সোনা চোরাচালানের সাথে মন্ত্রীর কী সম্পর্ক?
- ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
- ০৫ এপ্রিল ২০২৩, ২০:২৯
থানার পরিদর্শকের পক্ষে টেবিলের সামনে কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এক যুবক। তার পাশে কোমরে পিস্তল গোঁজা এক পুলিশ সদস্য। পরিদর্শকের চেয়ারে বসা এক ব্যক্তি ওই যুবককে ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন। হঠাৎ যুবককে কষে চড় মারেন পুলিশ সদস্য। পরিদর্শকের চেয়ার থেকে ওই ব্যক্তি উঠে এসে যুবককে মারধর শুরু করেন। যুবক মেঝেতে পড়ে গেলে পা দিয়ে তার মাথা চেপে ধরে লাথি ঘুষি মারতে থাকেন ওই ব্যক্তি। ঘটনাটি ঘটে গত বছরের আগস্টে মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া থানায়। মারধরের সেই ঘটনার ভিডিও সম্প্রতি এক পত্রিকার হাতে আসে।
বাংলাদেশে এখন এমন একটি অবস্থা যে, প্রায় প্রতিদিন একেকটি লোমহর্ষক ঘটনা ঘটে। ফলে আগের দিনের ঘনটাটি ধীরে ধীরে বিস্মৃতির গহ্বরে তলিয়ে যায়। সংবাদপত্রজুড়ে নতুন ঘটনা নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। সেটি সুরাহা না হতেই ঘটে নতুন কোনো লোমহর্ষক ঘটনা। আমরা তার পেছনে ধাবিত হই।
সাটুরিয়া থানার ঘটনা অনুসন্ধান করে জানা যায়, চেয়ারে বসা ব্যক্তি কোনো পুলিশ কর্মকর্তা নন। তিনি স্বর্ণ পাচারকারী একটি চক্রের নেতা। নাম সুলতান মিয়া। বাড়ি মৌলভীবাজারে। দুবাই থেকে অবৈধভাবে দেশে সোনা পাঠান তিনি। পুলিশ সদস্য হলেন ওই থানার এএসআই তারেক আজিজ। কয়েক মাস পর ঘটনাটি জানাজানি হলে তারেককে সাময়িক বরখাস্ত এবং ওই থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মহব্বত আলীকে বদলি করা হয়।
যে যুবককে মারধর করা হয়েছে তার নাম নাজমুল হাসান (৩০)। বাড়ি মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া থানার তিল্লি গ্রামে। গত বছরের এপ্রিলে চার লাখ টাকা খরচ করে কাজের সন্ধানে দুবাই গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কাজ না পেয়ে চার মাস পর দেশে ফিরে আসেন নাজমুল। তাকে বিমানের টিকিট কিনে দেন সোনা চোরাচালানি চক্রের অন্যতম হোতা সুলতান মিয়া। শর্ত অনুযায়ী সুলতানের দেয়া দু’টি স্বর্ণের বার ও ৯ ভরি ওজনের ৯টি স্বর্ণের চুড়ি বহন করতে হয় নাজমুলকে। কিন্তু দেশে ফিরে নাজমুল সেই স্বর্ণ সুলতানের লোকের কাছে পৌঁছে দেননি। এরপর সুলতানের হয়ে সেই স্বর্ণ উদ্ধারে ব্যস্ত হয়ে পড়ে মানিকগঞ্জের পুলিশ। মানিকগঞ্জের পুলিশ সুপার একটি পত্রিকাকে বলেন, একজন ভিআইপি অনুরোধ করে বলেছিলেন, তার এক আত্মীয়ের বিয়ের জন্য দুবাই থেকে সোনার অলঙ্কার পাঠানো হয়েছে। যার কাছে পাঠিয়েছিলেন, তিনি স্বর্ণ বুঝিয়ে দেননি। যিনি স্বর্ণ বুঝিয়ে দেননি তার বাড়ি মানিকগঞ্জে। পরে আমি পুলিশ দিয়ে ওই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আটক করি। স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়। কিন্তু এসপি গোলাম আজাদ ওই ভিআইপির নাম প্রকাশ করতে অস্বীকার করেন। তবে পুলিশের আরেকটি সূত্র থেকে জানা যায়, সেই ভিআইপির বাড়ি ও স্বর্ণ পাচারকারী সুলতান মিয়ার বাড়ি একই এলাকায়। এসপি গোলাম আজাদকে জিজ্ঞেস করা হয়, বাইরের একজন ব্যক্তি পরিদর্শকের চেয়ারে বসলেন এবং নাজমুলকে মারধর করলেন, সে প্রশ্নের জবাবে এসপি গোলাম আজাদ বলেন, আমি এটি জানতাম না। জানার পর পরিদর্শক মহব্বত আলীকে বদলি এবং এএসআই তারেক আজিজকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রতিবেদন পাওয়া গেলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ঢাকার নবাবগঞ্জের বাসিন্দা শিউলী আকতার গত বছরের ১৫ আগস্ট ৩৯ ভরি সোনা আত্মসাতের অভিযোগে নাজমুল হাসানের বিরুদ্ধে সাটুরিয়া থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। তাতে বলেন, দুবাই থেকে তার ফুপাতো ভাই এই স্বর্ণ পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু নাজমুল সেগুলো দেননি। ওই জিডির ভিত্তিতে নাজমুলকে আটক করে পুলিশ। তার কাছ থেকে ৯টি সোনার চুড়ি উদ্ধার করা হয়। পরে থানায় ১২ লাখ টাকার বিনিময়ে রফা হয়। ওই ঘটনার আরেকটি ভিডিওতে দেখা গেছে- সাটুরিয়া থানার ওসির পক্ষে, সুলতান মিয়ার উপস্থিতিতে টাকার লেনদেন হয়েছে। সেখানে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারাও উপস্থিত ছিলেন। পুলিশ একই ঘটনায় সুলতানের সাথে আমির নামের এক ব্যক্তিকেও আটক করে। নাজমুল বলেছেন, ওই আমিরের মাধ্যমে তিনি দুবাই গিয়েছিলেন। দুবাইয়ে কাজ না পেয়ে একপর্যায়ে তিনি দেশে ফিরে আসতে চান। তখন আমিরের লোকজন সুলতান মিয়ার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। নাজমুল স্বর্ণ নিয়ে আসছে সে তথ্য দুবাই থেকে জানানো হয় আমিরকে।
নাজমুলের বাবা ইয়ার চান জানান, ছেলে দুবাই থেকে ফেরার বিষয়টি তিনি জানতেন না। হঠাৎ একদিন একটি মাইক্রোবাস ও দু’টি মোটরসাইকেলে করে তাদের বাড়িতে আসেন। তিনি বলেন, ‘সুলতানের লোকজন বলে আপনার ছেলের কাছে সোনা পাঠিয়েছি, সেগুলো দেন। আমি বলি, ছেলে তো দুবাইতে। তখন তারা আমাকে একটি ভিডিও দেখান। সেখানে দেখা যায়- দু’টি সোনার বার ও ৯টি সোনার চুড়ি আমার ছেলের কাছে দেয়া হচ্ছে।’
ইয়ার চান জানান, পুলিশ নাজমুলকে আটক করার পর থানায় বসে ১২ লাখ টাকায় মীমাংসা হয়। তখন ছয় লাখ টাকা দিয়ে ছেলেকে ছাড়িয়ে আনেন ইয়ার চান। বাকি টাকা দেন আমির। কিন্তু কে ছিলেন সে ভিআইপি যিনি দুবাই থেকে অবৈধভাবে আনা সোনা উদ্ধারে পুলিশকে দিয়ে ধরে এনে এক যুবককে পিটিয়েছিলেন সোনা পাচারকারী চক্রের নেতা সুলতান মিয়া। পুলিশ বলেছে, একজন ভিআইপির অনুরোধে ওই যুবককে ধরে আনা হয়েছিল। তারা জানতেন না, ওই ভিআইপি একজন সোনা পাচারকারীর জন্য ফোন করেছেন।
ভিআইপির কথা বললেও তার নাম বলেনি পুলিশ। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ওই ভিআইপি মৌলভীবাজার-১ আসনের সংসদ সদস্য এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মোহাম্মদ শাহাব উদ্দিন। সুলতান মিয়ার বাড়িও মৌলভীবাজারে। এ বিষয়ে মন্ত্রী শাহাবুদ্দিনকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘সুলতান আমার এলাকার ছেলে। তার স্বর্ণ হারিয়েছে বলে আমার কাছে এসে বলেছিল। আমি পুলিশকে বলেছিলাম তদন্ত করে সত্য যাচাই করতে। আমি পুলিশকে বলিনি, তাকে ওসি বানিয়ে চেয়ারে বসাতে।’ মন্ত্রী বলেন, সুলতান স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত, তা তিনি জানতেন না। সুলতান তাকে বলেছিলেন, স্বর্ণগুলো বৈধ। শুল্ক পরিশোধ করে আনা হয়েছে। পরে মানিকগঞ্জ জেলা পুলিশ জানতে পারে, সুলতান মিয়া একজন সোনা চোরাকারবারি। দুবাই থেকে অবৈধভাবে সোনা পাঠান তিনি। এর আগে বিমানবন্দর থানায় একটি সোনা পাচারের মামলায় সুলতানকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এ বিষয়ে মানিকগঞ্জের পুলিশ সুপার সংবাদপত্রকে বলেন, ‘একজন ভিআইপি অনুরোধ করে বলেছিলেন তার এক আত্মীয়ের বিয়ের জন্য দুবাই থেকে সোনার অলঙ্কার পাঠানো হয়েছে। যার কাছে পাঠিয়েছিলেন তার বাড়িও মানিকগঞ্জে। পরে আমি পুলিশ দিয়ে ওই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আটক করি। স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়।
নাজমুলের আনা স্বর্ণ তিনি দিয়েছিলেন আদম ব্যাপারী আমিরকে। আমির সেগুলো বিক্রি করে দেন। এসব ভাগবাটোয়ারা থেকেই তিনি পুলিশকে ছয় লাখ টাকা দিয়েছিলেন। কিন্তু বিস্মিত হতে হয়, একজন মন্ত্রী কিভাবে সোনা চোরাচালানির পক্ষ নিয়ে পুলিশের কাছে তদবির করলেন?
আমরা সব সময় বলি, সোনা চোরাচালানের বাহকরাই ধরা পড়ে। মূল হোতারা থাকে সবার দৃষ্টির আড়ালে। সুলতান মিয়া আটক হয়েছিলেন, কিন্তু জামিন পেয়ে কিছুদিন আত্মগোপনে থেকে দুবাই চলে গেছেন। দুবাই পৌঁছে গত ২৭ মার্চ একটি ছবি পোস্ট করেন সুলতান। তার ক্যাপশন ছিল- ‘আলহামদুলিল্লাহ, অ্যাগেইন কামব্যাক দুবাই।’
আশা করি, ওই ঘটনা থেকে পাঠক উপলব্ধি করতে পারবেন সোনা চোরাচালানের সাথে জড়িত থাকে কারা।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা