২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

টাকার মানসিক দাসত্ব

টাকার মানসিক দাসত্ব। - ছবি : সংগৃহীত

লোকে বলে ‘টাকা’ নাকি সেকেন্ড গড (!) কেউ কেউ বলেন, টাকা হলে বাঘের চোখ পাওয়া যায়। টাকায় কী না হয়? এটিই মানুষের ধারণা। সমাজের বিত্তশালী লোকদের সবাই সমীহ করে, সম্মান করে। টাকার মালিক বা বিশাল বিত্ত-বৈভবের মালিক সংশ্লিষ্ট লোকেরা কিভাবে হলো কেউ তার খোঁজ নিতে চায় না। টাকা হলেই সব পাওয়া যায়। টাকার কাছে নৈতিকতার কোনো মূল্য নেই।

একজন বিবেকবান বা চরিত্রবান মানুষের বর্তমানে সমাজে কোনো মূল্য নেই, যদি তার টাকা না থাকে। সমাজ তার নিজস্ব রূপ-চরিত্র বদলে ফেলেছে। টাকার কাছে ‘সমাজ’ নির্বিকার হয়ে যাচ্ছে। আগে দেখেছি, যে ব্যক্তি অসৎ পথে অর্থ উপার্জন করে তার বাড়িতে মসজিদের ইমামরা দাওয়াতে যেতেন না। এখন মসজিদে মোটা অঙ্কের টাকা দিলেই সমাজে চিহ্নিত অসৎ ব্যক্তিকেই মসজিদ কমিটির সভাপতি বা সেক্রেটারি মনোনীত করা হয়।

কোন চাকরি পেলে ঘুষ খাওয়া যায়, জমিজমা বিক্রি করে লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে মানুষ এমন চাকরির খোঁজে থাকে। বাংলাদেশে খুঁটির জোর বা অঢেল টাকা না হলে চাকরি পাওয়া যায় না। স্কুলশিক্ষক বা সুইপার, পিয়ন, দারোয়ান ও দফতরি পদে টাকা ছাড়া চাকরি হয় না। কিছু ব্যতিক্রম থাকলেও এমপিদের টাকা না দিলে স্কুলে কোনো শিক্ষক বা কোনো পোস্টে চাকরি হয় না। হাইকোর্টের নির্দেশে এমপিদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি পদ থেকে অপসারণ করা হয়েছে। এমপিদের রাহুগ্রাস থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বেঁচে যাওয়ায় শিক্ষক ও পরিচালনা পর্ষদ হাফ ছেড়ে রক্ষা পেয়েছে বটে, কিন্তু শিক্ষক নিয়োগে টাকার প্রতিযোগিতা বন্ধ হয়নি।

সমাজের নৈতিকতাবোধ আজ তলানিতে পৌঁছেছে। যাদের নৈতিকতাবোধ রয়েছে তারা আছেন সবচেয়ে কঠিন মানসিক যন্ত্রণায়, যারা অনৈতিকতার প্রতিরোধ বা প্রতিকার করতে পারছেন না; এ ব্যর্থতার গ্লানি নিয়েই তাদের দিন কাটে। ‘মিথ্যা’ কথা বলা, মিথ্যা সাক্ষী বা মিথ্যা প্রতিবেদন দেয়া যেন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। লোকে এখন সহসাই বলে থাকে, ‘সত্যের ভাত এ দেশে নেই।’ তবে ‘সদা সত্য কথা বলব’ এ কথাগুলো কি শুধু পাঠ্যবইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে? না কি মানুষের ‘অভ্যাসের’ অন্তর্ভুক্ত হবে এটিই এখন একটি প্রশ্ন, যার সমাধান প্রত্যাশা করা যায় না।

নিরাপত্তার প্রশ্নে ‘কারাগার’ সবচেয়ে দুর্গম এলাকা যেখানে হাজতি বা কয়েদি এবং কারারক্ষী ছাড়া অন্য লোকের প্রবেশ করার ন্যূনতম সুযোগ নেই। কিন্তু টাকা হলে বাংলাদেশের যেকোনো জেলখানায় নারী সঙ্গ থেকে শুরু করে কারাগারে সব কিছুই ব্যবস্থা করা যায়। ইতঃপূর্বে আমি নিজে কয়েকবার জেল খেটেছি। ওয়ান-ইলেভেনের অবৈধ সরকারের আদেশে ২৬ মাস কারাগারে ছিলাম। সেখানে দেখেছি, টাকা হলেই যেকোনো নেশার দ্রব্য কারাগারে পাওয়া যায়। তখন মোবাইলে কথা বলা নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু আমাদের সাথে ডিভিশন সেল ছাড়াও প্রভাবশালী সাধারণ কয়েদিদের হাতেও মোবাইল দেখেছি। এগুলো সবই হয়েছে কারাগার কর্তৃপক্ষকে অর্থের বিনিময়ে রাজি খুশি করার মাধ্যমে। অর্থের পরিমাণ বেশি হলে কারাগার থেকে বাড়িতে গিয়ে দু-এক রাত কাটানোর ইতিহাসও রয়েছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশ- হলমার্ক কেলেঙ্কারি মামলার অন্যতম আসামি হলমার্কের মহাব্যবস্থাপকের সাথে বহিরাগত এক নারীকে ৪৫ মিনিট অবস্থান করার সুযোগ দিয়ে অনৈতিক সুবিধা দিয়েছে কারাগার কর্তৃপক্ষ। কারাগারের সিসিটিভি ক্যামেরায় ধারণকৃত এ ভিডিও চিত্রটি একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে প্রচারিত হলে তা ভাইরাল হয়ে যায়। অথচ কারাগারে ‘সাক্ষাৎকার’ কারাকর্তৃপক্ষের একটি ব্যবসায়িক অ্যাজেন্ডা জড়িত রয়েছে।

আদালতকে বলা হয় একটি পবিত্র জায়গা। কিন্তু সময়ের সন্ধিক্ষণে মানুষ তা বিশ্বাস করে কি না তা হলো ভিন্ন কথা। কিন্তু কথায় বলে অযাচিত টাকার জন্য কোর্টের ইট পাথরও হাঁ করে থাকে। ব্রিটিশ আমল থেকে এ পদ্ধতি শুরু হয়েছে। এখন বাড়তি টাকা দেয়া যেন একটি রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। এ রেওয়াজ বন্ধ করার জন্য ‘লোক দেখানো’ কথা বলা হয় সত্য, কিন্তু বাস্তবে উল্লেখযোগ্য কোনো উদ্যোগ নেই। আদালতকে বলা হয় পবিত্র অঙ্গন, অথচ শপথবাক্য পাঠ করে ‘মিথ্যা’ দিয়েই আদালতে পথচলা শুরু করতে হয়। এ জন্য শুধু আদালতবেষ্টিত কর্মকর্তারা দায়ী নয়; বরং দায় রয়েছে আইনজীবী ও গোটা সমাজের।

দেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষগুলো দিন দিন কর্মহীন ও দরিদ্র হয়ে যাচ্ছে। অন্য দিকে দেশ ঋণগ্রস্ত হচ্ছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশ, ২৩ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে একটি শিশু জন্মগ্রহণ করে। অন্য দিকে প্রকাশ পাচ্ছে, ব্যাংক থেকে যে ঋণ নেয়া হয়েছে তা আদায় হচ্ছে অনেক ধীরগতিতে। বোদ্ধামহলের ধারণা, ঋণ বাবদ গৃহীত অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। বিদেশে বাড়ি গাড়ি হচ্ছে ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণের অর্থে। দেশটিকে দেউলিয়া করার যা যা উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার এক শ্রেণীর পুঁজিপতি যারা সরকারি ঘরানার লোক হিসেবে পরিচিত তারা সবই করে যাচ্ছে। দেশকে লুট করা প্রতিরোধে সরকারি কোনো উদ্যোগ নেই। অতি সম্প্রতি পত্রিকান্তরে প্রকাশ, পাঁচটি পদ্ধতিতে দেশ থেকে টাকা পাচার হয়, এর মধ্যে বৈধ পদ্ধতিও রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, টাকা এখন কাগজে পরিণত হয়েছে। ফলে মুদ্রাস্ফীতি রোধ করা যাচ্ছে না বলে ক্রমান্বয়ে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করা যাচ্ছে না। একটি জাতিকে সামগ্রিকভাবে গতিশীল করার জন্য যে উদ্যোগ সমষ্টিগতভাবে নেয়া দরকার, তা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। স্বাধীনতার ৫২ বছর অতিক্রম হতে যাচ্ছে, কিন্তু জাতি আজ বিভিন্ন কারণে দ্বিধাবিভক্ত, এ বিভক্তি সহসা দূর হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই।

একটি জাতিকে গতিশীল করতে হলে তাদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে হবে। দেশপ্রেম থাকলে রাতারাতি কেউ ধনী সমৃদ্ধশালী হওয়ার অপকৌশল খুঁজতে পারে না। এ দেশে এক শ্রেণীর মানুষের মুখের জোর এতই বেশি যে, তাদের বক্তব্যে বোঝাই যাবে না, কে দেশপ্রেমিক ও কে দেশপ্রেমিক নয়।

বিভিন্ন অপকৌশলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভিন্ন খাতে ব্যবহার করা হচ্ছে। নিজ নিজ স্বার্থকে চরিতার্থ করার জন্য এক শ্রেণীর সুবিধাবাদি গোষ্ঠী নিজ কর্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে চালিয়ে দেয়। গণমানুষের অধিকার আদায়ের জন্য মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এ দেশের জনগণ। কিন্তু মানুষের সেই স্বপ্ন কি সার্বিকভাবে সবার জন্য বাস্তবায়িত হয়েছে? গরিব দিন দিন নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। অন্য দিকে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কোটিপতির সংখ্যা, যাদের একটি অংশ সরকারি ঘরানার, বাকি অংশ হচ্ছে নব্য আওয়ামী লীগার। নব্য আওয়ামী লীগারদের সম্পর্কে আওয়ামী লীগের মূল স্রোতধারা অসন্তোষ প্রকাশ করলেও নব্যরাই শক্তিশালী অবস্থায় আছে। তবে ক্যাসিনো বা এ ধরনের কোনো অপরাধে ধরা পড়লে মন্ত্রীরা বলে, অভিযুক্ত ব্যক্তি বিএনপি থেকে এসেছে।

জনগণের নিরাপত্তার জন্য রয়েছে পুলিশ। লজিস্টিক সাপোর্ট দিয়ে পুলিশকে অনেক সমৃদ্ধশালী করা হয়েছে। পুলিশকে জনগণের বন্ধু বানানোর জন্য সরকারের আপ্রাণ চেষ্টা থাকলেও জনগণ পুলিশকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতে পেরেছে কি? এখনো মানুষের বদ্ধমূল ধারণা এই, থানায় যেতে হলে টাকা নিয়ে যেতে হবে এবং টাকা ছাড়া থানায় কোনো কাজ হয় না। একটি জিডি করতে গেলেও ডিউটি অফিসারের জন্য টাকা নিয়ে যেতে হয়; এ ধারণা থেকে গণমানুষ সরে আসতে পারেনি। কারারক্ষী বা পুলিশের একটি অংশ মাদকব্যবসায় থেকে শুরু করে বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত, সংবাদ ও মিডিয়াতে প্রায়ই প্রকাশ পাচ্ছে।

সরকারের কোনো দফতরেই অযাচিত অর্থ ব্যয় না করলে কোনো সেবা পাওয়া যায় না। করোনার সময় চালু হওয়া বিভিন্ন সরকারি অফিসে লেখা রয়েছে-‘ নো মাস্ক-নো সার্ভিস’। কিন্তু বাস্তবে চিত্রটি এই-‘নো টাকা-নো সার্ভিস’। এই নীতিতেই সরকারি অফিসগুলো চলছে। মাঝে মধ্যে দু-চারজন হাতেগোনা সরকারি কর্মচারী পাওয়া যায় যারা ঘুষ নেন না। ঘুষ ছাড়া একমাত্র সেবা পাওয়া যায় ব্যাংক কর্মচারীদের কাছ থেকে যারা নিম্নপর্যায়ের কর্মচারী, যাদের দায়িত্ব শুধু টাকা জমা করা বা প্রদান করা। কিন্তু ব্যাংক যারা পরিচালনা করে এবং নীতিনির্ধারক তারা মোটা অঙ্কের বিনিময়ে বিভিন্ন অযাচিত ঋণ দিয়ে ব্যাংক খালি করে দেয়ার ঘটনা প্রকাশিত হয়েছে। ব্যাংকগুলো পরিচালনায় রয়েছে সরকারি ঘরানার লোকেরা, যারা এক ব্যাংকের ঋণখেলাপি অন্য ব্যাংকের ডাইরেক্টর।

অযাচিত লেনদেন একটি সামাজিক ব্যাধি। দেশে শিক্ষিত লোকের অভাব নেই এবং শিক্ষিত লোকেরাই সরকারের বিভিন্ন দফতরে চাকরিতে রয়েছেন। শিক্ষার পাশাপাশি যদি নৈতিকতা না থাকে তবে শিক্ষিত ও অশিক্ষিতের মধ্যে কোনো তফাৎ থাকে না। নৈতিকতা কোনো বই পুস্তক ও স্কুল-কলেজের বিষয় নয়, এটি পুরাপুরি মনমগজ ও নিজ বিবেকের বিষয়। বিবেক কি তা-ও কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষালাভ করা যাবে না। নিজেকে নিজে প্রশ্ন করলেই ‘বিবেক’ জবাব দেয় কোন কাজটি নৈতিক ও কোন কাজটি অনৈতিক। ধর্মীয় পুস্তক পড়ে নৈতিকতা শিক্ষালাভে সহায়ক হতে পারে, কিন্তু নিজ থেকে সচেতন না হলে কেউ নৈতিকতাপূর্ণ জ্ঞানে সমৃদ্ধ হতে পারে না। এ জন্য দরকার কোনো কাজ করার আগে বা কোনো বক্তব্য দেয়ার আগে নিজেকে নিজে জিজ্ঞাসা করা, তবেই নিজ ‘বিবেক’ কম্পিউটারের মতো সঠিক রাস্তা প্রদর্শন করবে; নতুবা নয়। ফলে শিক্ষা ও নৈতিকতা একটি ভিন্ন দিক, যা অর্জন করতে হবে নিজ প্রচেষ্টায়।

টাকা ও ক্ষমতা- এ দুই শক্তি একটি আরেকটির পরিপূরক। টাকাই ক্ষমতার উৎস, পক্ষান্তরে ক্ষমতাই টাকার উৎস। একটি মসজিদ নির্মাণ করার সময়ও কে বৈধ বা অবৈধ উপায়ে উপার্জিত অর্থ দান করে তা কেউ বিবেচনা করে না। টাকা দিলেই মৌলভি-মাওলানাসহ সবাই তাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকে। সত্য বলা বা হককথা বলা এখন সমাজ থেকে উঠে গেছে। সত্য ও হককথা বলা মানুষের সংখ্যা এখন শূন্যের কোঠায় চলে যাচ্ছে। মানুষ সব বুঝেও না বোঝার ভান করে। সর্বক্ষেত্রে চলছে যেন মানসিক দাসত্ব। এ দাসত্ব থেকে মুক্ত হওয়ার সব রাস্তাই দিন দিন ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে। মানসিক দাসত্বের কারণে মানুষের উপলব্ধিজ্ঞান বিলুপ্ত হয়ে পড়েছে। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন- ‘ওদের অন্তর আছে কিন্তু তা উপলব্ধি করার চেষ্টা করে না, চোখ আছে কিন্তু দেখার চেষ্টা করে না, কান আছে কিন্তু শোনার চেষ্টা করে না। ওরা পশুর মতো; বরং সত্য পথ সম্পর্কে পশুর চেয়েও অসচেতন। ওরাই হচ্ছে সত্যিকারের গাফেল।’ (সূরা আরাফ, আয়াত : ১৭৯।

লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail: [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement