২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

হজে লাভ কার

হজে লাভ কার। - ছবি : সংগৃহীত

আমরা জানতাম হজ পালনের মধ্য দিয়ে সামর্থ্যবান মানুষ তার ধর্ম ও ইচ্ছার মর্ম উদ্ধার করেন। সেই সাথে সামাজিকভাবে নিজেকে পরহেজগার হাজী ইত্যাদি তকমায় সাজিয়ে জীবনের শেষ দিনগুলো যাপন করেন।
কিন্তু এ বছর সেই আকাক্সক্ষার রূপটি পরিপূর্ণতা পায়নি। তার কারণ দু’টি। এক. বিমান ভাড়া বেড়ে যাওয়া আর দুই. মক্কায় বাড়ি ভাড়া বেড়ে যাওয়া। বাংলাদেশ গরিব দেশ না হলেও তেলেঝোলে মন্দ নেই। কিন্তু সৌদ পরিবারের দখল করা জাজিরাতুল আরবের তো আয়ের কমতি নেই, তারা কেন পবিত্র কাজে আগত মানুষদের জন্য বাড়ি ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে? তাহলে কি তাদের কোষের অবস্থা তেমন ভালো নয়? আর যারা বাড়ি ভাড়া দিয়ে আনন্দ লাভ বা সৎকর্ম বলে বিবেচনা করেন, তারা কেন সওয়াবের বদলে তংখা আয়ের পথ ধরলেন? বোঝা গেল না। অণুজীব করোনা-১৯-এর অভিঘাতেই যদি কুপোকাত হতে হয় বিশ্বকে তাহলে এত সব মারণাস্ত্র তৈরি আর মানুষ হত্যার এই অমানবিক, ধ্বংসাত্মক আয়োজন কেন?

এ সব প্রশ্নের কোনো জবাব নেই।

জবাব হচ্ছে, পৃথিবীর অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়। মন্দা চলছে। তাই মন্দকে কিছুটা ঠেকা দেয়ার জন্য ব্যবসার নতুন ফন্দি আঁটা তাদের রেওয়াজ। অতীতে নানা অজুহাতেই তো আমরা দেখেছি বিভিন্ন পণ্যে, তা হোক ভোগ্যপণ্য বা সেবাপণ্য, দাম বাড়াতে কসুর করেনি কোম্পানিগুলো। এই যে ধর্মের চেয়েও, রিচুয়ালের চেয়েও পবিত্র ও প্রয়োজনীয় বলে মনে হয় অর্থবিত্ত, তখন ওই সব ধর্মকর্ম ইত্যাদি তো একটি লোকদেখানো বিষয় হয়ে ওঠে। কিন্তু বিশ্বাসী মানুষের কাছে অর্থের চেয়েও তো ধর্মকর্ম অনেকটাই মূল্যবান। কিন্তু কাবার খাদেম হিসেবে যারা নিয়োজিত, তারা কেন বিশ্ব মুসলিমদের ব্যাপারে এটি ভাবেননি? কেন তারা ভর্তুকি দিয়ে বাড়িভাড়া দিচ্ছেন না হাজীদের, যারা রিচুয়ালের এই চূড়ান্তপর্বে আসতে চাইছেন?

চৌদ্দ শ’ বছর আগে যখন কাবা পৌত্তলিকদের দখলে ছিল তখন যে মেলা হতো, তা ছিল মূলত ব্যবসায়কেন্দ্রিক। সেই ব্যবসায়কেন্দ্রিকতাকে প্রশান্তির দরজায় নিয়ে এসেছিলেন হজরত মুহাম্মদ সা:। কিন্তু আজ তো সেটি নেই। এই যুগের হজ পালন হয়ে যাচ্ছে ব্যবসায়িক উৎসবের মেজাজে। এটি তো ঠিক হচ্ছে না। যারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে মক্কা আর মদিনায় যাবেন, তারা তো মক্কা আর মদিনার মেহমান। তাদের থাকা-খাওয়া আর আপ্যায়নের জন্য সৌদদের আরব কি তৈরি? নাকি এক মাস কয়েক লাখ মানুষকে খাওয়ানোর আর্থিক সামর্থ্য দেশটির নেই?
২.
তুলনা করলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের হজযাত্রার খরচ অত্যধিক বেশি। কেন বেশি? তার কোনো জবাব কেউ দেন না। তারা দাবি করেন ইউক্রেন-যুদ্ধ তাদের আর্থিক অবস্থায় ধস নামিয়ে দিয়েছে। ডলারের দাম বেড়ে গেছে। ফুয়েলের দাম বেড়েছে, সব রকম সেবাপণ্যেরও মূল্য বেড়েছে। খাদ্যশস্যের দামও বেড়েছে। মানে বিমানের টিকিটের দাম তাই বেড়ে গেছে। মানে বাড়ানো হয়েছে। ধর্ম প্রতিমন্ত্রী বলেছেন। কোভিডের আগে রিয়ালের দাম ছিল ২০ টাকা, এখন তার দাম ২৯-৩০ টাকা। ফলে সেখানকার বাড়ি ভাড়া ও খাদ্যপণ্যের দামও বেড়েছে। সব মিলিয়েই বাংলাদেশের হাজীদের জন্য যে প্যাকেজমূল্য নির্ধারণ করেছে হাব ও সরকারি লোকেরা, সেই দামই যথার্থ। তারপরও হাইকোর্টের হস্তক্ষেপে তারা ১১ হাজার টাকা কমিয়েছে প্যাকেজমূল্য। ঠিক এ কারণেই মাত্র সাড়ে ৯ হাজার মানুষ তাদের নিবন্ধন কনফার্ম করেননি। মানে তারা ওই মূল্যে হজে যাবেন না। ফলে কোটা পূরণ হয়নি এবার। তাতে কোনো ক্ষতি দেখছেন না তারা। কারণ তাদের লক্ষ্য ছিল বিমানভাড়া বাড়িয়ে সারা বছরের যে আলস্যজনিত অকর্মণ্যতা তার খেসারত উঠানোর সময় হচ্ছে হজের মৌসুম। বাংলাদেশ বিমানের টিকিটের দাম কেন অন্যান্য বিমান কোম্পানির চেয়ে বেশি? তার কোনো জবাব তারা দেন না। তাদের লোকবল তুলনামূলকভাবে বেশি। সেই লোকবলের বেতনভাতাদি পরিশোধ করতে গিয়েই বাংলাদেশ বিমান হিমশিম খায়। অতিরিক্ত লোকবল কেন ছাঁটাই করে, কোম্পানিটিকে কেন লাভবান করে তোলার ইতিবাচক পথ নেয় না তারা, সেটি এক বড় রহস্য। এই রহস্য কি এখানেই লুকিয়ে আছে যে, সরকারি কোম্পানির অর্থ দরিয়ায় ঢেলে দিয়ে জাতীয় পতাকার মান-সম্মান আন্তর্জাতিক আকাশে উড্ডীন রাখা? নাকি ওই কোম্পানির ভেতরে লুকিয়ে থাকা লুটেরাদের পেট মোটা করার কলাকৌশল এটি? আমরা যারা ননটেকনিক্যাল মানুষ, বিমান বাংলাদেশের এই অব্যবসায়িক মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি কেন বছরের পর বছর লালন করা হচ্ছে? আজকের এই প্রতিযোগিতার যুগে, বিমান ব্যবসায়কে কেন সেই স্তরে, সেই দক্ষতায় ও সেই চেতনায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা নেই? জবাবে তারা বলবেন, তারা বিমানকে স্মার্ট করেছেন, তারা সেই স্মার্টের জোরে এখন ধীরে ধীরে মাথা উঁচু করে চলেছেন, কিন্তু কোনোভাবেই তারা তা প্রমাণ করতে পারবেন না।
৩.
বেসরকারি হজ এজেন্সিজ (হাব) আর বিমান মিলে যে দর ঠিক করেছে টিকিটের, সেটিই বহাল আছে। কিন্তু আমরা যখন দেখি সাধারণ সময়ে টিকিটের যে মূল্য হয় বা থাকে, তার চেয়ে চারগুণ বেশি মূল্য রাখা হয়েছে। যুক্তি হিসেবে বলা হচ্ছে, হজ ফ্লাইটগুলো ফিরতি পথে খালি বা যাত্রীবিহীন ফিরে আসবে, তাই ফিরতি পথের মূল্যও তারা ধরেছেন। এটি যে হাজীদের পকেট কেটে নেয়ার শামিল, তা কি তারা বোঝেন? কেন একজন হাজী বাংলাদেশ বিমানে হজে যাবেন? কেন তিনি পৃথিবীর অন্য কোনো বিমানে হজে যেতে পারবেন না। তিনি তো যাত্রী। তার অধিকার আছে যেকোনো বিমানে চড়ে মক্কায় যাওয়ার এবং ফিরে আসারও। অতীতে তো এমনটিই ছিল, যতটা মনে পড়ছে। যখন হিজবুল বাহার নামের জাহাজটিতে করে হাজীরা হজে যেতেন, সেটিই ছিল সবচেয়ে কম টাকায় হজব্রত পালনের সুযোগ। সেই সুযোগটি কাজে না লাগিয়ে কেন ব্যয়বহুল বিমানপথ বেছে নিয়েছিলেন সরকারের দায়িত্বশীল লোকেরা, সেই প্রশ্নটি কেউ করে না। হজ করেন মূলত গরিব ও তথাকথিত মধ্যবিত্ত নামক শ্রেণীর মানুষ, যারা একে জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ পুণ্যের বলে মনে করেন। সেই সওয়াব বা পুণ্য আয়ের জন্য যদি গাঁটের টাকা সব ব্যয় হয়ে যায় তিনি ও তারা ফতুর হয়ে যান, তাহলে তার দায় কার? সামর্থ্যবানই কেবল হজ করার অধিকারী। সেই সামর্থ্য স্তরটি কেমন? এ বছর ১৬ লাখ টাকা লাগবে এক দম্পতির হজের ব্রত পালনের জন্য। কিংবা ধরুন, আট লাখ টাকা খরচ করে কতজন সামর্থ্যবান আছেন, যারা হজে যেতে পারবেন? এবং তারা ফতুর হয়ে যাবেন না। অথচ হাব আর বিমান মিলে কিংবা বলা উচিত হাব আর ধর্ম মন্ত্রণালয় মিলে ধর্মীয় রিচুয়াল পালনকে বাণিজ্য করার ফন্দি হিসেবে নিয়েছে। এটি হজে গমনেচ্ছুদের পকেট কেটে নেয়ার পরিকল্পনাই কেবল নয়, তাদের মানসিকতা যে মানবতাবিরোধী, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি যে ইসলামবিরোধী ও তাদের চেতনা যে বাণিজ্যের নেশায় আসক্ত, তা-ই প্রমাণ হয়। হিন্দুরাষ্ট্র হলেও ভারতের মুসলমানরা বাংলাদেশের চেয়ে কমমূল্যে হজযাত্রীদের আনা-নেয়া করছে। পাকিস্তান থেকে সৌদি আরবের দূরত্ব তুলনামূলকভাবে কম; কিন্তু ইন্দোনেশিয়ার বা মালয়েশিয়ার চেয়ে তো বাংলাদেশ থেকে জেদ্দা বা রিয়াদের দূরত্ব অনেকটাই কম। ওই দু’টি দেশ কেন কম দামে তাদের হাজীদের মক্কায় পাঠাতে পারছে? এর কী জবাব আছে তাদের কাছে?

কমার্শিয়াল বিমান কোম্পানিকে আচরণ করতে হবে বাণিজ্যের দিকে দৃষ্টি দিয়ে। এ কারণেই পৃথিবীর বহু বিমান কোম্পানি দক্ষ লোকবল সংগ্রহ করে, কম লোক দিয়ে সংস্থাটিকে চালায়। কোনো লোকবলই অলস বসে থাকে না, থাকতে পারে না। ম্যানেজমেন্ট এমনভাবে শিডিউল তৈরি করেন যে, যারা যাত্রীদের বোর্ডিং কার্ড ইস্যু করেছেন, সেই তারাই বিমানে বোর্ডার উঠানোর কাজ করছেন।
৪.
হজযাত্রীদের এই যে বিমানে যেতে বাধ্য করা এটি তাদের মানবাধিকার হরণের শামিল। যাত্রীরা কোন বিমানে কমফোর্ট ফিল করবে হজে যেতে সেই অধিকার হরণ করে নিজেদের বিমানে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে। তাও আবার বহুমূল্যে। কেন তারা স্বাধীনভাবে যেতে পারবেন না, তার ব্যাখ্যা যেমন দরকার, তেমনি হজকে বিমান বাংলাদেশের বাণিজ্যের সুযোগ করে তোলার কারণও দর্শাতে হবে। কারণ, ওই বিমান কোম্পানি সরকারের অর্থাৎ জনগণের অর্থে সৃষ্টি। জনগণের অর্থে বানানো কোম্পানি জনগণের পকেট কেটে নেবে, এটি তো মেনে নেয়া যায় না। বিমান বাংলাদেশের অথরিটি যদি সেটি করতে না পারেন, তাহলে তাদের ব্যর্থতার দায় জনগণ কাঁধে নেবে না। বিমানকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিলে ধারণা করি, এই প্রতিষ্ঠানটি লাভবানই কেবল হবে না, সেবার মানও বাড়বে বহুলভাবে।


আরো সংবাদ



premium cement