাদের প্রাপ্য ছিল, কেন ড. ইউনূস পেলেন এটাই তাদের ক্ষোভ, জ্বালা ও মাথাব্যথার কারণ। ফলে এমন অভিযোগ নেই যা ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে করা হচ্ছে না। তাকে হয়রানি ও নাজেহাল করার সবকিছুই সরকার করছে।

পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে বিশ্বব্যাংক সরে যাওয়ার জন্য ড. ইউনূসকে দায়ী করা হচ্ছে। ড. ইউনূস বারবার বিবৃতি দিয়ে বলছেন, তিনি এর সঙ্গে জড়িত নন। এ কাজ করেননি এবং করতে পারেন না কিন্তু সরকার তা আমলে নিচ্ছে না। তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়েই যাচ্ছে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশেরই নয়, বর্তমানে বিশ্বজুড়েই একজন সম্মানিত মানুষ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় তাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে তাদের অনুষ্ঠানে নিচ্ছেন। বক্তৃতা দিয়ে তিনি কোটি কোটি টাকা আয় করছেন। এটাও সহ্য হচ্ছে না সরকারের। এই টাকাও নানা আইনি জটিলতা আরোপ করে ছিনিয়ে নেয়া হচ্ছে। সর্বশেষ তাকে বিচারিক সমস্যায় ফেলে তার সম্মান একেবারে ধূলিসাৎ করে দেয়ার পাঁয়তারা চলছে। এরই বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন শতাধিক নোবেল বিজয়ীসহ বিশ্বের নেতৃস্থানীয় দেড় শতাধিক ব্যক্তি। তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর খোলা চিঠি লিখে অবিলম্বে অধ্যাপক ইউনূসের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে বর্তমানে চলমান বিচারিক কার্যক্রম স্থগিতের আহ্বান জানিয়েছেন। তারা সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, একটি নিরপেক্ষ বিচারক প্যানেলের মাধ্যমে তাঁর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, সেগুলো পর্যালোচনা করা হবে। ওই বিচারিক প্যানেলে আন্তর্জাতিকভাবে আইন বিশেষজ্ঞ হিসেবে স্বীকৃত ব্যক্তিরা ভূমিকা রাখবেন। বিবৃতিদাতা শতাধিক নোবেল বিজয়ী ও বিশ্বনেতারা বলেন, আমরা আত্মবিশ্বাসী যে, ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে দুদক ও শ্রম আইনে যেসব মামলা চলছে, সেগুলো পর্যালোচনা করলে তার দোষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। চিঠির ভাষ্যে এটাই পরিষ্কার যে, বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা ও বিচারকরা নিরপেক্ষ নন এবং দুদক ও শ্রম আইনে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে তা উদ্দেশ্যমূলক। তাই ড. ইউনূসের বিরুদ্ধেও যে একটি ফরমায়েশি রায় হতে পারে এ আশঙ্কাই করছেন বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ এসব ব্যক্তি।

ড. ইউনূস সম্পর্কে উচ্চ ধারণা প্রকাশ করে তারা বলেছেন, আমাদের সবার জন্য তিনি অনুপ্রেরণাদায়ক। সামাজিক ব্যবসা কিভাবে আন্তর্জাতিক অগ্রগতি আনতে পারে তা দেখিয়েছেন ড. ইউনূস। এর মধ্য দিয়ে শতাধিক দারিদ্র্যবিমোচন, বেকারত্ব দূর করা এবং কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার ক্ষেত্রে অগ্রগতির বিষয় রয়েছে। চিঠিদাতাদের মধ্যে বারাক ওবামা, শিরিন এবাদি, আল গোর, তাওয়াক্কুল কারমান, পাদিয়া মুরাদ, মারিয়া রেসা, হুয়ান ম্যানুয়েল সান্তোষসহ ১৪ জন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী রয়েছেন। ওরহান পামুক, জে এম কোয়েটজিসহ চারজন সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী রয়েছেন। জোসেফ স্টিগলিৎসহ অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী রয়েছেন সাতজন। এছাড়া রসায়নে ২৮ জন নোবেল বিজয়ী, চিকিৎসাশাস্ত্রে ২৯ জন নোবেল বিজয়ী এবং পদার্থবিজ্ঞানে ২২ জন নোবেল বিজয়ী রয়েছেন। এছাড়াও জাতিসঙ্ঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা রয়েছেন।

শুধু ড. মুহাম্মদ ইউনূসই নন, চিঠিতে তারা বাংলাদেশের মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রের সমস্যা নিয়েও কথা বলেছেন। চিঠিতে বলা হয়, সম্প্রতি বাংলাদেশে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের প্রতি যে হুমকি দেখা দিয়েছে তা নিয়ে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। আমরা মনে করি, বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক হবে। এজন্য নির্বাচনকালীন প্রশাসন দেশের প্রথম সারির দলগুলোর কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়াটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বিগত দু’টি নির্বাচনের বৈধতার ঘাটতি রয়েছে। অর্থাৎ নির্বাচন দু’টি যে জালিয়াতির এবং ভুয়া হয়েছে; তাই তারা বলেছেন।

খালেদা জিয়ার প্রতি অন্যায়
সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী। তিনি দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী। দেশের নারীদের ক্ষমতায়ন, মেয়েদের শিক্ষার অবারিত সুযোগ সৃষ্টি এবং দেশের উন্নয়নে তার রয়েছে অসামান্য অবদান। তিনি স্বাধীনতার ঘোষক ও দেশের জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সহধর্মিণী। মুক্তিযুদ্ধে তারও রয়েছে অবদান। কিন্তু বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার তার ইমেজকেও ধ্বংস করে দেয়ার সব অপপ্রচার চালিয়ে আসছে বছরের পর বছর ধরে। ২০১৮ সালে ফরমায়েশি রায়ে তাঁকে অন্যায় সাজা দিয়ে ‘রাতের ভোট’ সম্পন্ন করে ক্ষমতা কব্জা করে রাখে সরকার। খালেদা জিয়া একজন প্রবীণ মহিলা। বয়স ৭৮ বছর পার হয়েছে। দেশের এই বয়োজ্যেষ্ঠ মহিলা, তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে উন্নত চিকিৎসার সুযোগটুকুও দেয়া হচ্ছে না। বর্তমানে তিনি ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন গৃহবন্দী অবস্থায়। চিকিৎসকরা তাকে বিদেশের অ্যাডভান্স সেন্টারে নিয়ে চিকিৎসার সুপারিশ করলেও সেই সুযোগ দেয়া হচ্ছে না। এ অবস্থাতেও তার মানহানির উদ্দেশ্যে ‘এতিমের টাকা আত্মসাৎ’র কথিত ও মিথ্যা অভিযোগ ও অপপ্রচার চালিয়েই যাচ্ছে তারা।

মির্জা ফখরুলের ভাবমূর্তি নষ্টের পাঁয়তারা
বাংলাদেশের একজন পরিচ্ছন্ন রাজনীতিক হিসেবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পরিচিত। বর্তমানে দখলদার সরকারের পতনের দাবিতে দেশব্যাপী এক দফার আন্দোলন চলছে। এ আন্দোলনে অন্যতম মুখ্য ভূমিকা পালন করছেন মির্জা ফখরুল। লাখ লাখ লোকের মহাসমাবেশে তিনি বক্তৃতা করছেন। তার বক্তৃতায় মানুষ অনুপ্রাণিত ও আলোড়িত হচ্ছে। এটা সহ্য হচ্ছে না সরকারের। তাই তার ভাবমূর্তি ধ্বংস করতে উঠে পড়ে লেগেছে সরকার।

মির্জা ফফরুল ও তার স্ত্রী অসুস্থ। সিঙ্গাপুরে তারা গেছেন চিকিৎসা করাতে। হঠাৎ দেখা যায়, প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণতহবিলের সহায়তার নামে একটি ৫০ লাখ টাকার চেক তাদের ছবিসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। তারা নাকি প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে এই টাকা নিয়েছেন। এর দাঁতভাঙা জবাব দিয়েছেন মির্জা ফখরুল। ডেইলি স্টারসহ বিভিন্ন পত্রিকায় সিঙ্গাপুর থেকে দেয়া সাক্ষাৎকারে মির্জা ফখরুল বলেছেন, ‘মির্জা ফখরুলদের কখনো কেনা যায় না। মির্জা ফখরুল বিক্রি হয় না। বাপের জমি বিক্রি করে আমি রাজনীতি করি এবং চিকিৎসার খরচ চালাই।’ তিনি বলেন, দেশের মানুষ জানে, আওয়ামী লীগ প্রোপাগান্ডা চালানোর মেশিন। এরা প্রোপাগান্ডা চালাবে এবং তাদের কোনো প্রোপাগান্ডাই দেশের মানুষ বিশ্বাস করে না। তিনি আরো বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সবাইকে নিজেদের মতো বিক্রয়যোগ্য পণ্য মনে করে। মির্জা ফখরুলরা টাকার জন্য রাজনীতি করে না, তাদের কেন যায় না।’

‘তিনি এটিকে আওয়ামী লীগের একটি পরিকল্পিত প্রোপাগান্ডা উল্লেখ করে বলেন, আন্দোলনকে বিপথগামী করা এবং নেতাকর্মীদের মনোবল ভেঙে দেয়ার জন্যই তারা এমন চরিত্র হননের পথ বেছে নিয়েছে।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব,
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement