২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

অনন্য এক জিয়াউর রহমান

অনন্য এক জিয়াউর রহমান। - ছবি : সংগৃহীত

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত আমাদের এই স্বাধীন দেশকে ‘বাংলা’ নামে কেউ ডাকলে বিনয়ের সাথে তাকে শুধরে দিয়ে তিনি বলতেন, ‘বাংলাদেশ’ বলুন। তিনি স্বপ্ন দেখতেন, বাংলাদেশ একটি স্বনির্ভর, সুখী-সমৃদ্ধ দেশ হয়ে গড়ে উঠুক। এ জন্য সারা দেশ ঘুরে বেড়াতেন। গ্রাম-গ্রামান্তরের পথ ধরে মাইলের পর মাইল হাঁটতেন, সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলতেন, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য পরামর্শ দিতেন। গ্রামের মানুষকে বলতেন- গাছ লাগান, হাঁস-মুরগি, গবাদিপশু ও মাছের চাষ করুন, ভাগ্য ফিরে যাবে।

একবার সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের এক গ্রামের বাড়িতে ঢুকে বাড়ির মালিকের কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘কই, আপনার উঠানে তো হাঁস-মুরগি দেখছি না। ঘরে কয়টি ডিম আছে আজ। আনুন তো দেখি।’ বাড়ির মালিক কাঁচুমাচু করছিলেন। তিনি বললেন, হাঁস-মুরগি পালছেন না কেন? আপনার তো উঠানভর্তি মুরগি থাকার কথা। বাড়িতে গাছ-গাছড়া নেই কেন? তরকারির গাছ কোথায়? কৃষকের হাত ধরে বাড়ির পেছনে বাঁধা গরুর কাছে গিয়ে বললেন, হাড় জিরজিরে কেন? ছাগল-বকরিও তো দেখছি না। আমি তো আপনার মেহমান- ডিম নেই, ফলের গাছ নেই, পেঁপে নেই, ডাবগাছ নেই- এখন আমাকে কী খেতে দেবেন?
তিনি জিয়াউর রহমান। বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অনন্য নাম, এক ব্যতিক্রমী প্রেসিডেন্ট । ডাকনাম কমল, যার অর্থ পদ্ম। ৩০ মে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ৪২তম শাহাদাতবার্ষিকী। দেশের জন্য কাজ করতে গিয়ে ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে কুচক্রীদের হাতে নিহত হন।

বাংলাদেশের ক্রান্তিকালের দু’টি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে রেডিওতে মানুষ তার কণ্ঠ শুনতে পায়। একবার ১৯৭১ সালে ‘আমি মেজর জিয়া বলছি’ এবং আরেকবার ১৯৭৫ সালে ‘আমি মেজর জেনারেল জিয়া বলছি’ কণ্ঠে। একাত্তরের ২৬ মার্চ চট্টগ্রাম ষোলশহর ক্যান্টনমেন্ট ‘উই রিভোল্ট’ বলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং পরবর্তীতে কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে মুক্তিযুদ্ধের আহ্বান জানান। মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে একজন সেক্টর কমান্ডার ও জেড ফোর্সের প্রধান হিসেবে বীরত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রেখে দেশের স্বাধীনতায় অবদান রাখেন। এ জন্য তাকে বীরউত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়।

পরবর্তীতে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে এসে তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেন এবং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দর্শনে দেশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেন। উন্নয়ন ও উৎপাদনের রাজনীতি ছিল তার রাজনৈতিক দর্শন।

তার হত্যার পর সাপ্তাহিক বিচিত্রা পত্রিকায় জিয়াউর রহমানকে নিয়ে একটি প্রচ্ছদ প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল, ‘কমলের কিছু কথা’ শিরোনামে। লিখেছিলেন সাংবাদিক সাযযাদ কাদির। বিচিত্রার সংখ্যাটি প্রকাশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে নিঃশেষ হয়ে যায়। পাঠকের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে কর্তৃপক্ষকে সংখ্যাটি পুনর্মুদ্রণ করতে হয়েছিল। তিনি বাংলাদেশের মানুষের কতটা ভালোবাসার ছিলেন, এ থেকে বোঝা যায়।

আমার চোখে তিনি এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব যাকে মুহূর্তের জন্যও খাটো করে দেখা যায় না। সততায় তিনি নজিরবিহীন। তাকে নির্দ্বিধায় বলব, তিনি ছিলেন একজন কাজপাগল মানুষ। বছরের ৩৬৫ দিনই তিনি কাজ করতেন। রাতে চার ঘণ্টার বেশি ঘুমাতেন না। তার সব কাজই অসাধারণ। দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু করা তার এমনি একটি অসাধারণ কাজ।

কাফি খান ১৯৭৭ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট জিয়ার প্রেস সচিব ছিলেন। এই চার বছর তিনি জিয়াকে দেখেছেন খুব কাছ থেকে। কাফি খানের মতে, জিয়া অসাধারণ একজন মানুষ। যার কাছে গেলে মনে হয়, তিনি খুব কাছের। আবার এমন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, একেবারে কাছে যেতেও ভয় ভয় লাগে। ওই সময় তার বয়স আর কতই বা ছিল- ৪১ বছর। আমার কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, তার যে গুণাবলি আমি দেখেছি, এককথায় তা অতুলনীয়। তার কাজগুলো এখনো আমার চোখে ভাসে। প্রকৃতই দেশপ্রেমিক একজন মানুষ তিনি। দেশকে ভালোবাসা, দেশের জন্য কাজ করা, স্বজনপ্রীতিকে প্রশ্রয় না দেয়া, মানুষকে আপন করে নেয়া, দিন-রাত কাজ করা, সততার সাথে দেশ পরিচালনা, বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা উজ্জ্বল করা, দূরদর্শিতা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা- এসব গুণ আমাকে মুগ্ধই করেনি, মনে হয়েছে বাংলাদেশে তার মতো যদি এমন আরো কয়েকজন মানুষ পাওয়া যেত, তাহলে দেশের চেহারাটা পাল্টে দেয়া যেত।

কাফি খান পরিবার-পরিজন নিয়ে ওয়াশিংটনে ছিলেন। মৃত্যুর আগে তিনি বাংলাদেশে বেড়াতে এসেছিলেন। সেই সুযোগে তার সাক্ষাৎকার নেয়া। প্রেসিডেন্টের প্রেস সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি খুব খুশি হন। বলেন, আমার জীবনের একটি শ্রেষ্ঠ সময় কাটিয়েছি প্রেসিডেন্ট জিয়ার সাথে। এটিকে এক ধরনের সৌভাগ্য বলতে পারেন।

বলেন, তার একটি মহৎ গুণ ছিল, তিনি দেশের ভালো ভালো লোকদের তার পাশে জড়ো করতে পেরেছিলেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী অধ্যাপক মুহম্মদ শামসউল হক, ড. এম এন হুদা, সাইফুর রহমান, ড. ফসিহউদ্দিন মাহতাব- এমন অনেক লোকের সমাগম ঘটেছিল তার সরকারে ও দলে। দূরদর্শী চিন্তা-ভাবনার লোকের খোঁজ পেলে তাকে তিনি বঙ্গভবনে চায়ের আমন্ত্রণ জানাতেন এবং কোনো না কোনোভাবে কাজে লাগিয়েছেন। আমার কথাই ধরুন। হয়তো তিনি রেডিও-টেলিভিশনে খবর পড়া দেখে আমার বিষয়ে চিন্তা করেছেন, ওকে দিয়ে আমার প্রেস সচিবের কাজটি হবে। এভাবে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশকে বিনির্মাণ করে গেছেন। তাকে তাই বলা হয়, ‘আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার’।

দৈনিক বাংলার সম্পাদক ছিলেন প্রখ্যাত সাংবাদিক আহমেদ হুমায়ুন। তার সাথে কাজ করার আমার সৌভাগ্য হয়েছে। জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্ট থাকাকালে পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক ও বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন তিনি। জিয়াউর রহমানের সাথে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল এবং তিনি প্রেসিডেন্টের সাথে বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন।

জিয়াউর রহমান গণমাধ্যমকে কী চোখে দেখতেন সাক্ষাৎকারে হুমায়ুন ভাই তা বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট জিয়া ছিলেন একজন গণমাধ্যমপ্রিয় মানুষ। তিনি ক্ষমতায় এসে একদলীয় বাকশালের পরিবর্তে বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু করে আইন করেন। সংবাদপত্র প্রকাশের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন। পঁচাত্তরে চারটি পত্রিকা রেখে সব পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। তিনি একে একে সব পত্রিকা চালু করেন। রাজশাহী থেকে নতুন পত্রিকা দৈনিক বার্তা প্রকাশ করে বেকার সাংবাদিকদের পুনর্বাসিত করেন। সাংবাদিকতার সুষ্ঠু বিকাশে প্রেস কাউন্সিল গঠন ও প্রেস ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন।

স্বাধীন সাংবাদিকতার সব অন্তরায় দূর করতে সম্পাদক, মালিক, সাংবাদিক ইউনিয়ন নেতা ও সরকারি কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে প্রেস কনসালটেটিভ কমিটি করেন। মিরপুরে অবস্থিত সাংবাদিক পল্লী তারই অবদান। আজকের প্রেস ক্লাব ভবন এবং এর জায়গাটি তিনি আমাদের দিয়েছেন। তিনি বেঁচে থাকলে সাংবাদিকদের এরকম বহু কল্যাণ হতো।

লেখক : সাবেক সাধারণ সম্পাদক,
জাতীয় প্রেস ক্লাব


আরো সংবাদ



premium cement