আমাদের বাবা-মা এবং শিল্পের শাসন
- ড. মাহবুব হাসান
- ০২ জুন ২০২৩, ২০:২৭
কয়লার ময়লা দূর করা যায় না। এটি চিরসত্য। এই সত্য মেনে নিলে অনেক বিষয়ের সমাধান পাওয়া সম্ভব। সত্যই যদি আমরা সেটি চাই। এই চাওয়ার সাথে মানুষের খাসলত জড়িত। সেই খাসলত সৃষ্টি করে তার জীবনযাপনধারা ও আচার-আচরণ, তার পরিবেশ ও চিন্তা-ভাবনার যুক্তি-তর্ক-গপ্প। এই যুক্তি-তর্ক-গপ্পের মধ্যেই আছে যুক্তি-অযুক্তির ঊর্ধ্বের অনেক বিশ্বাস। সেগুলো নিঃশ্বাস নেয়ার মতোই সত্য। তারপরও আমরা, স্বার্থান্বেষী মানুষ সেসব সত্য অস্বীকার করি।
এটিই হলো খাসলত। খাসলত যায় না মরলে, কথাটি লোকসমাজ কেন সৃষ্টি করেছিল এবার তা বোঝা যাচ্ছে। কোনো কোনো বিজ্ঞজন বলছেন, গাজীপুরের সুষ্ঠু নির্বাচনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। তার মানে তিনি ও তারা বলতে চান, এই সরকারের অধীনেই সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব। এ ধরনের রাজনৈতিকভাবে অন্ধজনকে কী করে আলো দানের কথা বলি? একটি উপজেলা শহরের মেয়র নির্বাচন যে সামান্য একটি ইভেন্ট, সেটি বোঝার মতো মননও নেই তাদের, যারা এ রকম সিমিলি দিচ্ছেন।
অনির্বাচিত, নির্দলীয়, নিরপেক্ষ একটি সরকারের অধীনে তিনটি নির্বাচন কেবল সুষ্ঠু নিরপেক্ষই হয়নি, প্রত্যেক ভোটারের ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকার নিশ্চিত করা গেছে। সেই রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ইতিহাস জানা থাকার পরও বুদ্ধিবৃত্তিক লেজুড়রা দলীয় সরকারের অধীনে মেয়র নির্বাচনকে জাতীয় নির্বাচনের সাথে তুলনা করে চলেছেন। তলাবিহীন লেজুড়দের এ ধরনের তঞ্চকতাই আমাদের খাসলতের অধীন। আমরা এ ধরনের যুক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে চাই।
২.ফেসবুকে একটি পোস্ট দেখেছি, সেখানে লেখা ছিল- আমাদের উচ্চ আদালতের দু’জন বিচারক একটি রায়ের মতো অবজারভেশন দিয়ে জানিয়েছেন, এখন থেকে কোনো বাবা-মা আর বঞ্চিত হবেন না ছেলেদের কাছে থেকে। কারণ তারা যদি তাদের স্থাবর সম্পত্তি ছেলেদের দান করে দেন এবং ছেলেরা যদি বাবা-মায়ের ভরণ-পোষণের কর্তব্য পালন না করে, তাহলে সেই বাবা-মা তাদের দান করে দেয়া সম্পদ ফেরত নিতে পারবেন।
এই খবরটি পড়ে এতটাই আনন্দিত হয়েছি যে, কী বলব। আমিও তো এখন প্রৌঢ়ত্ব শেষ করে বৃদ্ধ হয়েছি। এই বয়সে মা-বাবা নির্ভর করেন তাদের সুপ্রিয় ছেলেমেয়েদের, যারা আজীবন স্বপ্ন রচনার কেন্দ্রে ছিল। আজকে আমার ছেলে কি সেই স্বপ্নে/চাওয়ার বা প্রত্যাশার বা আমাদের সামাজিক জীবনের সাংস্কৃতিক অধিকার পালন করবে? কে বলতে পারে? আমি কি আমার বাবা-মায়ের প্রতি যে দায়িত্ব ছিল তা কি পালন করেছি? মনে পড়ে, আবার পড়েও না। কারণ, বাবা হওয়ার পর নিজের বাবার প্রতি বা মায়ের প্রতি আমাদের আত্মিক টান অনেকটাই কমে যায়। তখন আমার বা আমাদের ভাবনার কেন্দ্রে চলে আসে আমারই সন্তান। এই যে সাংস্কৃতিক সাইকেল আমাদের জীবনাচারের, সেখানে বৃদ্ধ বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানো বা রেখে আসার অনেক নৃশংস ঘটনা আছে। আছে গরিব পিতা-মাতার সন্তানরা নিজেদের সংসারে বাবা-মাকে ‘বোঝা’ মনে করে দূরে ঠেলে দেয় বা ফেলে দেয় পথে। সংবাদপত্রগুলোতে এ রকম স্টোরি আমরা অহরহই পড়ি। সেই বেদনার ভার যেন কমানোর জন্যই দু’জন বিচারক এই রায় দিয়েছেন, যা প্রতিটি মানবিক মানুষকে স্পর্শ করে যাচ্ছে। স্পর্শ করছে সমাজকে, স্পর্শ করবে দেশের সরকারকে। কেননা, প্রত্যেক ব্যক্তি একই সাথে বাবা-মায়ের সন্তান ছিলেন/আছেন আবার তিনি নিজেও বাবা-মায়ের ভূমিকায় আছেন। আমাদের দেশের যে সামাজিক-সংস্কৃতির এই জীবনকাঠামো চক্রের ভেতরে ক্ষত সৃষ্টি করেছে মানুষের ক্ষুধা-দারিদ্র্য, বেঁচে থাকার নিরলস সংগ্রাম। এই সংগ্রামের শেষ সম্পন্ন হয় মৃত্যুতে।
ক্ষুধা আর দারিদ্র্য এমন এক বিষয় যা মূলত ওই মানুষই সৃষ্টি করেছে। এটি সামাজিক ও রাজনৈতিক রোগ। এই রোগের উৎপত্তি পাওয়ার লোভ থেকে। এই লোভই মানব সমাজের সব চেয়ে খারাপ উপাদান। পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বা স্তর পর্যন্ত এই রোগ আজকে এমন এক বোধের জন্ম দিয়েছে, যা মনে হয় তার বা তাদের কায়েমি অধিকার। এই বোধের পেছনে যে কাজ করছে লোভ, যা মানুষের সব অবদানের/সৃজনের ধ্বংসকারী উপাদান, তা তারা উপলব্ধি করতে পারে না। কেন পারে না, এর পেছনেও আছে কায়েমি ক্ষমতা ভোগের কারণ। এটিও লোভের অন্ধ অধিকারের অন্তর্গত।
আজকে, এই ২০২৩ সালেও আমরা এই লোভের, ক্ষমতা ভোগের প্রকাশ্য কুকীর্তি লক্ষ করছি। জনগণের ভোটের সাংবিধানিক অধিকার করায়ত্ত করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার মানসিকতাই তাদের রাজনৈতিক অধিকার বলে মনে করছে। তারা একবারও ভাবছে না, যে জনগণের নামে তারা ক্ষমতার মসনদটিকে আয়ত্তে রেখেছেন, তার পেছনে তাদের জনগণের ভোট ছিল না, নেই। জনগণ যদি ভোটই দিতে না পারে, তাহলে তারা তাদের মালিকানা দেখাবে কেমন করে? সংবিধানে ঘোষণা করা হয়েছে- এ দেশের মালিক জনগণ। জনগণের ভোটেই ক্ষমতায় যাওয়ার রাজপথটি সৃষ্টি হয়। কিন্তু লোভ যখন দুর্বৃত্তায়নের চক্রে পড়ে তখন ওই মালিকানার অধিকার হরণ করার পক্ষেই নিজেদের কুযুক্তিকে ‘সু’ বলে মনে হয়। এ রকম অপযুক্তি যতদিন পর্যন্ত রাজনীতি থেকে সরানো না যাবে, ততদিন পর্যন্ত মানুষ তার ভোটাধিকার ফিরে পাবে না।
৩. আশ্চর্য হয়ে পড়লাম একটি সংবাদ। শিরোনাম : শিল্পীর তুলি বন্দুকের চেয়েও তীক্ষ্ণ। এই শিরোনাম পড়ার সাথে সাথে আমার চোখের পর্দায় ভেসে উঠল পাবলো পিকাসোর ছবি গোয়ের্নিকা। ওই ছবিটি ১৯৩৫ সালে আঁকা এবং সেই সময়কার স্পেনের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলকারী সামরিক সরকারের নগ্ন নিষ্ঠুরতার এক কাহিনী উঠে এসেছে। গোয়ের্নিকা নামের গ্রামে সামরিক বাহিনীর নগ্ন হত্যাযজ্ঞের ছবি এঁকে তিনি দেখিয়েছেন, জনগণহীন সামরিক সরকার মানুষের প্রতি কি রকম অন্যায়/অপরাধ করতে পারে।
হ্যাঁ, অবশ্যই শিল্পীর তুলি রাইফেলের চেয়েও তীক্ষ্ণ, ১৯৭১ সালে এ দেশের শিল্পীরা তার প্রমাণ দিয়েছেন। শিল্পী কামরুল হাসানের স্টপ জেনোসাইডের ‘জানোয়ারের মুখে আমরা দেখেছি সেই সময়ের ঘৃণিত ইয়াহিয়ার মুখ। সেই মুখ জাতির আকাক্সক্ষার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। আমি ওই সংবাদের সামান্য তুলে আনি, তাতে সুবিধাই হবে।
দেশের রাজনৈতিক সঙ্কটে চারুশিল্পীদের ভ‚মিকা ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন অথবা সাংস্কৃতিক বিপ্লবে নানাভাবে চারুশিল্পীদের কাজ প্রভাব রেখেছে। কারো হাত ধরে এগিয়েছে দেশের শিল্পমাধ্যমটি, কেউ মজবুত করেছেন কাঠামো। প্রয়াত চারুশিল্পীদের স্মরণে দু’দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ’ অনুষ্ঠানে প্রবন্ধ উপস্থাপক এবং আলোচকদের বক্তব্যে উঠে আসে এসব কথা।
রিপোর্টের এই কথাগুলো সত্য। আমরা দেখেছি সেই সব সত্যের নানা রূপ এবং বাঙময় উপস্থাপনা। ভাষা আন্দোলনের প্রতিবাদী কবিতা সঙ্কলনটি করেছিলেন একজন তরুণ কবি। হাসান হাফিজুর রহমানের অক্লান্ত পরিশ্রমের সেই ফসল নিয়ে আমরা গর্ববোধ করি। কিন্তু তার কাজের স্বীকৃতি যে সব সম্মান যে ঐশ্বর্যে হতে পারত, তা কিন্তু জাতির নেতারা দেননি। ঠিক তেমনি, শিল্পকলা একডেমির এই আয়োজনকে অবশ্যই করতালি দেবো। কারণ সংস্কৃতি চর্চার এই খরাকালে শিল্পী এস এম সুলতানের মতো বিপ্লবী চেতনার মানুষকে নিয়ে উদযাপনার সাথে কিন্তু কাইয়ূম চৌধুরীর মতো শিল্পী যায় না। শিল্পী এস এম সুলতান এককভাবে এবং কাইয়ূম চৌধুরীও এককভাবে উপস্থাপিত হওয়ার দাবি রাখেন। চারুকলা এমনই এক মাধ্যম যা অনুভবের বিষয়, রাইফেলের মতো নৃশংসতার নয়। কিন্তু আমরা চারুকলা নয়, রাইফেলে আসক্ত জাতি। আমাদের বোধে সাংস্কৃতিক চেতনায় চারু ও কারুশিল্পের অবস্থান যৎসামান্য। যার কারণে আমাদের রাজনীতিতে শিল্পকলা বা শিল্প-সাহিত্যের মূল্য নেই বললেই চলে। কখনো যদি কোনো প্রধানমন্ত্রী কবিতা আবৃত্তি করেন কিংবা শিক্ষামন্ত্রী কবিতা আবৃত্তি করেন, তখন আমরা যারা সেই রাজনীতির লেজুড়, তারা করতালিতে মুখর করে তুলি পরিবেশ-প্রতিবেশ। তারপর চলতে থাকে আবৃত্তিকারের ভ‚য়সী প্রশংসা, যা পাওয়ার কোনো যোগ্যতাই তাদের নেই। বিষয়টি কবিতা লিখলেই যেমন কবি হওয়া যায় না, তেমনি তুলি হাতে নিলেই তাকে শিল্পী অভিধা দেয়া যায় না। বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। তাই তা ক্ষমতার সাথে ঠিক মেলে না। সেদিন যারা মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন তারা যোগ্য মানুষ, সন্দেহ নেই। কিন্তু শিল্পকলার মহাপরিচালক তো একজন নাটকের শিল্পী ও নাট্যকার। তার ওই মঞ্চে থাকাটা যুক্তিসঙ্গত মনে হয়নি। শিল্পকলা আয়োজন করলে তাকেই সেই মঞ্চে থাকতে হবে এরকম মোসাহেবি চিন্তা বাদ দিতে না পারলে একজন শিল্পীকে ওই মঞ্চের চেয়ারে বসানো যাবে না। এস এম সুলতান ও কাইয়ূম চৌধুরীর কাজ নিয়ে শিল্পীরাই ছিলেন উপযুক্ত। একজন স্থপতি বা অতিরিক্ত সচিবের কোনো প্রয়োজন নেই। তারা ওখানে জায়গা পেয়েছেন মূলত সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের পদে থাকায়। ওই পদে তিনি না থাকলে কিন্তু মোসাহেবি সংস্কৃতির ধারকরা তাকে ওখানে নিয়ে আসতেন না। ওই মন্ত্রণালয়ের বা অন্য মন্ত্রণালয়ের আরো অনেক অতিরিক্ত সচিবই আছেন জ্ঞানে ও গরিমায় যারা প্রজ্ঞাবান, শিল্পকলার ডিজি কিন্তু তাদের ডাকেননি। এটি ডিজির দোষ নয়। এটি হলো আমলাতন্ত্রের নিকৃষ্ট উদাহরণের একটি। আমরা বহুবারই দেখেছি যিনি যে মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী তিনি সেই মন্ত্রণালয়ের কোনো অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হয়ে আসেন। এটি কোন ধরনের কালচার? তারই অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানে তিনিই যদি আসেন তাহলে ওই বিষয়ের যারা প্রজ্ঞাবান বা জ্ঞানবান তারা তো আড়ালেই থেকে যাবেন বা যাচ্ছেন। এটি আমলা সংস্কৃতির সবচেয়ে নিকৃষ্ট কাজ বলে আমরা মনে করি।
৪. এ রকম আরো উদাহরণ দেয়া যাবে আমাদের রাজনৈতিক সরকারের আমলানির্ভর সংস্কৃতির, যা কেবল আমাদের ঐতিহ্যই ধ্বংস করছে না, সংস্কৃতি থেকে চ্যুতও করছে। আমরা যে দেশের, যে সমাজের মানুষ, আমরা যে সাংস্কৃতিক মানুষ হয়ে উঠেছি, সভ্য হয়ে উঠেছি ওই সংস্কৃতির কারণেই, তার শিল্প-সুষমা ও সৌন্দর্যের কারণেই। এটুকু স্বীকৃতি দিতে হবে সরকারকে। কারণ না হলে আমাদের বোধসত্তায় প্রাগ্রসরতার কোনো চিহ্নই থাকবে না।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা