ঘুরে গেলেন টনি ব্লেয়ার, কেন রাখঢাক
- মুজতাহিদ ফারুকী
- ০৮ মার্চ ২০২৩, ১৯:৩০
সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার হঠাৎ করেই বাংলাদেশ সফর করে গেলেন। ইনি হলেন সেই ব্যক্তি যার বিরুদ্ধে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে মিথ্যা বলার অভিযোগ সরকারের তদন্তেই প্রমাণিত। নিজের দেশকে ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যোগ দিতে সম্মত করাতে ২০০৩ সালে পার্লামেন্টে তিনি মিথ্যা তথ্য তুলে ধরেছিলেন। বলেছিলেন, সাদ্দাম হোসেনের কাছে ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্রের মজুদ আছে। যদিও কোনো সূত্রেই সেই তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত ছিল না। তার বিরুদ্ধে ২০১৭ সালে তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ পায়। তদন্ত কমিশনের প্রধান স্যার জন চিলকট হাজার হাজার পৃষ্ঠার রিপোর্টে ব্লেয়ারকে দোষী সাব্যস্ত করেন। কিন্তু ব্লেয়ারকে কাঠগড়ায় উঠতে হয়নি।
ইরাকের লাখ লাখ মানুষের জীবনহানি, দেশটির সামগ্রিক ধ্বংসের জন্য তার বিচার হয়নি। ব্রিটিশ হাইকোর্টের বিজ্ঞ বিচারকরা বলে দিয়েছেন, ইংরেজের আইনে এমন কোনো বিধান নেই যা দিয়ে আগ্রাসনের বিচার করা যায়। খুব ভালো কথা। আগ্রাসনের বিচার করার আইন থাকলে তো প্রায় ৫০০ বছর ধরে সারা পৃথিবীতে বিভিন্ন জাতির বিরুদ্ধে আগ্রাসন চালিয়ে উপনিবেশ স্থাপন করা যেত না। ইংরেজ জাতিও সমৃদ্ধির শিখরে উঠতে পারত না। কিন্তু প্রশ্ন হলো- জাতির সাথে মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে কোনো আইনও কি নেই?
সেই টনি ব্লেয়ার এখন একটি ইনস্টিটিউটের নির্বাহী চেয়ারম্যান। ‘টনি ব্লেয়ার ইনস্টিটিউট ফর গ্লোবাল চেঞ্জ’ নামের এই প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য পৃথিবী থেকে চরমপন্থা বা উগ্রবাদ নির্মূল করা। আসল কথা, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ জুনিয়র সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধের নামে বিশ্বজুড়ে মুসলিমদের সব প্রতিবাদী শক্তি নির্মূলের যে সুদূরপ্রসারী অভিযান শুরু করেছেন টনি ব্লেয়ার সেই যুদ্ধের অন্যতম সিপাহসালার। বুশের সাথে টনির সম্পর্ক এতটাই মাখামাখির ছিল যে, পাশ্চাত্যেই টনিকে ব্যঙ্গ করে ‘বুশের কুকুর’ (Bush’s poodle) বলে ডাকা হতো। টনি ঘোষণা করেছিলেন, আমরা বুশের সাথে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে আছি এবং এই যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত থাকব।
চরমপন্থা উগ্রবাদ সন্ত্রাস এসব যে কেবল মুসলিমরাই ঘটায় এটি তো এখন পুরো বিশ্বে একরকম প্রতিষ্ঠাই পেয়ে গেছে আন্তর্জাতিক মিডিয়ার অবিরাম একপেশে প্রচারণায়। মুসলিম দেশগুলোর নেতাদেরও সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে সোচ্চার ও সক্রিয় ভূমিকা। বাংলাদেশে কথিত ইসলামী মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ নির্মূলে সরকার কতটা আন্তরিক তা তো তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ থেকেই স্পষ্ট। যাই হোক, টনি ব্লেয়ারের ইনস্টিটিউট বিশ্বাস করে, চরমপন্থা, শাসনব্যবস্থা (এড়াবৎহবহপব), মধ্যপ্রাচ্য এবং জনতুষ্টিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই পরস্পর অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তাদের ঘোষিত বক্তব্য স্পষ্ট। তারা বলে, যে দেশে উগ্রবাদ বিকশিত হয় সে দেশে উন্নয়ন সম্ভব নয়।
সেই টনি ব্লেয়ার হঠাৎ কেন বাংলাদেশে? এই প্রশ্ন স্বাভাবিক। কারণ তার সফরের কোনো পূর্ব ঘোষণা ছিল না। দু’টি ইংরেজি দৈনিক ছাড়া খুব কম বাংলা পত্রিকাই তার সফরের বিষেয়ে জেনেছে। এই রাখঢাকের সফর নিয়ে ইংরেজি পত্রিকা দু’টির রিপোর্টও কিন্তু তাদের নিজের নয়। একটি বেসরকারি সংবাদ সংস্থার খবর তারা ছেপেছে। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় ব্লেয়ার নেপাল থেকে উড়ে ঢাকায় নামেন। শনিবার সকালে গণভবনে নাশতা খেতে খেতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে বৈঠক করেন। পরে সৌজন্যমূলক দেখা করেন তিনি স্পিকারের সাথে।
এসব বৈঠকে যা আলোচনা হলো তার সামান্যই মিডিয়ায় এসেছে। তাতে উল্লেখ করার মতো খুব কিছু ছিল না। সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী তার প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম সম্পর্কে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে জানান। উভয়ে বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্য সম্পর্ক পর্যালোচনা করেন ইত্যাদি। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বজুড়ে ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব ও সরকারগুলোকে সক্ষম করে তোলার ক্ষেত্রে টনি ব্লেয়ার ইনস্টিটিউটের যে মিশন সেটির প্রশংসা করেন বলে মিডিয়াকে জানান প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব।
এ সফরে ব্লেয়ার আমাদের সরকারকে সক্ষম করে তোলার জন্য কী ব্যবস্থাপত্র দিয়ে গেলেন সেটি বোঝার জন্য কিছু সময় দিতেই হবে। তবে এর সাথে বাংলাদেশে কথিত জঙ্গিবাদ নির্মূলের সংশ্লিষ্টতা থাকলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আগামী নির্বাচনের প্রাক্কালে সরকারের জঙ্গিবাদবিরোধী সক্রিয়তা কী আকার নেয় তা থেকেও অনেক কিছু আলোয় আসবে। এরই মধ্যে বিএনপির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ফ্রন্টে গুগলি ছুড়তে শুরু করেছে সেটি দৃশ্যমান। খালেদা জিয়া রাজনীতি করতে পারবেন কিনা, কিংবা নির্বাচন করতে পারবেন কিনা সেই বিতর্ক তুলে বেশ ভালো রকমের একটা ধূম্রজাল পাকিয়ে তোলা হয়েছে। নির্বাচনের আগে কারো সাথে কোনো আলোচনার প্রয়োজন নেই বলে প্রতিপক্ষের মনোবল ধসিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলছে। দেশের কোথাও কোথাও ধর্মীয় ইস্যু উসকে দিয়ে বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করার পুরনো কৌশল কাজে লাগানো হচ্ছে। অন্য দিকে প্রশাসনিকভাবে মামলা-মোকদ্দমা, গ্রেফতারের ধারাবাহিকতাও অব্যাহত রাখা হয়েছে। নির্বাচন যত ঘনাবে এসব ততই জোরালো হবে।
টনি ব্লেয়ার সম্ভবত গত রোববার ঢাকা ছেড়ে যান। তার সফরটি এমন সময় হলো যখন মাত্র তিন দিন পরই ঢাকায় আসছেন ইন্দো-প্যাসিফিক-বিষয়ক ব্রিটিশ প্রতিমন্ত্রী অ্যান-মারি ট্রিভেলিয়ান। এটি পূর্ব ঘোষিত সফর। আগামী ১০ মার্চ শুক্রবার তিনি শুভেচ্ছা সফরে আসছেন। দায়িত্ব পাওয়ার পর এটিই হবে দক্ষিণ এশিয়ায় তার প্রথম সফর। সফরে তিনি কার কার সাথে দেখা করবেন বা সম্ভাব্য কী কী অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন তা সরকারিভাবে জানানো হয়েছে। সরকারের সাথে তার আলোচনার সম্ভাব্য বিষয়ের মধ্যে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল অগ্রাধিকার পাবে বলে জানানো হয়েছে। সেই সাথে গণতন্ত্র, রাজনীতি, অর্থনীতি, মৌলিক মানবাধিকারসহ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের প্রধান দিকগুলো থাকবে। সমসাময়িক বৈশ্বিক এবং আঞ্চলিক বিষয়গুলোও আলোচনায় আসতে পারে।
নিরাপত্তাজনিত সমস্যা না থাকলে তিনি কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প দেখতে যেতে চান। তা ছাড়া ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ইন্দো-প্যাসিফিক ইস্যুতে অনুষ্ঠেয় সেমিনার বা সভায়ও অংশ নিতে পারেন।
ঢাকার পত্রপত্রিকায় অ্যান-মারি ট্রিভেলিয়ানকে ব্রিটেনের ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির অত্যন্ত প্রভাবশালী রাজনীতিক বলে উল্লেখ করে তার সফরটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বলে ধারণা দেয়া হয়। কারণ তিনি চীন, উত্তর-পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জে ব্রিটেনের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি দেখার দায়িত্বে আছেন। তা ছাড়া ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিশেষত রফতানি নিয়ন্ত্রণ, অর্থনৈতিক ক‚টনীতি, প্রযুক্তির বিস্তার ও ব্যবহারের মতো বিষয়গুলোও তিনি দেখেন। তার চেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে- এ অঞ্চলে ব্রিটেনের স্বার্থে আঘাত বা প্রতিবন্ধকতায় নিষেধাজ্ঞার মতো অস্ত্র প্রয়োগে কনজারভেটিভ পার্টি ও সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে অ্যান-মারির রিপোর্ট তথা মূল্যায়নের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।
বাংলাদেশ এখন এক বিশেষ ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। নির্বাচনের বাকি আছে এক বছরেরও কম সময়। এমন দিনে অর্থনীতি ক্রমেই নাজুকতার মাত্রা ছাড়িয়ে বিপন্নতার দিকে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি লাগামহীন হয়ে উঠতে শুরু করেছে। বিশাল বিশাল ফ্লাইওভার, স্বপ্নের পদ্মা সেতু, নদীর তলদেশে সুড়ঙ্গপথ, ঝকঝকে সড়ক ইত্যাদি উন্নয়নের যে চমক জনগণের চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছিল সেই ঘোর এখন কেটে যাচ্ছে। লাখ কোটি টাকা ব্যয়ের পরও বিদ্যুতের অব্যাহত লোডশেডিং মানুষের চোখে খুলে দিচ্ছে উন্নয়নের অন্ধকার রূপ। প্রতিটি মেগা প্রকল্পে স্বাভাবিকের চেয়ে জনগণের অর্থের দ্বিগুণ, তিনগুণ বেশি ব্যয় নিয়ে কথা উঠতে শুরু করেছে। সর্বশেষ আদানির সাথে গোপন প্রাইভেট চুক্তি যে পুরোপুরিই জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে, তা নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা হচ্ছে। আর সবচেয়ে বড় কথা সাধারণ মানুষের ক্ষুধার্ত চোখ এখন আর কথিত অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের তীব্র ঝলক নিতে পারছে না। কারণ সেখানে সারাক্ষণ প্রত্যাশিত দুই মুঠ খাবারের ছবি ভেসে থাকে।
এমনই এক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অর্থনীতি সচল রাখতে সরকারকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আইএমএফের ঋণের শর্ত পূরণ করা যায়নি, যাবেও না। কারণ নিয়ম-শৃঙ্খলা ইত্যাদি শব্দ সরকারের অভিধানেই নেই। সুতরাং বাইরের দেশের সাহায্য ইত্যাদি আগের যেকোনো সময়ের চেয়েও এখন অনেক বেশি জরুরি। কিন্তু আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানের ঋণ দিয়ে উদ্ধার পাওয়া বর্তমান বিপন্ন অর্থনীতির পক্ষে সম্ভব না। বড় ধরনের ঋণ দিয়ে উদ্ধার করতে পারে একমাত্র চীন। সেটি নিয়ে আছে বড় ধরনের জটিলতা।
এখানেই আসে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়-আশয়। মাস দুয়েক আগে জানুয়ারিতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক নেতা ঢাকা সফর করে গেছেন। এসেছিলেন চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিন গ্যাং। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের দক্ষিণ এশিয়া-বিষয়ক জ্যেষ্ঠ পরিচালক রিয়ার অ্যাডমিরাল এইলিন লবাশের। এর পর আসেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া-বিষয়ক সহকারী মন্ত্রী ডোনাল্ড লু।
নানা কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সরকারের সম্পর্ক ছন্দে থাকেনি। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, নির্বাচন ইত্যাদি ইস্যুতে মার্কিন দূতসহ কর্মকর্তাদের বক্তব্য বিবৃতি এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কের ক্ষেত্রে বেশ অস্বস্তি ছড়িয়েছে। এখন সেই অবস্থা দৃশ্যত নেই।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে বাংলাদেশকে পাওয়ার বিষয়টি এখনো আছে। এটি বাধ্যতামূলক না হলেও সরকারের ওপর এক ধরনের চাপ তো বটেই। কারণ সবাই জানে, চীন থেকে মুখ ফিরিয়ে কিছু করার অবস্থা বাংলাদেশের নেই। আর যুক্তরাষ্ট্রের দিকে মুখ ফেরানোর অর্থ যে কী সেটি না বললেও সবার জন্যই বোধগম্য।
এ অঞ্চলে চীনের উত্থান ঠেকানোর লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্র দেশগুলো এখন একাট্টা। এ সময় টনি ব্লেয়ারের সফর ও এই পুরো অঞ্চলের দায়িত্বে নিয়োজিত ব্রিটিশ প্রতিমন্ত্রীর সফরের তাৎপর্য খুব অস্পষ্ট নয়।
ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে শরিক হলে বাংলাদেশ বেশ কিছু সুবিধা পাবে। তবে এই মুখ ফেরানোর দুরূহ দায় যুক্তরাষ্ট্র কী দিয়ে, কতটা মেটাবে বা বাংলাদেশ কতটা ছাড় আদায় করে নিতে পারবে সেটিই দেখার বিষয়।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা